লজ্জা-শরম বাতেনি ব্যাপার। দেখা যায় না। ছোঁয়া যায় না। এই জিনিস আছে ভাবলে আছে; নাই ভাবলে নাই। সাধারণত মুখচোরা স্বভাবের কম বুদ্ধিশুদ্ধির লোকের লজ্জা থাকে বেশি। এতে পদে পদে ‘গুনাহগারি’ গুনতে হয় তাঁদের। বাংলাদেশের বাইরে, অর্থাৎ বিদেশে যেসব সায়েবসুবো রাজনীতিক আছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদে যাঁরা আছেন, তাঁরা মনে হয় খানিক বেকুব কিসিমের। নইলে লজ্জা–শরমের মতো ছিঁচকে বিষয়ের কারণে কোনো বিচক্ষণ লোক ফটাফট পদ ছাড়ে?
ম্যাট হ্যানকুক লোকটার কথাই ধরুন। এই লোক যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর মন্ত্রণালয় যখন লোকজনকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাফেরা করতে বলছিল, সেই সময় ভদ্রলোক তাঁর এক নারী সহকর্মীকে জড়িয়ে ধরে মামুলি একটা চুমু খেয়েছিলেন। ও দেশে তো ওসবে বাধা নেই। কিন্তু ঝামেলা বাধাল ডেইলি সান পত্রিকা। সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা সেই ছবি তারা ছেপে দিয়ে শুধু প্রশ্ন রাখল, সামাজিক দূরত্বের এই সময়ে এই অসামাজিক ঘনিষ্ঠতা কি ভালো কথা? তারা বলল, তিনি ‘আপনি আচরি ধর্ম’ পরকে শেখাচ্ছেন না। নিজের বিধি নিজে ভেঙেছেন। বোধে খাটো হ্যানকুক এতেই শরম পেলেন। সোজা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগের চিঠি পাঠিয়ে দিলেন।
এর আগে এপ্রিলে অস্ট্রিয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়েছিলেন রুডোল্ফ আনস্কোবার। পদত্যাগের চিঠিতে তিনি যা লিখেছেন, মোদ্দা কথায় তার অর্থ দাঁড়ায়, মহামারি যেহেতু বিরাম নেয় না, সেহেতু তা সামাল দিতে চাইলে কোনো স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই। এর জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের স্বাস্থ্য এক শতে এক শ ফিট থাকা দরকার, যা তাঁর নিজের নেই। আনফিট শরীর নিয়ে গদি কামড়ে পড়ে থাকতে তাঁর অস্বস্তি (আদতে লজ্জা) লাগছে। এ কারণে তিনি পদত্যাগ করছেন।
গত বছরের জুলাইয়ে নিউজিল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডেভিড ক্লার্ক স্বাস্থ্যবিধিতে চলমান কড়াকড়ির সময় পরিবার নিয়ে সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পাবলিক তাঁকে খেপানো শুরু করলেন। তিনি লজ্জা পেয়ে জিব কামড়ে পদত্যাগ করলেন।
গত মার্চে ইকুয়েডরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার ১৯ দিনের মাথায় পদত্যাগ করেন রোদোল্ফো ফারদান। কথা উঠেছিল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এমনভাবে টিকা দিচ্ছিল, যাতে বড়লোকেরা সহজে টিকা পেলেও গরিব মানুষ তত সহজে তা পাচ্ছিলেন না। এই কথা ওঠার পর মোটা মাথার ফারদান শরমে সরে দাঁড়িয়েছেন। আর ব্রাজিলের আস্ত সরকারেরই মাথা আউলা। মহামারি ঠিকমতো সামাল দিতে পারছ না কেন?—এই বলে পাবলিক চেঁচামেচি শুরু করার পর এ পর্যন্ত সে দেশের সরকার লজ্জার চোটে চার–চারবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী বদল করেছে।
করোনা মোকাবিলায় গাফিলতি আর অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় এ পর্যন্ত আরও কত দেশের কতজন স্বাস্থ্যমন্ত্রী কতভাবে পদত্যাগ করেছেন, তার ঠিক নেই। গত বুধবার ভারতের মন্ত্রিসভায় রদবদলের আগেই হেভিওয়েট যে কয়জন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তাঁর মধ্যে আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী অশ্বিন চৌবে। করোনা মোকাবিলায় তাঁরা যে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা ভারতবাসীর জানতে যে বাকি নেই, এটি তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। বুঝতে পারা পর্যন্ত থাকলেই হতো, পদত্যাগ কোন কারণে করতে হবে!
লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই-ই। কারণ, গত ১২ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগ করাটা এখন অনেকেরই একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’ সুতরাং ‘ফ্যাশনসর্বস্ব’ অভিযোগ নিয়ে লজ্জায় পড়াটা কোনো কাজের কাজ না।
অনেকে বলছেন, মোদি সরকারের জন্য হর্ষ বর্ধন ও অশ্বিন চৌবেকে মন্ত্রীর পদে রাখাটা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে দেশে যেহেতু ভোট বলে একটা বিষয় আছে এবং সরকারগুলো ভয়াবহ ভূতের মতো ভোটকে ভয় পায়, সে জন্য ধুতির কাছায় টান পড়ার আগেই তারা বস্ত্রহরণবিষয়ক লজ্জা পেয়েছে।
অতি আনন্দের কথা, আমাদের এই সব ঝামেলা নাই। আমাদের ঝাড়া হাত–পা। আমরা ভালো করে জানি, পাবলিক কদিন চিল্লাচিল্লি করে পরে এমনি এমনিই ঠান্ডা হয়ে যাবে। করোনা আসার অনেক আগে থেকেই আমাদের নেতা, আমলা এবং অসাধারণ জনসাধারণ জানে ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’। কোটেশনে আটকানো এই ‘স্বাস্থ্য’ মানে মানবদেহ টাইপের কোনো তুচ্ছ জিনিস না, এই ‘স্বাস্থ্য’ মানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তার চ্যালাব্যালা প্রতিষ্ঠান। আর ‘সম্পদ’ মানে এই মন্ত্রণালয়ের সীমাহীন ও বাধাবন্ধনহীন লুটপাটযোগ্য সম্পদ।
‘৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম’, ‘করোনা পরীক্ষা: কিটের ঘাটতি নিয়ে দুই রকম তথ্য’, ‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন,’ ‘পড়ে আছে জীবন রক্ষাকারী সামগ্রী’, ‘করোনার ৯ হাসপাতালে ৩৭৫ কোটি টাকার দুর্নীতি’—এই ধরনের হেডিংযুক্ত খবরের পেপার কাটিং সংগ্রহ করলে বস্তা দশেক হবে বলে আন্দাজ করি। কিন্তু ‘এ নিয়ে রাজনীতি করার কিছু নেই’। লজ্জা পাওয়ার তো কিছু নেই-ই। কারণ, গত ১২ জুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই বলেছেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির অভিযোগ করাটা এখন অনেকেরই একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’ সুতরাং ‘ফ্যাশনসর্বস্ব’ অভিযোগ নিয়ে লজ্জায় পড়াটা কোনো কাজের কাজ না।
তবে করোনার সর্বশেষ ঢেউ একটু ঝামেলায় ফেলেছে। নানা জায়গা থেকে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাওয়ার খবর আসছে। সাতক্ষীরা ও বগুড়ায় অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ব্যাপারে কিছু বাজে কথা বলেছেন।
জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বললেন, এক বছরে নাকি অনেক কাজ করেছেন। আজকের (৩ জুলাই) খবর আসছে, বাংলাদেশের ৩৭টি জেলায় অক্সিজেনের ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালে পাঁচজন রোগী অক্সিজেন পায় তো ২০ জন লাইনে থাকে। কেবল অক্সিজেনের কারণে তাঁরা ছটফট করে মারা যাচ্ছেন।’ মুজিবুল হক বলেছেন, ‘ইংল্যান্ডের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আনন্দে আত্মহারা হয়ে একটি কিস করার কারণে তাঁকে রিজাইন দিতে হয়েছে। আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কী মানুষ! বুঝলাম না। ওনার লজ্জা-শরম কিছু নাই! ওনার রিজাইন দেওয়া উচিত।’
মুজিবুল হক সাহেব এবং তাঁর মতো যাঁরা এসব উত্তেজনাপূর্ণ কথার মৃতসঞ্জীবনী সুধা দিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মহোদয়ের লজ্জাশক্তিকে উজ্জীবিত করতে চাচ্ছেন, তাঁদের জানা দরকার, ঝানু রাজনীতিকদের লজ্জা–শরমবোধ এত সহজে তড়াক করে জাগ্রত হয় না। বোঝা দরকার, লজ্জাহীনতা যে বঙ্গদেশের বহু রাজনীতিকের চরিত্রের অলংকার, তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করাটাই লজ্জার বিষয়।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail.com