রবীন্দ্রনাথের ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পের পাঁচ বছর বয়সী মিনি তার পিতাকে বলেছিল, ‘বাবা, রামদয়াল দারোয়ান কাককে কৌয়া বলছিল। সে কিচ্ছু জানে না, না?’ আর আমাদের সরকারে সমাসীন রাজনৈতিক দলের সাধারণ সম্পাদক কিছুদিন আগে সিলেটে দলের বিভাগীয় সম্মেলনে বলেছেন, ‘দলের মধ্যে কাউয়া ঢুকে পড়েছে।’ অবশ্য আমরা সিলেটিরা কাককে কাউয়াই বলি, তবে কোনো কোনো জেলার আঞ্চলিক উচ্চারণে ‘খ’-এর প্রাধান্যহেতু সেটা শোনায় ‘খাউয়া’। তাই বলা হয়ে থাকে যে কাকেরা অন্যান্য জায়গা থেকে ওই সব জেলায় পৌঁছালে পর নাকি কা-কা এর পরিবর্তে খা-খা বলতে থাকে।
কাক দেখতে কালো হলেও অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ প্রাণী। আমাদের আদি পিতা আদম (আ.)-এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিল পরস্পর ঝগড়াঝাঁটি করে কাবিল হাবিলকে মেরে ফেলে কিছুতেই যখন মৃতদেহ নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না, তখন একটি কাক আরেকটি কাককে মেরে মাটিচাপা দিয়ে মৃতদেহ কবর দেওয়া শিখিয়েছিল। কাজেই কাক মানুষের শিক্ষাগুরুও।
কাকদের নিজেদের মধ্যে একতা আর সহমর্মিতাও অনুসরণীয়। হুমায়ূন আহমেদের একটি লেখায় পড়েছিলাম, কাকের বিচার ও শাস্তিদানের পদ্ধতি তিনি স্বয়ং প্রত্যক্ষ করেছেন। আর কোনো এলাকায় একটি কাক মারা গেলে এলাকার সব কাক এসে কা-কা করে এলাকাটিকে নরকগুলজার করে তোলে, সেটা আমি অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি। ইংরেজরা খুব রসিক জাতি; তাই ‘এক পাল কাক’-এর ইংরেজি ওরা যথার্থই করেছে, ‘এ মার্ডার অব ক্রোজ (A Murder of crows)’।
বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের বিকাশেও কাকের অবদান আছে বৈকি। এ ভাষার অনেক শব্দ ও শব্দগুচ্ছ কাক থেকেই উদ্ভূত। যেমন কাকচক্ষু, কাকনিদ্রা, কাকভোর, কাকভেজা, কাকতাড়ুয়া, কাকতালীয়, কাকউড়াল-দূরত্ব, বক মধ্যে কাক যথা ইত্যাদি ইত্যাদি। অধিক আর কী বলব!
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, কলকাতার এক পত্রিকায় বহু আগে বেরিয়েছিল: ‘কমলা কান্তের কনিষ্ঠা কন্যা কাকলি কহিল কাকা কলকাতার কাক কা-কা করে কেন, কাকা কহিল কা-কা করাই কাকের কাজ।’ লক্ষণীয় যে এই বাক্যটির প্রতিটি শব্দ ‘ক’ দিয়ে আরম্ভ হয়েছে।
শিক্ষার্থীদেরও কাক থেকে কিছু শেখার আছে। সংস্কৃতে একটি শ্লোক আছে: ‘কাকঃ চেষ্টা, বকঃ ধ্যানং, শ্বাণঃ নিদ্রা তথৈবচ/গুরু-ভক্তি, ভোগঃ ত্যাগ, বিদ্যার্থী পঞ্চ-লক্ষণমঃ।’ অর্থাৎ প্রকৃত বিদ্যার্থীর পাঁচটি লক্ষণ থাকা চাই—কাক-চিলের মতো শিকার ধরতে গিয়ে বারবার চেষ্টা তথা অধ্যবসায়, বকের মতো মাছ ধরার কালে একনিষ্ঠতা, কুকুরের মতো স্বল্পনিদ্রা, গুরুজনদের ভক্তি করা ও ভোগ-বিলাস পরিত্যাগ করা।
আমাদের খনার বচনেও কাকের অংশীদারত্ব আছে: ‘শূন্য কলসি, শুকনো না (নৌকা)/ গাছের ডালে ডাকছে কা/ খনা বলে এরেও ঠেলি/ যদিনা দেখি বিষম তেলি।’ অর্থাৎ যাত্রার শুরুতে অশুভ লক্ষণসমূহের মধ্যে কাকের কা-কা রব নাকি অন্যতম।
সম্রাট আকবর দিল্লিতে কাকের সংখ্যা কত জিজ্ঞেস করায় বীরবল যে হাস্যরসাত্মক জবাব দিয়েছিলেন, সেটা বোধ করি সকলেরই জানা: ‘জাহাঁপনা, দিল্লিতে কাকের সংখ্যা ন’লক্ষ ন’হাজার ন’শো নিরান্নব্বই। এর বেশি হলে বুঝতে হবে বাহির থেকে কিছু কাক এই শহরে বেড়াতে এসেছে, আর কম হলে বুঝতে হবে কিছু কাক বাইরে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে গেছে।’ কী চমৎকার গণনা!
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পেও কাক যথারীতি বিদ্যমান: মোল্লাজি এক তাল মাংস হাতে নিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন। একটি কাক এসে ছোঁ মেরে তাঁর হাত থেকে কাঁচা মাংসখণ্ড নিয়ে নিলে তিনি রাগ করার পরিবর্তে হেসে হেসে বলতে লাগলেন, ‘তুই মাংস নিয়েছিস বটে, কিন্তু রেসিপি (রন্ধন-প্রণালি) তো আমার পকেটে রয়ে গেছে।’
আর কথায় বলে, মানুষে নাপিত ধূর্ত, পক্ষীতে বায়স। বায়স মানে কাক। তবে ধূর্ত বলা ঠিক নয়, চতুর বললেই হয়। পরিশেষে তাহলে পরিবেশন করি বিষ্ণুশর্মার পঞ্চতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত হিতোপদেশের গল্পে কাকের চতুরতার কাহিনি:
একটি গাছে একটা কাক সপরিবারে বাস করত। কিন্তু ওই গাছেই আরেকটা কালসাপ বাস করাতে কাকের মনে শান্তি ছিল না; কালসাপ ওর বাচ্চাগুলোকে খেয়ে ফেলত। একদিন কাকের বউ ওকে বলল, ‘কথায় আছে—দুশ্চরিত্রা ভার্যা, শঠ মিত্র, মুখের ওপর জবাব দেওয়া ভৃত্য আর ঘরে সাপ নিয়ে বাস মৃত্যুতুল্য। অতএব চলো, আমরা অন্যত্র চলে যাই।’ কাক জবাব দিল, ‘দেখা যাক কী করা যায়। যার বুদ্ধি আছে তারই বল। নির্বোধের আর শক্তি কোথায়?’
অতঃপর সে বউকে বলল, ‘ওই যে অদূরে সরোবরটা দেখছ, ওখানে এক রাজপুত্র রোজ স্নান করতে আসেন। স্নানের সময় তিনি গলার সোনার হারটা ঘাটের ওপর রাখেন। আজ যখন রাজপুত্র হারটা ঘাটের ওপর রেখে সরোবরে নামবেন, তখন তুমি ঠোঁটে করে হারটা তুলে সাপের অজ্ঞাতে ওর গর্তে রেখে আসবে। তারপর দেখা যাক কী হয়!’
ঠিক তাই-ই করা হলো। এবং অতঃপর রাজপুত্রের নির্দেশে লোকজন বন তোলপাড় করে সাপের গর্তে হারটা খুঁজে পেয়ে লাঠির আঘাতে সাপকে হত্যা করল। এভাবে বুদ্ধির বলে শত্রুর বিনাশ সাধিত হলো।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷