নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমান যখন বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে তাঁরই বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সর্বসমক্ষে তর্জনীর ইশারায় ওঠবস করাচ্ছিলেন, তখন আশপাশ থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছিল। ১৩ মের এ ঘটনাটি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের পর্দায় দৃশ্যমান হয় ১৬ মে সকালে। বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন সভ্য সমাজের কোনো মানুষের পক্ষে এ দৃশ্য সহ্যের অতীত। গণমাধ্যম শ্যামল কান্তি ভক্তের মুখটি ঢেকে দিয়ে ঘটনাটি উপস্থাপন করে। আমরা হতবাক দর্শকেরা লাঞ্ছিত শ্যামল কান্তি ভক্তের মুখ দেখতে পাই না ঠিকই, কিন্তু তাঁর ঝাপসা মুখচ্ছবির ওপরই ভেসে ওঠে এ দেশের হাজারো নির্যাতিত শিক্ষক এবং সংখ্যালঘুর মুখ; এই রাষ্ট্রব্যবস্থা যাঁদের করে রেখেছে অধস্তন।
ভব্যতার সব সীমা অতিক্রম করে শ্যামল কান্তি ভক্তকে যখন কান ধরে ওঠবস করানো হয়, তখন সেখানে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন। শ্যামল কান্তি ভক্ত কোনো অপরাধ করেছেন কি না, তা হয়তো আমরা তদন্ত শেষে জানতে পারব। কিন্তু বিচারের আগেই তাঁকে যে ধরনের লজ্জাকর শাস্তি দেওয়া হলো, তা যে একজন মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষকের জন্য মৃত্যু সমতুল্য, সেটি কি ওই শিক্ষিত জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা কর্মকর্তা বুঝতে পারেন?
আমরা জানতে পারি, শ্যামল কান্তি ভক্ত তাঁর বিদ্যালয়ের রিফাত নামের একজন ছাত্রকে শারীরিকভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় অনুতপ্ত হয়ে তিনি ছাত্রটির বাসায় যান এবং ওই ছাত্র ও অভিভাবকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। স্কুল পরিচালনা কমিটিতেও বিষয়টি আলোচিত হয়। এরপর অভিযোগ ওঠে, ১৩ মে শুক্রবার কে বা কারা পাশের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয় শ্যামল কান্তি ভক্ত ধর্ম অবমাননা করে বক্তব্য দিয়েছেন। এ ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে কিছু লোক শ্যামল কান্তি ভক্তকে মারধর করে। একপর্যায়ে স্থানীয় সাংসদ সেলিম ওসমানকে খবর দেওয়া হলে তিনি এসে শ্যামল কান্তি ভক্তকে ‘শাস্তি’ দেন। টেলিভিশনে প্রচারিত স্কুল পরিচালনা কমিটির সদস্য, সংশ্লিষ্ট মসজিদের ইমাম ও ছাত্র রিফাতের মায়ের ভাষ্য থেকে আমরা জেনেছি, শ্যামল কান্তি ভক্ত ধর্ম অবমাননাকর কোনো বক্তব্য দেননি। মসজিদের ইমামের বক্তব্য থেকে আমরা এ-ও জেনেছি, তাঁর অজ্ঞাতে কয়েকজন ব্যক্তি মাইক ব্যবহার করে পালিয়ে যায়।
সামগ্রিক ঘটনাটি যে সরকারের জন্য বিব্রতকর, তা অতিদ্রুত শিক্ষামন্ত্রী আন্তরিকতার সঙ্গে স্বীকার করেছেন এবং এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। শিক্ষকদের মর্যাদার প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রীর ত্বরিত এই হস্তক্ষেপের জন্য তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার গভীর তাৎপর্য ও ভয়াবহতার বিষয়টি গতানুগতিক এই তদন্তব্যবস্থার মধ্যে যে নিহিত নেই, সেটা জোর দিয়েই বলা যায়।
ধর্মীয় সংবেদনশীলতাকে পুঁজি করে রাজনৈতিক স্বার্থে যারা বিচার হাতে তুলে নিয়ে মানুষ খুন করার সংস্কৃতি দেশে চালু করেছে, দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে যারা অস্থিতিশীল করতে চায়, সামগ্রিক বিচারে আমাদের আলোচিত জনপ্রতিনিধির এই কর্মকাণ্ড কি সেই অপকর্মকারীদের হাতকেই শক্তিশালী করল না? মসজিদের মাইকে গুজব ছড়িয়ে রামুর বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আমরা জানি। একইভাবে সাঈদীকে চাঁদে দেখার গুজব ছড়িয়ে বগুড়াসহ দেশের অন্যান্য স্থানে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের ঘটনাও আমাদের নিকট স্মৃতিতে দগদগে ঘায়ের মতো লেপটে আছে। আমরা দেখছি নাস্তিকতার ধুয়া তুলে নির্বিঘ্নে একের পর এক খুন করা হচ্ছে লেখক-বুদ্ধিজীবী-শিক্ষকদের।
>আমরা যারা একাত্তরে রাইফেল হাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছি স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ কীভাবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে জয় বাংলাকে কি শেষ পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ চেতনার বিরুদ্ধেই দাঁড় করানো হবে?
এসব ঘটনায় মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত ও বিচলিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও ঘটনার কিনারা করতে পারছে না। তদন্তের জন্য অন্য দেশের সহায়তার দরকার পড়ছে। অথচ ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো, প্রায় প্রতিটি ঘটনার সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে গুজব ও মিথ্যাচার। আমাদের সমাজে এ ধরনের গুজব ও মিথ্যাচার কার্যকর বলেই সন্ত্রাসীরা তা কাজে লাগাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে জরুরি হলো, ঘটনার পর বিচার চাওয়ার পাশাপাশি গুজব ও মিথ্যাচারের বিশ্বাস থেকে সমাজকে বের করে আনার জন্য কার্যকর লড়াই। কিন্তু আমাদের অনেক জনপ্রতিনিধি এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে অথবা অযোগ্যতার কারণে গুজব ও মিথ্যাচারের মোকাবিলা থেকে দূরে সরে থাকতে চাইছেন। ফলে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে উৎসাহিত হচ্ছে।
লেখক-ব্লগার হত্যার কোনো ঘটনায় আমরা দেখছি না যে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তদন্ত শেষে বলছেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কোনো লেখাতেই ধর্ম অবমাননার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সত্যটা বলার ‘ঝুঁকি’ নেওয়ার বদলে বরং এমন উক্তি করছেন, যাতে হত্যাকারীরা বিপুল উৎসাহে তাদের মিথ্যাচারভিত্তিক নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে লেখকেরা লিখতে গিয়ে, শিক্ষকেরা ক্লাস নিতে গিয়ে আতঙ্কের মধ্যে থাকছেন। কখন কোনো লেখার বা কথার কী ব্যাখ্যা দাঁড় করানো হবে, এ নিয়ে তাঁরা রীতিমতো শঙ্কিত।
সাতচল্লিশে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পর থেকেই এ অঞ্চলে একশ্রেণির মানুষ রাজনৈতিক স্বার্থে ‘ধর্ম গেল’ গোছের আওয়াজ তুলে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এত বছরে যে হারে দেশে শিক্ষিতের হার বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে এই মিথ্যাচারীদের হার। মূলত ক্ষমতা আর ভোটের রাজনীতির হিসাব করতে গিয়েই এই মিথ্যাচারকে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।
অতি সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছু ‘শিক্ষার্থী’ পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়টিকে উসকে দেওয়ার কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে। অনেক ভালো শিক্ষক ক্লাসে ওই সব ‘শিক্ষার্থী’র কাছ থেকে অপ্রাসঙ্গিক সব প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন। এমন কয়েকজন শিক্ষকের কথা আমি জানি, যাঁরা তাঁদের গায়ে নাস্তিক বা ধর্ম অবমাননার মিথ্যা তকমা এঁটে দেওয়ার চেষ্টার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের কাছে অভিযোগ করে কোনোই ফল পাননি। কর্তারা হয়তো ঝামেলা হবে মনে করে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, নয়তো উল্টো ওই শিক্ষকদের তিরস্কার করে সতর্ক করেছেন।
নারায়ণগঞ্জের ঘটনায় সাংসদ সেলিম ওসমান দাবি করেছেন, জনরোষ থেকে বাঁচানোর জন্যই তিনি শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে শাস্তি দিয়েছেন। কিন্তু এই ‘জন’ কারা? যারা সাংসদের ওপর আস্থা রেখে তাঁকেই ঘটনাস্থলে ডেকে এনেছিল। যারা ঘটনার সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছিল। সাংসদ নিজেই বলছেন, জনরোষ থেকে বাঁচাতে তাঁকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। তাহলে তাঁরই অনুগত লোকজনের সম্মুখে তিনি ওই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন না কেন? আসলে তিনি কোন হিসাব থেকে এ ঘটনাটি ঘটালেন, তা বোধগম্য নয়।
সরকারের মন্ত্রী ও সাংসদেরা স্বীকার করছেন যে, ছাত্রলীগসহ সংগঠন ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে ছাত্রশিবিরসহ স্বাধীনতাবিরোধীরা ঢুকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢুকে পড়াটি কোনো বিষয় নয়, কারা কোন স্বার্থে এই ঢুকে পড়ার দরজাটা খুলে দিল, সেটিই হলো মূল বিষয়।
আমরা যারা একাত্তরে রাইফেল হাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তারা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছি স্বাধীনতাবিরোধীরা আজ কীভাবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। তাহলে জয় বাংলাকে কি শেষ পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ চেতনার বিরুদ্ধেই দাঁড় করানো হবে?
‘জয় বাংলা’ তো কেবল মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত আবেগঘন ধ্বনি নয়। ‘জয় বাংলা’ হলো সুচিন্তিত যুক্তিনির্ভর একটি আদর্শের প্রতীক—যে প্রতীকের হৃদয়ে প্রোথিত আছে অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমাদের দায়িত্বশীল নেতৃত্ব এই চেতনার প্রতীকটি আজ কাদের কণ্ঠে তুলে দিচ্ছেন?
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার৷