নাম থেকে কারিমা বালুচের জাতিগত পরিচয় স্পষ্ট। পাকিস্তানের বালুচিস্তানের সুপরিচিত রাজনৈতিক সংগঠক ছিলেন তিনি। ২১ ডিসেম্বর সোমবার কানাডার টরন্টোতে মৃত পাওয়া গেল তাঁকে। প্রথমে অপহৃত হন। তারপর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মৃতদেহ পাওয়া যায়। সব বালুচই এই ঘটনায় শোকাহত, মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ।
বালুচিস্তানে পাকিস্তান সরকার ও সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকার সমালোচক ছিলেন কারিমা। ৪-৫ বছর আগে কানাডায় পাড়ি জমান। নিরাপত্তা তাঁর দেশান্তরের বড় কারণ ছিল। কিন্তু তারপরও তাঁকে মরতে হলো। কারিমার আগে সাজিদ বালুচ নামে আরেক রাজনীতিবিদ সুইডেনে খুন হন এ বছরই। অনেকের ধারণা, দুটো মৃত্যু একই সূত্রে যুক্ত।
বালুচিস্তানজুড়ে সুপরিচিত ছিলেন কারিমা
বালুচিস্তানে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নানান পদক্ষেপে তরুণদের মাঝে ক্ষোভ-বিক্ষোভ আছে। সচরাচর তরুণীরা কমই এ রকম আন্দোলন-সংগ্রামে শরিক হয় সেখানে। কারিমা ছিলেন ব্যতিক্রম। কানাডা পৌঁছানোর পর থেকে আন্তর্জাতিক পরিসরে বালুচিস্তানের জনজীবনের নানান প্রসঙ্গ মানবাধিকার ফোরামগুলোতে তুলে ধরতেন তিনি। এভাবে বালুচ রাজনৈতিক সমাজে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর মৃত্যু তাই সমগ্র বালুচিস্তানকে নাড়া দিয়েছে। বিএনএম (বালুচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট) ইতিমধ্যে ৪০ দিনের শোক ঘোষণা করেছে তাঁর স্মরণে।
২০১৬ সালে বিবিসি ১০০ প্রভাবশালী নারীর যে তালিকা করে, তাতে কারিমার নাম যুক্ত ছিল। মনোবিজ্ঞানের এই ছাত্রী একসময় বালুচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন নামের একটা ছাত্রসংগঠনের সভানেত্রী ছিলেন। তাঁর আগে যিনি এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন, সেই জাহিদ বালুচও একদা নিখোঁজ হয়ে যান।
কারিমার ওপর বিরক্ত ছিল পাকিস্তানের শক্তিশালী একটা গোষ্ঠী
বালুচ রাজনীতিতে যাঁরা ওই অঞ্চলের স্বাধিকারের কথা বলেন, কারিমা সেই ঘরানার প্রতিনিধিত্ব করতেন। পাকিস্তান সরকারের কাছে এরা ২০১৩ থেকে সংগঠন হিসেবে ‘নিষিদ্ধ’। বলা বাহুল্য, সব বালুচ কারিমার মতামতের সমর্থক নন। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য অনুসন্ধানে সর্বোচ্চ এক–তৃতীয়াংশ বালুচকে বিচ্ছিন্নতার ধারণার সমর্থক হিসেবে পাওয়া যায়। তবে পাকিস্তানের মাঝেই আরও অধিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি সেখানে অনেক জনপ্রিয়। কারিমা অবশ্য প্রথমোক্ত ঘরানার রাজনৈতিক কর্মী। এ রকম রাজনীতির সমর্থকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের যে সংঘাত হবে, সেটা সহজেই বোধগম্য। বিশেষ করে তিনি ২০১৭ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শুভেচ্ছাসূচক এক ভিডিও বার্তা পাঠালে পাকিস্তানে তাঁর বিরোধী পক্ষ খুব খেপে গিয়েছিল।
কারিমার মৃত্যুভীতি ছড়িয়েছে পাকিস্তানের পশতুদের মাঝেও। পশতুদের জন্যও কারিমা আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলতেন। পাকিস্তানের পরিসরে বালুচ ও পশতুরা নিজেদের একই বঞ্চনার পাটাতনে দেখে থাকে। উভয় সম্প্রদায়ের রয়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিস্তর ক্ষোভ।
কারিমার মৃত্যুতে ত্রিদেশীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাতের প্রভাব?
পাকিস্তানের যে জনপদজুড়ে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডর হচ্ছে, তার বড় অংশই বালুচিস্তানে। বালুচরা মনে করে, এই বিশাল অর্থনৈতিক আয়োজনে তাদের অংশীদারত্ব নেই। প্রাপ্তিও নেই। তাদের অঞ্চল কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের স্বার্থেই কেবল ব্যবহৃতই হয়ে চলেছে।
আবার চীন বিরোধিতার কারণে ভারতের দিক থেকেও বালুচিস্তানের আন্তদেশীয় অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে আপত্তি আছে। এ রকম ত্রিদেশীয় এক সমীকরণ থেকেই অনেক বালুচ তরুণ-তরুণী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরোধিতার জায়গা থেকে ভারতকে দূরবর্তী মিত্র ভাবে। ভারতীয় প্রচারমাধ্যমেও বালুচদের আন্দোলন ও আপত্তি বিষয়ে সহানুভূতিশীল প্রতিবেদন দেখা যায় নিয়মিত। কারিমা আন্তদেশীয় ওই দ্বন্দ্ব-সংঘাতের এক দুঃখজনক বলি হলেন বলেই অনুমান করা যায়। তবে কে তাঁকে খুন করল সেটা অস্পষ্ট।
পাকিস্তানে কারও কারও দাবি, কারিমা বালুচের মৃত্যুর পেছনে প্রতিপক্ষ দেশের হাত থাকতে পারে। তাঁদের মতে, ইউরোপে ভারতের পাকিস্তানবিরোধী প্রচারযুদ্ধের বিশাল এক নেটওয়ার্কের সব তথ্য সম্প্রতি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় কারণে কারিমাকে যেতে হলো। ‘ইইউ ডিজইনফো-ল্যাব’ নামের একটি সংস্থা সম্প্রতি এই ফাঁসকাণ্ড ঘটায়। ইউরোপে পাকিস্তানবিরোধী কিছু গ্রুপকে এই নেটওয়ার্ক কাজে লাগাত এবং শত শত মিথ্যা সংবাদমাধ্যমের নাম ব্যবহার করত তারা। শ্রী বাস্তব গ্রুপ নামে একটি সংস্থাকে এই পুরো নেটওয়ার্কের প্রধান ভিত্তি হিসেবে দেখা যায়।
এসব কিছুতে কারিমা কীভাবে সংশ্লিষ্ট, তার সামান্যই আপাতত জানা যাচ্ছে। কানাডা সরকার এসব খুঁজে দেখবে বলেই সবার আশা। অ্যামনেস্টিসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংগঠন তা–ই চাইছে।
তবে অপহরণ ও খুন হওয়া বালুচ জাতীয়তাবাদী হিসেবে ৩৭ বছর বয়সী কারিমাই প্রথম নন। বালুচিস্তানের স্বাধিকারের গোপন সংগ্রাম এবং স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের অপহরণ-গুম-খুন সবই চলছে বহুদিন। বলা যায়, ১৯৪৮ সাল থেকে। বালুচিস্তানজুড়ে নিখোঁজ রাজনৈতিক কর্মীর তালিকা অনেক দীর্ঘ। এসব নিখোঁজ মানুষের জন্য কারিমা দেশে-বিদেশে সোচ্চার ছিলেন। কারিমার নিজের পরিবারেরও ৪-৫ জন নিখোঁজ আছেন। বালুচিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতির এসব স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে পাকিস্তানের মূলধারার সংবাদমাধ্যমে লেখালেখিতে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আছে। কারিমার মৃত্যুর খবরও অধিকাংশ পাকিস্তানি প্রথম জানেন আন্তর্জাতিক সূত্র থেকে। আবার ভারতে ঘটেছে উল্টোটি। দেশটির এমন কোনো সংবাদমাধ্যম নেই, যারা সংবাদটি ফলাও করে প্রচার করেনি। সহজেই বোধগম্য, বালুচদের রাজনৈতিক সংগ্রাম আপাতত ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্ব যুদ্ধের রসদ হয়ে পড়েছে।
বালুচ সংকট যে কারণে জটিল হচ্ছে
কারিমার মৃত্যুভীতি ছড়িয়েছে পাকিস্তানের পশতুদের মাঝেও। পশতুদের জন্যও কারিমা আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলতেন। পাকিস্তানের পরিসরে বালুচ ও পশতুরা নিজেদের একই বঞ্চনার পাটাতনে দেখে থাকে। উভয় সম্প্রদায়ের রয়েছে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিস্তর ক্ষোভ। বালুচদের তরফ থেকে এর বাইরে বিবাদের একটা বড় জায়গা নিজেদের অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদের হিস্যা পাওয়ার দাবি।
এই প্রদেশের মাটিতে আছে তেল, গ্যাস, কপার, স্বর্ণসহ বিস্তর খনিজ।
এ ছাড়া এখানেই চলছে অবকাঠামোগত বহু প্রকল্প। গদার বন্দরসহ এসব প্রকল্পের বাস্তবায়নে বালুচরা লাভবান হচ্ছে না, তারা কিছু পাচ্ছে না, এই মতামত বালুচিস্তানজুড়ে খুবই শক্তিশালী। ব্যাপারটি মিথ্যাও বলা যায় না। কারণ, প্রচুর খনিজের পরও বালুচিস্তান হলো পাকিস্তানের দরিদ্র প্রদেশ। ২০০৬-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বালুচ নেতা নওয়াব আকবর খান বুগতির হত্যাও বালুচদের মাঝে প্রায় প্রতিকার অযোগ্য এক হতাশার জন্ম দিয়েছে। ফলে প্রদেশজুড়ে জাতীয়তাবাদীরা একধরনের নীরব সশস্ত্র আন্দোলনের আড়ালে রাজনৈতিক কাজকর্ম চালাচ্ছে। বুগতি যে বছর খুন হন, সেই বছরই কারিমা রাজনীতিতে যোগ দেন।
কেন্দ্রীয় সরকারের দিক থেকে অধিকাংশ সময় বালুচদের অসন্তোষকে সামরিকভাবে সমাধান করতে চাওয়ায় পরিস্থিতি কেবল জটিলই হয়েছে। অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, দেশটিতে যতবার সামরিক শাসন এসেছে, বালুচিস্তানের পরিস্থিতি তত নতুন করে খারাপ হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী সেখানে জবাবদিহি ছাড়াই নানান অভিযানের মাধ্যমে অবস্থা সামাল দিতে গিয়ে সবকিছু কেবল আরও জটিল করে। বর্তমানে মাঝেমধ্যেই চীন-পাকিস্তানের যৌথ প্রকল্পগুলোতে সন্ত্রাসী হামলা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে সামরিকভাবে ওই অঞ্চলে শান্তি কায়েম দুরূহ। কারিমার মৃত্যু এই অশান্তির আগুনে আরেক দফা জ্বালানি সরবরাহ করবে মাত্র।
সংকটের আঁচ লাগছে ইরানের গায়েও
বালুচ জাতিয়তাবাদের প্রধান আঁচড় পাকিস্তানের ওপর দিয়ে গেলেও এই রাজনৈতিক সংকটে পরোক্ষে যুক্ত ইরান ও আফগানিস্তানও। তিন দেশ মিলেই বালুচদের বসত, যদিও সীমান্ত তাদের কৃত্রিমভাবে আলাদা করেছে। ব্রিটিশদের দখলের আগপর্যন্ত বালুচরা পুরোদস্তুর স্বাধীন জনপদের পরিচালক ছিল, এই স্মৃতি তাদের মধ্যে এখনো খুবই জীবন্ত। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দিক থেকে এসব আবার খুবই বিব্রতকর। বিশেষত বাংলাদেশ তাদের কাছ থেকে স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পর।
আফগানিস্তানে তালেবানদের উত্থান ও শক্তি সঞ্চয় বালুচিস্তানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাঝেও কিছু অভ্যন্তরীণ সংকট তৈরি করেছে। আগের মতো আর সেখানে প্রগতিশীল শক্তির একচেটিয়া নেতৃত্ব নেই। বালুচ জাতীয়তাবাদের মাঝে সুন্নি ধারার বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন যেভাবে শক্তিশালী হচ্ছে, তাতে আবার ইরান উদ্বিগ্ন। অনেক ভাষ্যকার মনে করেন, প্রগতিশীল বালুচ নেতৃত্বকে কোণঠাসা করতে এবং প্রদেশের রাজনীতিতে বিভেদ বাড়াতে পাকিস্তান সরকারও চাইছে তালেবানপন্থীরা বালুচদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠুক। এতে বিপদে পড়েছে ইরান। এসব সংগঠনের সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হচ্ছে তারা।
অনেক শিয়া হাজারাও নিহত হচ্ছে। এ নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে ইরানের প্রায়ই কূটনৈতিক সম্পর্কে তিক্ততা হয়। তবে আফগানিস্তান বিষয়টি সেভাবে দেখে না। বর্তমান আফগান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক মোটেই মধুর নয়। কাবুল পাকিস্তানের ভেতরে বালুচ ও পশতুনদের আরও স্বাধিকারের নীরব সমর্থক। এ অবস্থায় পাকিস্তান সীমান্তে প্রাচীর তৈরির যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তাতে আবার পশতুন ও বালুচদের আন্তসীমান্ত চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। এই সীমান্ত প্রাচীর পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে নতুন আরেক ক্ষোভের কারণ এখন। এই পটভূমিতেই মারা গেলেন কারিমা। তাঁকে যারাই মেরে থাকুক, এই হত্যাকাণ্ডের খবর পড়তে পড়তে বিশ্ববাসী দক্ষিণ এশিয়ায় তুষের আগুনের মতো পুড়তে থাকা এই জনপদের দিকে আবারও হয়তো মনোযোগী হয়ে উঠবে। কিন্তু কেবল ক্ষণিকের জন্যই বোধ হয় সেটা ঘটবে।
আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক