কাশেম বিন আবু বাকার সম্পর্কে প্রথম শুনি এক যুগ আগের বইমেলায়। একসময় বইমেলায় নিয়মিতভাবে উপন্যাস বের হতো আমার। সে কারণেই হয়তো কোন উপন্যাস কতটা পাঠকপ্রিয়তা পাচ্ছে, তা নিয়ে আমার একধরনের আগ্রহ ছিল। পরিচিত প্রকাশকেরা চেনা লেখকদের সম্পর্কে খোঁজখবর দিলেন। তারপর জানালেন আমার অপরিচিত একজন লেখকের নাম। তিনি কাশেম বিন আবু বাকার। একজন নামী প্রকাশক জানালেন: প্রচুর চলে তাঁর বই, কল্পনাই করতে পারবেন না!
তাঁকে নিয়ে কখনো আর তেমন কিছু শুনিনি, তাঁর নামই আমি প্রায় ভুলে যাই। গত সপ্তাহে কলম্বো গিয়েছিলাম ধর্মীয় উগ্রবাদ নিয়ে একটি আলোচনায়। বক্তৃতা শেষ করে বসেছি, উপমহাদেশের প্রতিটি দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থান নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, এমন সময় একজন বাংলাদেশি বন্ধু কাশেম বিন আবু বাকারের কথা তুললেন। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখেন তিনি। আর তাঁকে নিয়ে কিনা হইচই পড়ে গেছে দেশে-বিদেশে।
পরে ফেসবুকে কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে বিভিন্ন বৃত্তান্ত পড়ে বিমূঢ় হয়ে যাই আমি। শ্লেষ, ব্যঙ্গবিদ্রূপের শেষ নেই তাঁকে নিয়ে। অভিযোগও নানা রকম। তিনি অশ্লীল, তিনি মৌলবাদী, তিনি সমাজকে পেছনে টানছেন। কেউ কেউ আবার অভিযোগ তুলেছেন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম কেন তাঁকে নিয়ে লিখল এ সময়? নাকি এটি কোনো গভীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র! আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না তাঁর অপরাধটা কী, তিনি ষড়যন্ত্রটা করলেন কীভাবে? ডেইলি মেইল-এর মতো ট্যাবলয়েড পত্রিকা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র করার সামর্থ্যই বা অর্জন করল কখন?
অন্যদিকে কেউ কেউ আবার ভয়াবহ উন্মাদনা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন তাঁর পক্ষে! তিনিই একমাত্র সমাজের মূলধারার মানুষের কথা লিখেছেন, তিনি সেক্যুলারদের গণবিচ্ছিন্নতাকে উন্মোচন করে দিয়েছেন, তিনি সমাজকে প্রবল ঝাঁকি দিয়েছেন। তিনি নাকি রবীন্দ্রনাথকেও অপ্রাসঙ্গিক বানিয়ে দিয়েছেন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে আছে তাঁর ছবি নিয়ে। এই নিরীহদর্শন সাদামাটা বৃদ্ধ লেখকের বিপ্লবটা কী, আমি এটাও বুঝতে পারি না ঠিকমতো।
আমার আগ্রহ কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে নয়। বেশি আগ্রহ তাঁর সম্পর্কে আমাদের শহুরে সমাজের প্রতিক্রিয়া নিয়ে। আমাদের আলো ঝলমল শহরগুলোতে গত কয়েক বছরে বেশ ভালোভাবে দুই শ্রেণির উগ্রবাদী গোষ্ঠীর বিকাশ হয়েছে। একটা ধর্মীয় উগ্রবাদী আরেকটা ধর্মবিরোধী উগ্রবাদী। আমার ধারণা, এই দুই শ্রেণির লোকেরাই তীব্র এবং বিষাক্ত কিছু কথাবার্তা লালনপালন করেন নিজেদের মধ্যে, সুযোগ পেলেই তা উগরে দিয়ে ভাসিয়ে দিতে চান প্রতিপক্ষকে। কাশেম বিন আবু বাকারকে উপলক্ষ করে তাঁরা তা-ই করে চলেছেন।
তাঁরা কিছু বলতে চান, সেটা কাশেমকে নিয়ে নয়, তাঁকে উপলক্ষ করে একে অন্যকে। আমাদের এই সমাজের অস্থিরতা আর অশান্তির বহু প্রতিফলন রয়েছে তাঁদের এসব বক্তব্য এবং আক্রমণভঙ্গিতে।
২.
কাশেম বিন আবু বাকারের প্রতি আক্রমণের একটা কারণ তাঁর জনপ্রিয়তা। এ দেশে জনপ্রিয় ধারার প্রতি একধরনের মানুষের অনীহা বরাবরই। মুজিব পরদেশী, মমতাজ, অনন্ত জলিল প্রমুখ এই অনীহার শিকার হয়েছেন নানাভাবে। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের মতো শক্তিশালী লেখকের প্রতি বহু আক্রমণের কারণই ছিল তাঁর জনপ্রিয়তা। জনপ্রিয়তা মানেই সস্তা আর চটুল কিছু—এটা আসলে বলে জনবিচ্ছিন্ন এক উন্নাসিক শ্রেণি। এই শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশের বৃহত্তর সমাজ আর সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে তো চানই না, তা মেনে নিতেও প্রস্তুত না। তাঁরা জনগণ বলতে কেবল নিজেকে বোঝেন, মানুষ মানেও তাঁরাই।
ধর্মীয় ইস্যুতে তাঁদের এই অন্য সবাইকে বাদ দেওয়ার (এক্সক্লুশনিস্ট) মনোভাব আরও উগ্র। কাশেম বিন আবু বাকারের প্রতি মনোভাবে এটিই তীব্র হয়ে উঠেছে। সাহিত্যের উপজীব্য যদি হয় সাধারণ মানুষের জীবন, তাহলে এতে নামাজ পড়া, ইসলামি সম্বোধন ব্যবহার করা, কথাবার্তায় ইসলামি অনুশাসনের বিষয় আনা অস্বাভাবিক কি? কাশেম বিন আবু বাকার এই স্বাভাবিক বিষয়গুলো তাঁর উপন্যাসে টেনে এনে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তিনি জনপ্রিয়তা না পেলে, তিনি যে জনপ্রিয় এটি বিদেশি গণমাধ্যমে ফলাও করে না এলে, এই আক্রমণ হতো না।
ইসলামি জীবনাচরণ সাহিত্যে কেন জনপ্রিয় হবে—এই রাগ অবশ্য সরলভাবে দেখানো সম্ভব নয়। তাই কাশেম বিন আবু বাকারের প্রতি এসেছে মৌলবাদের অভিযোগ, অশ্লীলতার অভিযোগ। কিন্তু বিসমিল্লাহ বলা, ইসলামি পোশাক পরা আর ধর্মবিশ্বাস কি মৌলবাদ? আমরা প্রচলিত অর্থে মৌলবাদ বলতে চরমপন্থী বা উগ্রবাদী মনোভাব বুঝি, আরও বুঝি অন্য ধর্মের প্রতি আক্রমণ ও অসহিষ্ণুতার কথা। কাশেম বিন আবু বাকারের উপন্যাসে এগুলো আছে, তা কোথাও বলা হয়নি। তাহলে তা মৌলবাদকে (সঠিক অর্থে উগ্রবাদকে) প্রসার করছে কীভাবে? তাঁর উপন্যাসে ধর্মীয় যে শিকড়ের কথা আছে, তা আরও তীব্রভাবে আছে ভারতীয় বিভিন্ন সিরিয়ালে এবং বাহুবলী ধরনের সিনেমায়। আমরা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে এগুলো বর্জনের কথা বলি। কিন্তু হিন্দু মৌলবাদের কারণে এগুলো বর্জনের কথা বলি কি?
অথচ কাশেম বিন আবু বাকারকে দেখা হচ্ছে ভিন্ন চোখে। তাঁর প্রতি রাগের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে একটি টিভি আলোচনায় তাঁর কারণে বাংলাদেশে উগ্রবাদ ও ইসলামি লেবাসের প্রসার ঘটেছে বলা হয়েছে। এটিই আমার কাছে সবচেয়ে কৌতুকপ্রদ মনে হয়েছে। আমি কলম্বো সেমিনারে যাওয়ার আগে ধর্মীয় উগ্রবাদের ওপর বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু লেখকের লেখা মন দিয়ে পড়েছি। সেখানে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, মাদ্রাসা শিক্ষা, পাকিস্তানি ভাবধারাসহ নানা কারণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিবেচনায় এগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদের কারণ নয়; বরং উপসর্গ। আসলে আমরা কেউ কারণ খুঁজতে যাইনি। উগ্রবাদের সঙ্গে বৈষম্য, বিচ্ছিন্নকরণ, দুর্নীতি, গণতন্ত্রহীনতা, কুশাসন ছাড়াও বৈশ্বিক কারণ (যেমন: বিভিন্ন মুসলিম দেশে আমেরিকা ও ইউরোপীয়দের আক্রমণ এবং আইএসের উত্থান) এবং বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে (যেমন: ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ধর্মীয় উগ্রবাদের উত্থান) কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তার কোনো বিশ্লেষণ নেই। তাজ হাশমীর মতো দু-একজনের লেখা ছাড়া আর কোথাও এসব প্রসঙ্গ নিয়ে তেমন আলোচনা দেখিনি আমি।
সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব বোঝার মতো সহানুভূতি আর উদারতা আমাদের নেই। বরং উদারবাদের কথা বলে আমরা সংকীর্ণতায় আক্রান্ত। কাশেম বিন আবু বাকারের সাহিত্যকে মৌলবাদ/উগ্রবাদ বলা হচ্ছে সে কারণেই। আর তাঁকে অশ্লীল বলাও এ কারণেই। না হলে চুমু খাওয়া আর স্ত্রীকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে যাওয়া—শুধু এটুকু লেখা অশ্লীলতা হবে কেন?
৩.
উল্টো প্রবণতা হচ্ছে কাশেম বিন আবু বাকারকে নিয়ে প্রশংসার অতিরঞ্জন। তিনিই বাংলাদেশের বৃহত্তর মানুষের জীবনাচরণের প্রকৃত লিপিকার। তিনি এমনকি রবীন্দ্রনাথের চেয়েও বেশি জীবনঘনিষ্ঠ—এমন অদ্ভুত অতিরঞ্জনও আছে কারও কারও লেখায়। এটি করতে গিয়ে তাঁর উপন্যাস লাখ লাখ কপি বিক্রির কথা বলা হয়েছে। আসলে কি তা-ই হয়েছে? আর কোনো একটি উপন্যাস যদি বিপুলভাবে সমাদৃত হয়ে যায়, তাহলেই কি তা পাঠকদের জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে যায়? তাহলে হিমু বা মিসির আলি কি জীবনঘনিষ্ঠ? রোমেনা আফাজের দস্যু বনহুর কি তা-ই?
কাশেম বিন আবু বাকার অবশ্যই সাধারণ মানুষের জীবনের কিছু দিক নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু তাঁর লেখাটাই কি শুধু সাধারণ মানুষের জীবন? সাধারণ পরিবারের মেয়েরা কি পোশাকি ধর্ম আর বুলির ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসেননি, পুরুষতান্ত্রিকতা আর সামন্ত সমাজের অনুশাসনকে পরাজিত করে বিজয়ী হননি, নিজেদের স্বাধীন সত্তায় কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়াননি? বহু মেয়ে তা-ই করেছেন, তাঁরাও সাধারণ মানুষ। শুধু কাশেম বিন আবু বাকারের সাহিত্যই আবহমান বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিফলন নয়।
তাঁর উপন্যাসকে মৌলবাদের বিজয় বলেও অহংকার করার প্রবণতা রয়েছে কারও কারও লেখায়। আমি নিশ্চিত, বহু মানুষ বরং উল্টোটা ভাবেন। যেমন: ইসমাইল সিরাজীনামের একজন মাদ্রাসাশিক্ষক বরং অভিযোগ করেছেন যে কাশেম বিন আবু বাকার ইমান ও মাদ্রাসার ছেলেদের চরিত্রকে ধ্বংস করেছেন। তিনি ইসলাম রক্ষার প্রয়োজনে তাঁর সব উপন্যাস সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্যও ঘোষণা করেছেন।
৪.
পক্ষ-বিপক্ষের এই তীব্র মানুষেরাই আসলে উগ্রবাদী। তাঁরা হয়তো বোঝেননি কাশেম বিন আবু বাকার ধর্মান্ধ উগ্র মানুষের কথা লেখেননি, শহরের উন্নাসিক ‘প্রগতিশীল’দের কথাও লেখেননি। তিনি লিখেছেন আবহমান বাংলাদেশের মানুষের বৃহত্তর শ্রেণির কথা। তাঁরা ধর্ম মেনে চলেন, ধর্মীয় পোশাকও পরেন অনেকে। কিন্তু সমাজের কঠোর রক্ষণশীলতার মধ্যেও স্বাভাবিক মানবসত্তা থেকে ভালোবাসা খোঁজেন, ভালোবাসেন। তাঁদের কাছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা মানে কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বা উগ্রবাদের খপ্পরে পড়া নয়। তথাকথিত মডারেট না, এটাই বাংলাদেশের আবহমান ইসলাম।
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আসলে এমনই। যাঁরা এটা বুঝবেন, তাঁরা শুধু কাশেম বিন আবু বাকারকে নয়, দেশকে আর সমাজকে চিনতে পারবেন। কেন ধর্মবিরোধী উগ্রবাদীরা এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এ দেশের রাজনীতির মূলধারা নয়, তা-ও বুঝতে পারবেন।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।