কাতারে শ্রমিকের মৃত্যু ও প্রদীপের নিচে অন্ধকার

কাতার বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের মূল ভেন্যু
ছবি: এএফপি

বিষয়টি অনেক দিন থেকেই আলোচিত হচ্ছিল এবং পশ্চিমের কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদনও বেশ কিছুদিন আগে থেকে প্রকাশিত হচ্ছিল। ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক দেশ কাতারের প্রসঙ্গ এখানে উত্থাপন করছি। বড় মাপের যে দুটি অভিযোগের তির দেশটির দিকে ধাবিত হতে দেখা যায়, তা হচ্ছে যথাক্রমে বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক দেশ হতে পারার প্রতিযোগিতায় বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করে ফুটবলের বিশ্ব সংগঠন ফিফার সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট নিশ্চিত করে নেওয়া এবং স্বাগতিক দেশ নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার পর চোখধাঁধানো নতুন বেশ কয়েকটি স্টেডিয়াম নির্মাণের প্রক্রিয়ায় দরিদ্র দেশগুলো থেকে নিয়ে আসা শ্রমিকদের প্রতি মানবেতর আচরণ প্রদর্শন। দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি যেহেতু আমাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত, ফলে এখানে আমি সেদিকে আলোকপাত করতে আগ্রহী, অন্য দিকটির ওপর নয়।

গার্ডিয়ান বলা যায় কাতারিদের চেহারার একটি দিক অনেকটা নগ্নভাবেই উন্মোচন করে দিয়েছে। সেই দিকটি হলো দরিদ্রদের মানুষ হিসেবে গণ্য না করার মনমানসিকতা। তেল ও গ্যাস সম্পদের কল্যাণে রাতারাতি ধনী হয়ে ওঠা মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের বেলায়ই এটা প্রযোজ্য। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়ে যাওয়া নারীদের প্রতি সৌদিদের আচরণের খবর তো আমরা নিত্যই সংবাদমাধ্যমে পাচ্ছি। আমরা জানছি কীভাবে আমার দেশের হতদরিদ্র মানুষ স্বপ্নের পেছনে তাড়িত হয়ে সেই সব দেশে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরে আসছেন। অনেকে সেখানে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন।

কাতারের অর্থের সামনে এদের সেই প্রতিবাদ একসময় আগের বলিষ্ঠ অবস্থান হারিয়ে ফেললেও এখন মনে হয় ধীরে ধীরে আবারও তা জেগে উঠতে শুরু করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়া নিয়ে ক্রীড়াবিদদের অনেকেই আজকাল সচেতন

২০২২ বিশ্বকাপের জন্য আটটি স্টেডিয়াম কাতার নির্ধারণ করে নিয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি হবে একেবারেই আনকোরা স্টেডিয়াম। মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে খেলার ক্লান্তি সহনীয় করে তুলতে শীতাতপনিয়ন্ত্রণসহ সর্বাধুনিক সব যন্ত্রপাতি যেখানে যুক্ত থাকবে। এ ছাড়া এসব স্টেডিয়াম স্থাপত্য নিদর্শনের দিক থেকেও হবে চমকপ্রদ। সে রকম কয়েকটি স্থাপনার নকশা করেছেন প্রয়াত বিলেতবাসী ইরাকি স্থপতি জাহা হাদিদ। তাঁর নকশা করা কয়েকটি স্টেডিয়ামের নির্মাণকাজ শুরু হওয়া অবস্থায়ই শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনা সম্পর্কে জানা গেলে পশ্চিমের সাংবাদিকেরা একসময় এই স্থপতির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত কি না। উত্তরে জাহা হাদিদ সরাসরি বলেছিলেন, এটা তাঁর বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্যদিকে কাতারি কর্তৃপক্ষ এসব মৃত্যুকে নির্মাণ-সম্পর্কিত মৃত্যু নয় বলে বরাবর দাবি করে আসছে। এ রকম অবস্থাকেই বলা হয় প্রদীপের নিচে অন্ধকার।

বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন, বিশেষ করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অনেক দিন থেকেই বলে আসছে, কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের নামে যা হচ্ছে, সেটা হলো মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। হাজার হাজার মৃত্যুর উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি কয়েক বছর আগে বলেছিল, কাজের অমানবিক পরিবেশ এসব মৃত্যুর প্রধান কারণ। এ রকম সমালোচনার জবাবে কাতার সরকার ২০১৪ সালে খসড়া একটি শ্রমিককল্যাণ মানদণ্ড প্রণয়ন করলেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি যে আদৌ হয়নি, গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদন সেই প্রমাণ আমাদের সামনে তুলে ধরছে।

গার্ডিয়ান-এর প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ হওয়ার অধিকার অর্জনের পর থেকে গত ১০ বছরে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ—ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা থেকে কাতারে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের মধ্যে ৬ হাজার ৫০০ জন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। অন্য হিসাবে মৃত্যুর এ হার হচ্ছে গড়ে প্রতি সপ্তাহে ১২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেছেন ১ হাজার ১৮ জন। এ সংখ্যা খাটো করে দেখার কোনো উপায় নেই, কেননা প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে আছে বঞ্চনা আর প্রতারিত হওয়ার করুণ কাহিনি। গার্ডিয়ান সে রকম এক হতভাগা বাংলাদেশির উল্লেখ করেছে, যাঁর নাম মোহাম্মদ শহীদ মিয়া।

আমাদের এই ভাগ্যাহত শহীদ মিয়া দালালের হাতে আনুমানিক ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা তুলে দিয়ে কাতারে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। সেই টাকা যে ছিল পরিবারের মালিকানার সামান্য জমি বিক্রির বাইরে ধারকর্জের টাকা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। সেখানে তিনি গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যান। আমরা ধরে নিতে পারি, শহীদ মিয়া কাতারে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বছর তিনেক। এ অল্প সময়ের মধ্যে ধারকর্জ করে দালালকে দেওয়া টাকার অর্থের সামান্য এক অংশই কেবল উঠে আসতে পেরেছে। শহীদ মিয়ার আত্মীয়স্বজন বলছেন, তাঁরা এখন পরিবারের এই সদস্যের কাতারে যাওয়ার অর্থের জোগান দিতে গিয়ে ঋণভারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এবং শহীদ মিয়ার মৃত্যুতে কাতার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ তাঁরা পাননি।

কর্মরত অবস্থায় প্রাণ হারানো লোকজনের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি মনে হয় সরকারের পক্ষ থেকে কাতার সরকারের সামনে উপস্থাপন করা উচিত। কেননা, বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজন করতে যাওয়া একটি দেশের জন্য নির্মাণকাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তো হচ্ছে বাধ্যতামূলক। ভারত এদিক থেকে দেশের নিহত শ্রমিকদের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়ে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও অনেক কাঠখড় দেশটিকে এ জন্য পোড়াতে হয়েছে। গার্ডিয়ান-এর একই প্রতিবেদনে যেমন ভারতীয় শ্রমিক মধু বোল্লাপাল্লির মৃত্যুর উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বছরখানেক আলোচনার শেষে বোল্লাপাল্লির মৃত্যুর জন্য পরিবারকে মাত্র দেড় লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে কাতারি কর্তৃপক্ষ।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা বেশ কয়েক বছর ধরেই আল-কাফালা নামের ব্যবস্থা (এই ব্যবস্থার অধীনে শ্রমিকদের কাজের জায়গা বদল ও চাকরিদাতার অনুমোদন ছাড়া দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত আছে) তুলে নেওয়ার জন্য দেশটির ওপর চাপ দিয়ে আসছে। এমনকি বিশ্বকাপ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার জন্য ফিফা ও উন্নত বিশ্বে ধরনা দেওয়ার হুমকিও আইএলও একসময় দিয়েছিল।

এসব কারণেই এখন আবারও ২০২২ সালের বিশ্বকাপ অন্য কোনো দেশে সরিয়ে নেওয়ার আওয়াজ উঠেছে। বিভিন্ন দেশের তারকা ফুটবলাররাও মরুভূমির গরমে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিরোধিতা শুরু থেকেই করে আসছিলেন। কাতারের অর্থের সামনে এদের সেই প্রতিবাদ একসময় আগের বলিষ্ঠ অবস্থান হারিয়ে ফেললেও এখন মনে হয় ধীরে ধীরে আবারও তা জেগে উঠতে শুরু করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়া নিয়ে ক্রীড়াবিদদের অনেকেই আজকাল সচেতন।

মনজুরুল হক শিক্ষক ও সাংবাদিক