মো. কাউছ মিয়ার কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। তাঁর একটি জীবনী আমার হাতে এসেছে। ছাপানো কোনো বই নয়; কম্পিউটারে কম্পোজ করা ২২ পাতার এই জীবনী। লেখক জীবনীর শিরোনাম নিয়ে হয়তো দ্বিধায় ছিলেন। কারণ শিরোনাম চারটি। একটি হচ্ছে, সফল ব্যবসায়ীর জীবন্ত কিংবদন্তি হাজি মো. কাউছ মিয়া (৬৬ বছরের ব্যবসায়িক সাফল্যের ইতিবৃত্ত)।
মো. কাউছ মিয়া মূলত একজন জর্দা ব্যবসায়ী। আর এই জর্দা ব্যবসায়ীর শীর্ষ করদাতা হওয়ার গল্প কমবেশি আমাদের প্রায় সবারই জানা। এর আগে একাধিকবার শীর্ষ ১০ করদাতার তালিকায় তাঁর নাম থাকলেও তাঁকে নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ দেখা যায়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) তালিকাটি খুব বেশি প্রচারও করেনি। ফলে এক বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা প্রকাশ করার পর সবার ওপরে নাম থাকায় কাউছ মিয়া অনেকের নজরে এসেছিলেন। এক বছর পর আবারও শীর্ষ করদাতা হওয়ার পর এবার তাঁকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে অনেক বেশি।
এক বছর আগে (২০১৫ সালে) আমার সহকর্মী শুভংকর কর্মকার অনেক সাধ্য–সাধনা করে কাউছ মিয়াকে কথা বলাতে রাজি করিয়েছিলেন। তখন তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে পরিস্থিতি খানিকটা পাল্টে গেছে। এক বছর পর আবারও কাউছ মিয়ার সঙ্গে কথা বলে এসে শুভংকরের ধারণা হচ্ছে, শীর্ষ করদাতা হওয়ার সম্মান তিনি এবার বেশ উপভোগই করছেন। এক বছর আগেও কাউছ মিয়াকে প্রশ্ন করে করে অনেক কিছু জানতে হয়েছে। আর এবার রীতিমতো ২২ পাতার জীবনী তৈরি। জীবনীর শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘মায়ের দেয়া আড়াই হাজার টাকার পুঁজিতে ১৯৫০ সাল থেকে ৬৬ বছর যাবৎ সফলভাবে ব্যবসা করে আজ তিনি বিপুল নগদ অর্থ-বিত্তের মালিক। তাঁর ব্যবসায়িক সাফল্যের কথা মানুষের মুখে মুখে ভেসে বেড়ায়।’
জীবনীটিতে মো. কাউছ মিয়ার দাদার কেনা ৩৫ মণ ওজনের সিন্দুক, প্রথম নিজের কেনা বৈদ্যুতিক পাখা, চাঁদপুরের একমাত্র টেলিফোনের মালিক হওয়া থেকে শুরু করে মজার মজার নানা তথ্য আছে। কাউছ মিয়ার জীবনের সংগ্রাম, টিকে থাকা, ভাইয়ের কারণে সবকিছু খোয়ানো, আবার উঠে দাঁড়ানো—এসব থেকে অনেকেই হয়তো অনেক কিছু শিখতে পারবেন। আবার সমালোচনাও করা যায়। তামাক ব্যবসাটাই তো ক্ষতিকর। এ ছাড়া নানা সময়ে পণ্য মজুত করেও কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছেন কাউছ মিয়া। যদিও তাঁর সাফাই হচ্ছে নিত্যপণ্য নিয়ে কখনো তিনি মজুত ব্যবসা করেননি। মজুত করতেন তামাক-সিগারেট, প্রসাধনী—এসব।
২২ পৃষ্ঠার জীবনী পড়ে অবশ্য মনে হয়েছে, ভালো-খারাপ যা-ই হোক, কাউছ মিয়া নিজের বিষয়ে অকপট। খোলা মনে অনেক কিছুই বলেছেন। শীর্ষ করদাতা হিসেবে কত কর দেন তারও একটি ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জর্দার ব্যবসা থেকে এখন মাসে ৪০-৫০ লাখ টাকা কর দিতে হয়। অর্থাৎ, এক কর-বছরে কর দেন চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। অকপটে অনেক কিছু বলার আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যায়। ২২ পাতার জীবনীতে বলা হয়েছে, ‘সরকার যখন অঘোষিত টাকা বৈধ করার জন্য ১০ শতাংশ কর ঘোষণা করেছে, তখন কাউছ মিয়া সরকারের ঘোষণায় সাড়া দিয়ে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অঘোষিত টাকা হোয়াইট করে নিয়েছেন। গাড়ি বোঝাই করে তাঁর কাছে থাকা ব্যবসায়িক মুনাফার সকল অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়ে সাদা করে নিয়েছেন। তখন তিনি মুনাফার অর্থ দিয়ে ঢাকা শহরে কয়েকটি বাড়ি ও জায়গা কিনেছেন।’
কাউছ মিয়ার জীবনী পড়ে প্রশ্নটি এমনিতেই মাথায় আসে। তা হলো, কাউছ মিয়ার ‘বড় ভাই’য়েরা কোথায়? যাঁর নাম ধরতে গেলে কেউই জানত না, তিনিই যদি শীর্ষ করদাতা হন, তাহলে যাঁদের আমরা জানি, তাঁদের নাম তালিকায় নেই কেন? এবার এনবিআর সবচেয়ে বেশি করদাতাকে পুরস্কার দেওয়া ছাড়াও ২০১৫-১৬ করবর্ষের জন্য ১০০ শীর্ষ করদাতার একটি তালিকাও তৈরি করেছে। ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি ওষুধ কোম্পানির ৬ জন সদস্য বছরের পর বছর ধরে শীর্ষ ১০ করদাতার তালিকায় আছেন। দীর্ঘদিন ধরে তালিকায় আছেন স্কয়ার গ্রুপের সদস্যরা। আরও আছেন চট্টগ্রামের এ কে খান গ্রুপের চার ভাই। এর বাইরে ১০০ জনের তালিকায় পরিচিত বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে। যেমন ট্রান্সকম গ্রুপের লতিফুর রহমান ও শাহনাজ রহমান, এসিআই গ্রুপের আনিস উদ দৌলা, এমজিএইচের এম গাজিউল হক ও আনিস আহমেদ, থার্মেক্স গ্রুপের আবদুল কাদির মোল্লা, একমি ফার্মার মিজানুর রহমান সিনহা, বিএসআরএমের আলী হোসেন আকবর আলী প্রমুখ।
তৈরি পোশাক দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত হলেও এই খাতের মাত্র একজনের নাম রয়েছে শীর্ষ ১০০ করদাতার তালিকায়, হা-মীম গ্রুপের এ কে আজাদ। এর বাইরে নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাম থাকলেও তিনি এখন বেশি পরিচিত ব্যাংক মালিকদের সংগঠনের নেতা হিসেবে। রাজনীতি করেন এমন ব্যবসায়ী আছেন দুজন। যেমন গাজী গ্রুপের গোলাম দস্তগীর গাজী এমপি এবং বিএনপির নেতা মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ।
বড় শিল্পপতি বলে যাঁরা দাপিয়ে বেড়ান, সরকারি নানা আনুকূল্য নেন, নানা ধরনের পদ নিয়ে বসে থাকেন, সভা-সমিতি ও সেমিনারে বড় বড় বক্তৃতা দেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই কিন্তু নাম নেই ওই তালিকায়। একটা ঘটনা তাহলে বলি। এনবিআরের একজন সাবেক চেয়ারম্যানের কাছে শোনা ঘটনাটি। তিনি একদিন বিশেষ আমন্ত্রণে যান একজন ব্যাংকারের বাসায়। একটি বিদেশি ব্যাংকের শীর্ষপদে থাকা সেই ব্যাংকার থাকেন ব্যাংকেরই ভাড়া করে দেওয়া গুলশানের একটি বিলাসবহুল বাড়িতে। বাড়িটির মালিক একজন বড় ব্যবসায়ী। এনবিআরের চেয়ারম্যান মালিকের নাম জেনে পরের দিন অফিসে এসে ওই ব্যবসায়ীর আয়করের নথি খুললেন। দেখলেন, সেখানে বাড়ির কোনো উল্লেখ নেই। অনুসন্ধান করে এনবিআর আরও জানল, ঢাকায় এ রকম একাধিক বাড়ির মালিক তিনি। তারপর তলব করা হলো। সেই ব্যবসায়ী বকেয়া সব কর একসঙ্গে দিতে সেবার বাধ্য হয়েছিলেন।
বাড়ির মালিক ওই ব্যবসায়ী কিন্তু খুবই পরিচিত একটি মুখ। এ রকম অনেক পরিচিত মুখ আছেন, যাঁরা কর দেওয়া ছাড়া বাকি সবকিছুই করেন। ফলে শীর্ষ করদাতার তালিকায় তাঁরা থাকেন না। দুনিয়াজুড়েই এখন শীর্ষ ধনীদের তালিকা তৈরির একটি রেওয়াজ আছে। শীর্ষ ধনী বিল গেটসের সম্পদ বাড়া বা কমার খবরের পাঠক কম নেই। দেশ ভিত্তিতেও এই তালিকা করা হয়। অনায়াসেই আমরা জানতে পারি ভারতের শীর্ষ ১০ ধনী কারা কারা। কিন্তু বাংলাদেশে তা জানা সম্ভব নয়। এখানে সবকিছুই গোপন। কেননা, আয় বা সম্পদের প্রকৃত হিসাব দিলেই তো এর বিপরীতে সব ধরনের কর দিতে হবে। কর ফাঁকি দিতেই সবকিছু গোপন করেন। ফলে তাঁরা কোনো তালিকাতেই স্থান পান না। পেতে সম্ভবত চানও না।
এখন কাউছ মিয়ার প্রসঙ্গ এসেই যায়। জীবনীর শেষে তাঁর সম্বন্ধে একটা তথ্য দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হাজী কাউছ মিয়ার পূর্বপুরুষেরা কেউ কোনো দিন ব্যাংক লোনের ধারেকাছে ছিলেন না, এমনকি কাউছ মিয়া নিজেও কোনো দিন ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কাজ করেননি।’ অবশ্য ব্যাংক ঋণ নেওয়া খারাপ কিছু নয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো আমাদের দেশে কর না দেওয়া ধনীদের একটি বড় অংশেরই সম্পদের উৎস ব্যাংক ঋণ। আশির দশক থেকে তাঁরা ব্যাংক থেকে ক্রমাগত ঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি। সেই ধারা এখনো বন্ধ হয়নি। এখনো তাঁরা নানা কৌশল করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছেন। আর এ ক্ষেত্রে মিলছে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাও। ২০১৫ সালে বৃহৎ ঋণ পুনর্গঠনের নামে ১৫ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিত করা হচ্ছে এর সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশে ধনী হওয়ার সবচেয়ে সহজ পথের একটি।
কেবল ব্যাংকঋণই নয়, মো. কাউছ মিয়া আরও একটি বিষয় থেকে দূরে থাকতেন। যাঁরা ব্যবসা করেন, তাঁদেরও ওই বিষয় থেকে দূরে থাকতে বলেছেন তিনি। পরিষ্কার করেই বলি। জীবনীতে বলা হয়েছে, ‘তিনি রাজনৈতিক দলে বিভক্ত নন। বাবা-দাদা, বড় বাপেরা কখনো রাজনীতি করেননি, পূর্বপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতি করছেন না এবং তাঁর সন্তানেরাও রাজনীতিতে জড়িত নয়। তাঁর মতে, রাজনীতি করলে ব্যবসা করতে পারবে না।’
কাউছ মিয়ার অনেক সমস্যা। নিজে জর্দার ব্যবসা করেন। মজুতদারি তাঁর আয়ের একটি বড় উৎস। বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করলেও উৎপাদনে আগ্রহ দেখাননি। কেবল জমি আর বাড়ি কিনেছেন। তারপরও মো. কাউছ মিয়া থেকে শিক্ষা নিলে সরকার অন্তত আয়করটা পেত, ব্যাংক খাতে ঋণখেলাপি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেত না, ব্যবসা আর রাজনীতিও এক হয়ে যেত না। এই তিনটাই তো বাংলাদেশে খুব দরকার।
শওকত হোসেন মাসুম: সাংবাদিক।
[email protected]