১৮ এপ্রিল শনিবার কলকাতা পৌর করপোরেশন নির্বাচন। তাই গোটা কলকাতা এখন উত্তপ্ত। চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মারপিটও চলছে। কলকাতা পৌর করপোরেশনে রয়েছে এবার ১৪৪টি ওয়ার্ড। জয়ী ১৪৪ জন কাউন্সিলরই নির্বাচিত করবেন তাঁদের নতুন মেয়র। কে হচ্ছেন কলকাতার আগামীর মেয়র, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই।
বর্তমান মেয়র তৃণমূল কংগ্রেসের শোভন চট্টোপাধ্যায়। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। তৃণমূল নিশ্চিত শোভনই হবেন ২০১৫ সালের কলকাতার মেয়র। মমতা নিজেও প্রকাশ্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন। তবে বিজেপি এটা মানছে না। তাদের কথা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিজেপিই গড়বে কলকাতা করপোরেশনের বোর্ড। বাম দলেরও একই আশা, অবাধ নির্বাচন হলে জয়ের দরজা তাদের জন্য খুলে যাবে। কংগ্রেস পৌর বোর্ড গড়ার স্বপ্ন না দেখলেও বলেছে, তাদের আসনসংখ্যা বাড়বে। তারা হয়েও যেতে পারে করপোরেশনের বোর্ড গঠনের নির্ণায়ক শক্তি।
কলকাতা পৌর করপোরেশনের ১৪৪টি আসনের লড়াইয়ে এবার পশ্চিমবঙ্গের প্রধান চারটি দলই প্রার্থী দিয়েছে। প্রার্থিতা বাছাইয়ে চার দলের মধ্যে লড়াই হয়েছে কে কত নারী এবং সংখ্যালঘু মুসলিম প্রার্থী দিতে পারে এবার। তৃণমূল কংগ্রেস নারী প্রার্থী দেয় ৬৬ আর সংখ্যালঘু প্রার্থী দেয় ২০। তৃণমূলকে টপকিয়ে বামফ্রন্ট নারী প্রার্থী দেয় ৭৫ জন আর সংখ্যালঘু প্রার্থী দেয় ২২ জন। বিজেপি নিজেদের গা থেকে ধর্মান্ধতার গন্ধ মুছে ফেলার প্রত্যয় নিয়ে সংখ্যালঘু প্রার্থী করেছে ১৮ জনকে আর নারী প্রার্থী করেছে ৫৮ জনকে। ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ধারক কংগ্রেস নারী প্রার্থী করেছে ৩৯ জনকে আর সংখ্যালঘু প্রার্থী করেছে ২৮ জনকে।
কিন্তু কী হবে এই নির্বাচনের ফলাফল? কোন দল পৌর বোর্ড গড়বে, কে হবেন কলকাতার মেয়র—তাই নিয়ে রাজনৈতিক মহলে চলছে নানা হিসাবনিকাশ। ২০১০ সালের সর্বশেষ পৌর করপোরেশন নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। মেয়র হয়েছিলেন শোভন চট্টোপাধ্যায়। করপোরেশনের ১৪১টি আসনের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৯৫, বামফ্রন্ট পেয়েছিল ৩২, কংগ্রেস পেয়েছিল ১০ আর বিজেপি পেয়েছিল মাত্র তিনটি আসন। এবার কি সেই চিত্র বহাল থাকবে? সেই প্রশ্নটি এখন সবখানে। কারণ, এই পাঁচ বছরে কলকাতার পানি অনেক গড়িয়েছে। তৃণমূল রাজ্যের শাসনক্ষমতায় এসেছে। তার বয়সও চার বছর হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস জড়িয়ে পড়েছে নানা দুর্নীতিতে। সারদা-কাণ্ড, বর্ধমানের বিস্ফোরণ-কাণ্ড, পৌর করপোরেশনের ত্রিফলা আলো-কাণ্ড শাসক দলকে সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া কলকাতাকে লন্ডন আর উত্তরবঙ্গকে সুইজারল্যান্ড বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েও তা বাস্তবায়িত করতে পারেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ নিয়ে রাজ্যব্যাপী সমালোচনার ঝড় বইছে।
কারা জিতবে—এই প্রশ্ন রেখেছিল প্রথম আলো তিন দলের তিন নেতার কাছে: বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা, কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি অধীর চৌধুরী এবং বাম দলের রাজ্য কমিটির সদস্য রবীন দেব। তাঁদের বক্তব্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে এবার তৃণমূল কংগ্রেস আর কলকাতা পৌর করপোরেশন দখল করতে পারবে না। তাঁরা এ কথাও বলেছেন যে, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁরা মনে করেন, শাসক দল যে কোনো প্রকারে জিততে চাইবে। প্রয়োজনে তাদের দলের কর্মীরা এই নির্বাচনে সন্ত্রাস থেকে ভোটযন্ত্র ছিনতাই করার মতো সাহস দেখাতে পারে। কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী আর বিজেপির নেতা রাহুল সিনহা বললেন, কী দেখছেন এখন? বিরোধীরা রোজ মার খাচ্ছে শাসক দলের হাতে। তাদের প্রচার করতে দিচ্ছে না। ছিঁড়ে ফেলছে পোস্টার-ব্যানার। হুমকি দিচ্ছে বাড়িতে গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য। প্রতিদিনই আহত হচ্ছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখছে সব। সিপিএম নেতা রবীন দেব বললেন, স্বতন্ত্র ভূমিকা নিতে পারছেন না পশ্চিমবঙ্গের প্রধান নির্বাচনী অধিকর্তা সুশান্ত উপাধ্যায়। ফলে রাজ্যের নির্বাচন কমিশনও এখন প্রশ্নের মুখে। প্রধান নির্বাচনী অধিকর্তা যেন তিনি ঠুঁটো জগন্নাথ হিসেবে কাজ করছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা বলেছেন, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের কী ক্ষমতা আছে? নির্বাচন তো চালাচ্ছে রাজ্য সরকার। নির্বাচন অধিকর্তা তো নামে আছেন। আর কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী বললেন, না, আমাদের পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন কমিশনের ওপর আর আস্থা রাখতে পারছি না। নির্বাচন আধিকারিক তো স্বতন্ত্র ভূমিকা নিতে পারছেন না শাসক দলের চাপে। তাই আমরা পৌর করপোরেশনের সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সন্দিহান আছি। তৃণমূলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন, কলকাতায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটি হাওয়া চললেও সেই হাওয়া কত দূর বইতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে তাঁদের। কারণ, মমতা চাইবেন না এই নির্বাচনে হেরে আগামী ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য রাজ্যবাসীকে নেতিবাচক বার্তা দিতে, তাঁর দলের জয়ের পথকে বাধাগ্রস্ত করতে। তাই যেভাবেই হোক জয়ের প্রত্যাশা নিয়ে মাঠে নেমেছে তৃণমূল। দ্বিতীয়ত, কলকাতা শহরে বিজেপির একটা সমর্থন আছে। কিন্তু তাদের সংগঠন দুর্বল। ফলে তারা ভোটযুদ্ধে কত দূর এগোতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আর জাতীয় কংগ্রেসের অবস্থা তত শক্তিশালী নয়। বামফ্রন্টও এই দীর্ঘ চার বছরে তাদের হৃত গৌরব ফেরাতে পারেনি। ফলে ফের তৃণমূল কংগ্রেস পৌর করপোরেশন দখল করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। কারণ একটাই, শাসক দল তৃণমূলের সহায় আছে দলের জনবল, পুলিশ ও প্রশাসন। তাই এখন জয়ের পাল্লা ভারী শাসক দল তৃণমূলের দিকেই। আর কলকাতার এবিপি আনন্দ ও এসি নিয়েলসনের মার্চ ও এপ্রিল মাসে দুটি পৃথক যৌথ জনমত সমীক্ষায় সেই একই ইঙ্গিত রয়েছে। সর্বশেষ এপ্রিল মাসের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, তৃণমূল পেতে পারে ১০৩টি আসন। আর বামফ্রন্ট ৩১, কংগ্রেস চারটি এবং বিজেপি ছয়টি আসন।
২৮ এপ্রিল ভোট গণনা ও ফল ঘোষণা। তখন দেখা যাবে জনমত সমীক্ষা, না রাজনৈতিক দলের হিসাব—কোনটা সঠিক।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।