অনেকবার ইংল্যান্ড গিয়েছি, কিন্তু কার্ল মার্ক্সের কবর দেখার হৃদয়বাসনা পূর্ণ হয়নি। শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনো ঝামেলা বাধত, সবকিছু ভেস্তে যেত। এবার আটঘাট বেঁধে লন্ডনপ্রবাসী প্রকৃতিবিদ কানন পুরকায়স্থর দ্বারস্থ হলাম, তিনি সানন্দে সম্মতি দিলেন এবং আমরা ৯ অক্টোবর সকালে হাইগেট কবরস্থানের উদ্দেশে রওনা হলাম। জায়গাটা পাতাল রেলস্টেশন থেকে অন্তত দুই কিলোমিটার দূরে, হেঁটেই গেলাম দুজনে। অভ্যর্থনাকক্ষ থেকে কানন হাইগেট সিমেট্রি বইয়ের দুই কপি কিনে একটি আমাকে দিলেন। কাছেই মার্ক্সের কবর, একটি চৌকো স্তম্ভের ওপর তাঁর আবক্ষ মস্তক, আশপাশে আরও কিছু কবর, পেছনে অ্যাশ গাছের বন। আমরা নতমস্তকে শ্রদ্ধা জানালাম এই মনীষীকে।
হাইগেট কবরস্থান মার্ক্স সম্পর্কে মোটামুটি এটুকুই লেখা আছে: কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩)। হাইগেটে মার্ক্সের কবর একটি প্রধান দর্শনীয় স্থান। এই জার্মান মানুষটি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী, যাঁর রচনাবলি নির্মাণ করেছে আধুনিক আন্তর্জাতিক কমিউনিজমের ভিত্তি। মার্ক্স প্রথমে সমাহিত হয়েছিলেন ১৮৮৩ সালের ১৭ মার্চ একটি সরু গলিপথে তাঁর স্ত্রীর কবরে। সাদামাটা অনুষ্ঠানে মাত্র ১৭ জন লোক উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্ক্সের চিরবান্ধব, সহলেখক ও অনুগামী সমাজতন্ত্রী ফ্রেডরিখ অ্যাঙ্গেলস (১৮২০-১৮৯৫)। ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্স স্মৃতি তহবিল গঠন করে এবং তাঁর কবরটি বড় রাস্তার পাশে দৃষ্টিশোভন জায়গায় স্থানান্তরিত হয়। দুই বছর পর মার্ক্সের ব্রোঞ্জনির্মিত আবক্ষ মস্তকসহ শ্বেতপাথরের একটি চৌকো স্তম্ভ সেখানে স্থাপিত হয়। তাতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা ছিল তাঁর নাম এবং কমিউনিস্ট ইশতেহারের (১৮৪৮) শেষ পঙ্ক্তি, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। স্তম্ভের নিচে উদ্ধৃত হয়েছে মার্ক্সের লেখা ফয়েরবাখ-বিষয়ক ১১তম থিসিসের সেই বিখ্যাত লাইনটি, ‘দার্শনিকেরা নানাভাবে কেবল জগৎকে ব্যাখ্যা করেছেন, আসল কাজ হলো এটাকে বদলানো।’ নতুন স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করেন লরেন্স ব্রাডশো (১৮৯৯-১৯৭৯), যিনি ছিলেন সমর্পিত সমাজতন্ত্রী এবং কাজটিকে অত্যন্ত শ্লাঘনীয় ভেবেছিলেন। এটি তৈরি হয়েছিল মূল কবরের পাথর দিয়ে। মার্ক্সের মেয়ে ট্রেড ইউনিয়নকর্মী এলিনোর (১৮৫৫-৯৮) বাবার এই কবরেই সমাহিত হন।
অদৃষ্টের পরিহাস, মার্ক্সবাদবিরোধী উদার রাজনৈতিক তাত্ত্বিক হারবার্ট স্পেনসার (১৮২০-১৯০৩) সমাহিত হয়েছেন রাস্তার অন্য পাশে মার্ক্সের কবরের মুখোমুখি।
প্রসঙ্গত, মার্ক্সের অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠানে (১৭ মার্চ ১৮৮৩) অ্যাঙ্গেলস প্রদত্ত দীর্ঘ ভাষণের খানিকটা এখানে উল্লিখিত হলো: ‘আজকের দিনের পুঁজিবাদী উৎপাদনপদ্ধতি এবং যে বুর্জোয়া সমাজ এই উৎপাদনপদ্ধতির সৃষ্টি তাদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে যে বিশেষ গতিতত্ত্ব, তারও আবিষ্কর্তা মার্ক্সই। যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায় কি বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ, কি সমাজতন্ত্রী সমালোচক—উভয় পক্ষেরই পূর্ববর্তী সব অনুসন্ধান অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানোর শামিল হয়েছিল, উদ্বৃত্তমূল্যের আবিষ্কার একেবারে সহসা সেই সমগ্র সমস্যাটির ওপর আলোকপাত করল। এই জাতীয় দুটি আবিষ্কারই যেকোনো মানুষের সারা জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। এমন ধরনের একটি আবিষ্কারের সৌভাগ্যও যার হয়, সে মানুষ ধন্য।...সবকিছুর ওপরে মার্ক্স ছিলেন বিপ্লবী। জীবনে তাঁর সত্যিকার লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদী সমাজ এবং সেই সমাজ যেসব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে যেকোনো প্রকারে সেগুলোর উচ্ছেদ; আধুনিক যে প্রলেতারিয়েতকে তিনিই প্রথম তার নিজস্ব অবস্থান ও তার প্রয়োজন সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিলেন, সচেতন করেছিলেন তার মুক্তির পক্ষে আবশ্যিক শর্তাবলি সম্পর্কে, তারই শৃঙ্খলমোচনে অবদান জোগান ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। সংগ্রাম ছিল তাঁর চারিত্র্যবৈশিষ্ট্য। এমন প্রচণ্ড আবেগ, নাছোড়বান্দা ভাব আর সাফল্যের সঙ্গে তিনি লড়তেন, যার তুলনা ছিল বিরল।... যুগে যুগে স্থায়ী হবে তাঁর নাম, কীর্তিত হবে তাঁর কৃতি।’
আমরা গোরস্তানে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে আবার মার্ক্সের কাছে এলাম, আর তখনই চোখে পড়ে মার্ক্সের পাশের কবরটি, সদ্য খোঁড়া, জনৈক মুসলিম নারীর। বড়ই অবাক হই। নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ ভেঙে পড়লে মার্ক্সবাদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে যখন নিন্দা ও ক্ষোভ উথলে উঠেছিল, যা আজও প্রশমিত হয়নি, তখন এই দৃঢ়চিত্ত নারী মার্ক্সের পাশেই তাঁর শেষ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছেন। দুর্ভাগ্য, তাঁর নামটি তখন লিখে আনিনি এবং পরে ভুলে গেছি। বাড়ি ফিরে লন্ডনের বন্ধুদের ফোন করলে তাঁরাও নামটি বলতে পারলেন না, তবে জানালেন তিনি জাতিতে ইরানি।
আশা করি, কবরটি একদিন বাঁধাই হবে, তাতে থাকবে তাঁর স্মৃতিফলক আর তখন জানা যাবে বিস্তারিত।
দ্বিজেন শর্মা: লেখক, নিসর্গবিদ।