একদিকে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা থেকে বিরত হয়েছে স্পেনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সমৃদ্ধ অঞ্চল কাতালোনিয়া। অন্যদিকে অঞ্চলটির স্বাধীনতাপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতার একটি ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে রেখেছেন। স্বাধীনতার ঘোষণা না আসায় আবেগবন্দী স্বাধীনতাপন্থীরা হতাশ হলেও বাস্তববাদীরা রাজনীতির বলটিকে কেন্দ্রের হাতে পাঠানো গেছে ধরে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করছেন। এদিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া না হলেও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বাক্ষরের তাৎপর্য নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছে খোদ স্পেন সরকার। কাতালোনিয়া শেষমেশ স্পেনকে কোথায় নেবে, এখনো তা স্পষ্ট হচ্ছে না।
স্পেনের বাকি অংশের সঙ্গে কাতালোনিয়ার ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য প্রাচীন। এই পার্থক্য কখনো সুপ্ত, কখনো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ১৭০৭ সালের যুদ্ধে স্পেনের কাছে পরাজয়ের জেরে ১৭১৫ সালে গড়ে ওঠা আধুনিক স্পেনের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হয় কাতালোনিয়া। পরবর্তী ২০০ বছর রাজতান্ত্রিক স্পেন নির্বোধের মতো গায়ের জোরে কাতালোনিয়ার ওপরে স্পেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৩১ সালে কাতালোনিয়ার আঞ্চলিক সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এই শুভবোধ স্থায়ী হয়নি। ১৯৩৬ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলেও দখলদারি চালু থাকে। মৃত্যু এসে ফ্রাঙ্কোকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেওয়ার পরে স্পেনে গণতন্ত্র আসে। ১৯৭৭ সালে কাতালোনিয়াকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হলেও ২০০৬ সালে স্পেনের সাংবিধানিক আদালতের বাগড়ায় তা খর্বিত হয়ে যায়।
মূলত এরপর থেকেই কাতালোনিয়ায় স্বাধীনতার দাবি চাঙা হতে থাকে। ২০০৮-এর দিক থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক মন্দায় জীবনমান নামতে থাকা কাতালোনীয়দের মধ্যে বঞ্চনার বোধ বাড়িয়ে দিতে সক্ষম হন স্বাধীনতাপন্থীরা। ২০১৫ সালে কাতালোনিয়ার স্থানীয় নির্বাচনে স্বাধীনতাপন্থী দলগুলোই জয়লাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে গণভোটের সিদ্ধান্ত, চলতি মাসের প্রথম দিনের গণভোট এবং পরবর্তী রাজনৈতিক ঝঞ্ঝা।
এবার শুরু থেকেই কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দাবি দমনে কঠোর ব্যবস্থার পথে হেঁটেছে স্পেনের রক্ষণশীল কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৭৮ সালের সংবিধানকে ঢাল করে প্রথমে তেড়ে আসেন দেশের সাংবিধানিক আদালত। জানিয়ে দেন যে স্পেনীয় জাতির ‘চিরস্থায়ী একতা’ নস্যাৎকারী এই গণভোট অবৈধ। এখানেই শেষ নয়। কথা না শুনলে কাতালোনিয়ার ওপর সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করার হুমকিও এসেছে। এটা হলে কাতালোনিয়ার স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রের শাসন জারি করা যাবে। এসব ধমক অবশ্য খুব একটা কাজে এসেছে বলে মনে হয় না। আইন-আদালত ও সংবিধান দেখিয়ে কোনোকালেই কোনো স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করা যায়নি; স্পেনেও যাবে না এতে আর বিচিত্র কী। স্বাধীনতার দাবির মুখে এভাবে সংবিধান ছুড়ে মারায় কাতালোনীয়রা বরং মনস্তাত্ত্বিকভাবে স্পেন থেকে আরও দূরে সরে গেছে। এ ছাড়া কাতালোনিয়া সরকার মনে করিয়ে দিয়েছে যে জাতিসংঘের ১৯৬৬ সালের নাগরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারনামা মোতাবেক আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রত্যেক ব্যক্তির প্রথম মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, স্পেন ১৯৭৭ সালে এই অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেছে।
সংবিধানের জোরে না হলেও গায়ের জোরের দিক থেকে অবশ্য এবার বেশ সাফল্য দেখাতে পেরেছে স্পেন সরকার। গণভোটের ব্যালট ছিনতাই, কেন্দ্র দখল, হামলা-গ্রেপ্তার থেকে শুরু করে কার্লোস পুজেমনের মঙ্গলবারের ভাষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর ভূমিকা ছিল জবরদস্তিমূলক। জবরদস্তির কারণে গণভোটে উপস্থিতি অনেকটাই কম হয়েছে। এর ফলে ঠিক কত ভাগ কাতালোনীয় এই মুহূর্তে স্বাধীনতা চাইছেন, তা জানতে পারা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন বাহিনীর তৎপরতার কারণে পুজেমনের ভাষণের দিনও আদালতের বাইরে আকাঙ্ক্ষিত মাত্রায় জনসমাবেশ হয়নি বলেই মনে হয়েছে। গণভোটের ফলাফলের বিভ্রান্তির সুযোগেই কাতালোনিয়ার রাজধানী বার্সেলোনা, দেশের রাজধানী মাদ্রিদসহ সারা দেশে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার পক্ষে বড় বড় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। কাতালোনীয়দের বঞ্চনার বোধের ওপরে জাতি-রাষ্ট্রের আবেগের মেঘ বেশ ছড়িয়ে পড়েছে; স্পেন কর্তৃপক্ষের আপাতত এটুকুই সাফল্য।
পুজেমন কেন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না? একাধিক কারণে। এক. স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রসঙ্গে আইনি প্রশ্ন অবান্তর হলেও স্বাধীনতা দাবির নায্যতা প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন থেকেই যায়। ২০১৫ সালে স্থানীয় নির্বাচন কিংবা এবারের গণভোটে কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন দেখা যায়নি। শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাপারে অসন্তুষ্টি বা বঞ্চনার বোধ জাগিয়ে দেওয়াকে সম্বল করে একবিংশ শতাব্দীতে স্বাধীনতার আন্দোলন চরমে নেওয়া অত্যন্ত কঠিন।
কেন্দ্র যদি সত্যিই ১৫৫ নম্বর ধারা প্রয়োগ করে স্বায়ত্তশাসন ছিনিয়ে নেয়, তাহলে আন্দোলনের ধরনসহ প্রাসঙ্গিক নানা বিষয়ে মতভেদ আছে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থীদের মধ্যে। এই বাস্তবতা ছাড়াও আন্তর্জাতিক সমর্থনের দিক থেকেও পিছিয়ে আছে কাতালোনীয়দের আন্দোলন। সমর্থনের জন্য গোটা ইউরোপের উদ্দেশ্যে ডাক দিলেও ব্রিটেন থেকে স্বাধীন হতে চাওয়া স্কটল্যান্ড ছাড়া অন্য কোথাও থেকে সমর্থন আসেনি।
তবে এ ব্যাপারে ভিন্নমতও আছে। একদিকে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দেওয়া, অন্যদিকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করে রাখাকে পুজেমনদের মোক্ষম এক চাল হিসেবেও দেখা যেতে পারে। এমনকি হতে পারে যে কেন্দ্রের দিক থেকে আরও জবরদস্তি দেখতে চাইছেন কাতালোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থীরা? তেমন কিছু হলে সাধারণ কাতালোনীয়দের মধ্যে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা আরও বেড়ে যাবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার কাতালোনীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংলাপে অনিচ্ছার কথাও জানিয়ে দিয়েছে। এটাও কাতালোনিয়ার পক্ষে যেতে পারে। কাতালোনিয়া এখন দেশে-বিদেশে বলতে পারবে যে আমরা সংলাপের রাস্তায় থাকতে চেয়েও পারিনি। এবার ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে কাতালোনীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলন থামবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কানাডার কুইবেক, ব্রিটেনের স্কটল্যান্ডের মতো কাতালোনিয়াও যে স্পেনের জন্য বড় যন্ত্রণার হয়ে থেকে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
শান্তনু মজুমদার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।