২০১০ সালে শেয়ারবাজার পতনের কারণে বহু মানুষ রিক্ত হয়েছেন। সেই ঘটনার পর সরকার এর কারণ খতিয়ে দেখতে আমাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সেই কমিটির নির্ধারিত সময় ছিল দুই মাস। কমিটি যথাসাধ্য চেষ্টা করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দুই মাসের মধ্যে এত বড় একটি ঘটনার তদন্ত করা খুব
কঠিন কাজ। তার পরও আমরা এ সময়ের মধ্যে কিছু অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছিলাম। আমাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) দুর্বলতার কারণে শেয়ারবাজারে এত বড় কেলেঙ্কারি ঘটেছিল।
বিশেষ করে অমনিবাস অ্যাকাউন্টবিষয়ক অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। এই অমনিবাস অ্যাকাউন্ট ভুতুড়ে অ্যাকাউন্ট হিসেবে পরিচিত ছিল। এই অ্যাকাউন্ট নিয়ে সরকার বা বিএসইসি কেউই তেমন একটা মাথা ঘামাত না। এতে বোঝা যায়, এসব অ্যাকাউন্ট যাঁরা পরিচালনা করেন, তাঁরা অনেক শক্তিশালী। অনুসন্ধানে আমরা অমনিবাস অ্যাকাউন্টে দুর্নীতির সত্যতা খুঁজে পেয়েছিলাম। এ কথাও সত্য যে, সময়ের অভাবে আমরা এই কয়েক লাখ ছায়া হিসাব পরীক্ষা করতে পারিনি। আমরা পুনর্গঠিত বিএসইসিকে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলাম।
কিন্তু আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বললেন, এ প্রতিবেদন ধারণাসম্মত, বাস্তবতার প্রতিফলন এখানে নেই। সরকারের আরও কোনো কোনো মন্ত্রী নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন বলে শুনেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এ তদন্ত কমিটিতে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই ধারণার ওপর ভিত্তি করে এত বড় একটি ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করবেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।
পরবর্তীকালে, আমাদের সুপারিশ অনুসারে বিএসইসি তদন্ত করে আমাদের অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। এমনকি আমাদের কিছু সুপারিশ বাস্তবায়িতও হয়েছে। অর্থমন্ত্রী এখন তাঁর সেই বক্তব্য প্রত্যাহার করবেন বলে আশা করি। আমরা সুপারিশ করেছিলাম, শেয়ারের ডিমিউচুয়ালাইজেশন করতে হবে। বিএসইসি দেরিতে হলেও তা করেছে। এর ফলে পুঁজিবাজারে এখন বড় কোনো উল্লম্ফন নেই, আবার বড় পতনও নেই। বলা যায়, বাজারে একধরনের স্থিতিশীলতা এসেছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক ঘটনা।
সরকার অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট করতে গিয়ে একটি শর্ত পূরণ করতে বাধ্য হয়। কারণ, এ আইনটি করতে গেলে প্যারিসভিত্তিক এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হতে হয়। তাদের শর্তানুসারে কোনো দেশ অ্যান্টি মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট করতে গেলে তাকে আগে অমনিবাস অ্যাকাউন্ট বন্ধ করতে হবে। ফলে সরকার অমনিবাস অ্যাকাউন্ট বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এ প্রক্রিয়া একরকম ধীরগতিতে চলছে। বলাবাহুল্য, আমরা প্রতিবেদনে অমনিবাস অ্যাকাউন্ট বন্ধের সুপারিশ করেছিলাম। একই সঙ্গে এখন বিএসইসির নজরদারিব্যবস্থা আরও উন্নত হয়েছে। এ কাজে লোক নিয়োগ করা হয়েছে, সফটওয়্যার প্রবর্তন করা হয়েছে। একটি সাির্ভল্যান্স বিভাগ চালু হয়েছে। এর ফলে শেয়ারবাজারের দুর্নীতি তারা এখন আরও দক্ষতার সঙ্গে চিহ্নিত করতে পারবে বলে আমি আশা রাখি।
এবার দুজন ব্যক্তিকে শেয়ারবাজার কারসাজি করার অভিযোগে জরিমানা করা হয়েছে। এটাকে শুভ সূচনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। আমরা আরও অনেকের বিরুদ্ধেই অমনিবাস অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কারসাজি করার অভিযোগ এনেছিলাম, আশা করি তাঁদের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে বিএসইসি যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। অর্থাৎ অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবে, আর প্রমাণিত না হলে তাঁদের নির্দোষ ঘোষণা করবে।
শুধু শেয়ারবাজার নয়, বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে মাফিয়া চক্রের প্রভাব খুব বেশি। সরকারের ওপরও এদের প্রভাব অনেক। অতীতে আমরা হাওয়া ভবন দেখেছি, এখন হয়তো হাওয়া ভবন নেই, কিন্তু কাজগুলো ঠিকই হচ্ছে। এখানে একটা উদাহরণ দিতে পারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির পর আমরা যখন তদন্তের কাজ করছিলাম, তখন একদিন শেয়ারবাজারে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি আমাদের কাছে এলেন। পুরো তদন্ত কমিটির সামনে তিনি বললেন, ‘স্যার, আমাদের ঘাঁটায়েন না। কিছু করতে পারবেন না।’ আমি তখন তাঁকে বললাম, আমরা ঘাঁটানোর কে, তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে, তাই আমরা তুলে ধরব। ঘাঁটাবে তো সরকার। তখন তিনি বললেন, ‘স্যার, ওটা ঠিক আছে। আপনারা ঘাঁটায়েন না।’ তখন তিনি আরও বললেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আমরা সামনে থাকি আর বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে অন্যরা সামনে আসবে, আমরা পেছনে থাকব।’
বিএসইসি শেয়ারবাজার কারসাজির দায়ে মোসাদ্দেক আলী ফালু ও গোলাম মোস্তফাকে যথাক্রমে এক কোটি ও তিন কোটি টাকা জরিমানা করেছে। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হলো যে প্রভাবশালীরা যত শক্তিশালীই হোন না কেন, তাঁরা আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, শেয়ারবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িত অন্যদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে কেউ এসে তদন্ত কমিটিকে এ কথা বলার সাহস পাবে না যে আমাদের ঘাঁটায়েন না। সরকারের উচিত এ ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া।
তবে শেয়ারবাজার তথা আর্থিক খাতের অনিয়ম রোধ করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাই বড় বিষয়। শুধু একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেই সে কাজ করতে পারে না। ওই প্রতিষ্ঠানকে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়াতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক দিন ধরে কাজ করতে করতে এখন একটি পর্যায়ে এসেছে। এটি যদি খুব খারাপও চলে, তার পরও অনেক অনিয়ম বেরিয়ে আসবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও বিএসইসির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ সম্পন্ন হয়নি। আমরা তদন্তের কাজ করতে গিয়ে দেখলাম বিএসইসির তেমন কোনো অর্গানোগ্রাম নেই,
আবার লোকবলেরও যথেষ্ট ঘাটতি ছিল তখন। ব্যবস্থাপনায় একটি কথা বলা হয়, একটি প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সুশাসন নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যবস্থাপকদের ওপর। তাঁরা যেভাবে আচরণ করবেন, প্রতিষ্ঠানও সে রকম আচরণ করবে।
বিএসইসির আগের কমিশনের মধ্যে অদক্ষতার পাশাপাশি দুর্নীতিও আমরা দেখতে পেয়েছি। মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও ফারুক আহমেদ সিদ্দিকীর পর ওই মাপের যোগ্য নেতৃত্ব বিএসইসিতে আর দেখা যায়নি। সে জন্য বিএসইসির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ও সুশাসনের বিষয়টি বেশ সময়সাপেক্ষ বলে আমার মনে হয়। আমি ব্যবস্থাপনার ছাত্র ছিলাম। সেখানে আমাদের ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিষয়গুলো শেখানো হতো। বলা হতো, প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা যদি দুর্নীতিপরায়ণ বা অযোগ্য হন, তাহলে প্রতিষ্ঠানও সে রকম হবে।
আশার কথা, আমাদের সুপারিশ অনুসারে বিএসইসি পুনর্গঠন হয়েছে, যদিও সেটা করতে বেশ কিছুটা সময় লেগেছে। নতুন বিএসইসি প্রথম দিকে অতটা আস্থা নিয়ে কাজ করতে পারেনি। তবে এখন তারা আস্থার সঙ্গে কাজ করছে। এ পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বিএসইসি, এ সংস্থাটি যদি ঠিকঠাক কাজ না করে, তাহলে মানুষ পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরে পাবে না। ফলে তাদের তরফ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি।
দেরিতে হলেও বিএসইসি যে দুজনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে, এটা ভালো লক্ষণ। কারণ, অনিয়মের শাস্তি না হলে তা আরও বাড়ে। তবে এই দুজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার মধ্য দিয়েই যেন বিএসইসির কার্যক্রম থেমে না যায়। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে যদি তারা অভিযুক্ত আরও কয়েকজনকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে পারে, তাহলে সেটা বাজারের জন্য খুবই ইতিবাচক ব্যাপার হবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিএসইসির কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
কারণ, তারা যদি সরকারি দলের অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বাঁচিয়ে কেবল অভিযুক্ত বিএনপি ও অন্য দলের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, তবে শেয়ারবাজারের কারসাজিও যেমন বন্ধ হবে না, তেমনি ন্যায়বিচারও নিশ্চিত হবে না। আমরা চাই শেয়ারবাজারের কারসাজির সঙ্গে জড়িত সবার শাস্তি হোক।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ: ব্যাংকার, সাবেক ডেপুটি গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।