কুয়ালালামপুরে ৭ সেপ্টেম্বর ডব্লিউএসএমসির সপ্তম সামিট। পৃথিবীব্যাপী শিশুদের কল্যাণে নিয়োজিত যাঁরা, তাঁদের সভা। পাঁচতারা হোটেল ‘রয়েল চুলাহ’-র গেটে আয়োজকদের ফুল পৌঁছানোর আগেই সুশোভিত কাঁঠালচাঁপা, যেন বলল, এত দিন পরে এলে? পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আগত এক হাজার বক্তা, আলোচক, লেখক, প্রতিনিধি।
৭ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর চার দিনে আলোচনা চলে একবিংশ শতাব্দীর মিডিয়া শিশুদের কী দিতে পারে, তা নিয়ে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বক্তব্য শুনতে শুনতে মন চলে যায় পৃথিবীর নানা প্রান্তে, যেখানে শিশুরা অবহেলিত, নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। বক্তব্য শুনে ক্লান্ত হইনি, ক্লান্ত হয়েছে মনন। আমরা কোথায় পড়ে রয়েছি। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছি তরুণ ডেলিগেটদের বক্তব্য শুনে। কখনো উল্লসিত তাঁদের দৃপ্ত ক্লান্তিহীন পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনে। যাঁরা ছবি বানান তাঁদের কথা, যাঁরা লেখেন তাঁদের কথা, যাঁরা ক্লাসরুমে পড়ান তাঁদের কথা আর আমাদের মতো যারা মিডিয়াতে শিশুদের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখি, গান বাঁধি, সারা দেশ চষে বেড়াই, তাদের মনে খানিকটা আশা জাগায়।
যা জেনে এসেছি, এশিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়নের (এবিইউ) ওয়েবসাইটে, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত, কীভাবে বাচ্চাদের ডিজিটাল জীবনের সন্ধান দেওয়া যায়, কীভাবে বাজে প্রভাব থেকে তাদের মুক্ত করা যায়, সরকার কী করতে পারে, আমরা কী করতে পারি—সব দেওয়া আছে ওয়েবসাইটে। যাঁরা জানার, ইতিমধ্যে জেনে গেছেন। জানতে পারেননি যাঁরা, তাঁদের শোনাব আমাদের কলামে নানা পত্রিকায়, টেলিভিশন প্রোগ্রামে বছর ধরে। শ্রোতা হবেন তাঁরাই, শিশুদের যাঁরা ভালোবাসেন, তাদের জীবনকে খানিকটা স্পর্শ করার জন্য যিনি সময় দিতে প্রস্তুত, যিনি জীবনকে অকাতরে বিলিয়ে দিতে জানেন।
কী পেলাম? পেয়েছি এমন লোকদের স্পর্শ, যাঁরা সারাক্ষণ শিশুদের কথা ভাবছেন, কীভাবে তাদের শিক্ষা পূর্ণতা পাবে, কীভাবে আধুনিক গণমাধ্যম তাদের পাশে দাঁড়াবে। একটি কম্পিউটার, একটি টেলিভিশন, একটি মোবাইল ফোন, একটি উন্নত বিদ্যালয়ে আধুনিক গণমাধ্যমের পরিকল্পনা কীভাবে, কত সহজে এনে দিতে পারে উন্নত জীবনের সন্ধান। পৃথিবীব্যাপী প্রায় এক হাজার প্রতিষ্ঠান এ কাজে নিয়োজিত। বাংলাদেশেও এদের সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে, অথচ এ নিয়ে আলোচনা প্রায় নেই বললেই চলে; সরকারের নেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন।
ড. প্যাট্রিসিয়া এডগার ডব্লিউএসএমসির প্রতিষ্ঠাতা। ৯৫ বছর বয়সী নারী। বয়সের ভারে ক্লান্ত নন। কনফারেন্সজুড়ে তাঁর বক্তৃতায়, চলনে-বলনে, ভালোবাসায় ব্যক্ত করলেন পৃথিবীর অবহেলিত মানবতার প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথা। আমার পত্নী আসমা আব্বাসীকে বললেন, ‘আমার বহুদিনের শখ বাংলাদেশের শিশুদের পাশে গিয়ে দাঁড়াব, সে সুযোগ আসেনি। আগামী বছর জেনেভায় যে অষ্টম সম্মেলন হবে, তাতে যোগদানের পথে ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে রইল। তত দিনে তোমরা আজ যে গান গাইলে, সেই গানে পৃথিবী ভরিয়ে দিয়ো।’ গানটির নাম: ‘উই অল উইল’। প্রি-সামিট ওয়ার্কশপ ছিল সাতটি, যাঁরা এ নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে রুদ্ধদ্বার আলোচনা। বিষয়বস্তু: ১. দৃঢ় সন্তানদের জন্য প্রয়োজন দৃঢ় গল্প, ২. টেলিভিশনের জন্য সত্যিকার উপযোগী স্ক্রিপ্ট তৈরি, ৩. শিশুদের সঙ্গে কাজ করা, ৪. মাল্টিপ্ল্যাটফর্ম যুগে পাবলিক সার্ভিস মিডিয়াতে শিশুদের জন্য কী রেখে গেলাম, ৫. সোশ্যাল মিডিয়া: শিশুদের নতুন খেলার মাঠ, ৬. ইনডেপ্টথ স্টাডি: ফিচার ফিল্ম: ফিল্ম ও অ্যানিমেশন স্টাডি, ৭. ডিজিটাল যুগে শিশুদের অধিকার।
সম্মেলনের মূল বক্তা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী রোজমা মনসুর, যেমন বিদুষী-সুন্দরী, তেমনি তাঁর বক্তৃতা। সভা স্তম্ভিত। থিম সং ‘উই অল উইল’-এর সঙ্গে ঘরের মানুষ কণ্ঠ মেলাল। সহজ সুর, এক মিনিটেই শেখা যায়। মালয়েশিয়ায় আমার বন্ধু ড. চন্দ্র মোজাফফর বললেন মোদ্দা কথা। যদি ধর্মের মূল সুরটি ভুলে যাও, তাহলে এগুলোর কোনোটাই কাজে দেবে না। আরও বললেন, ড. মাইকেল ম্যাকলাক্সকি, অভিডিও মিকুলিস্কু ও আরও অনেকে।
সুন্দর আয়োজন, বিশেষ করে শিশুদের। শত শিশু তাদের প্রতিভার পরিচয় দিল সম্মেলক নৃত্যে, সংগীতে, বক্তৃতায়, আলোচনায়। পাশাপাশি প্রদর্শনী চলছে। সম্মেলনে সাধারণত কেউ কারও বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী হয় না, এখানে তার বিপরীত। প্রতিটি প্রি-সামিট ও মূল বক্তৃতা মঞ্চে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে, তা শোনার জন্য সবাই উদ্গ্রীব। কেউ নোট নিচ্ছেন, কেউ ভিডিও করছেন, কেউ বা কম্পিউটার নোটপ্যাডে সঙ্গে সঙ্গে স্থাপন করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন নিজ নিজ দেশে। গাজার শিশুদের চিত্র যখন দেখানো হলো, সবার মন কেঁদে উঠেছে। বলেছি: কী হবে সামিট করে, যেখানে সহস্র শিশু আজ বোমার আঘাতে সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত। যারা বেঁচে আছে, তারা দুঃস্বপ্ন দেখেছে বলে কেঁদে উঠছে, বিছানা ভিজিয়েছে ভয়ে, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তাদের আকাশের দিকে, ওখানে কেউ আছে কি?
সম্মেলনের সন্ধ্যাগুলো সংগীতমুখর। রোমানিয়া থেকে এসেছে রেডিও ন্যাশনাল অর্কেস্ট্রার ১০০ জন, চাইকফিস্কর সোয়ান লেক থেকে ভায়োলিন ও গিটারে শোনালেন পশ্চিম দিগন্তের সুরবাণী। কণ্ঠ মেলালেন মালয়েশিয়ার সুপ্রানো, টুইনটাওয়ারের দেওয়ান ফিলহারমনিক পেট্রোনাসে দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠানে। শেষ অনুষ্ঠান মালয়েশিয়ান শিল্পীদের ও শিশুদের ‘টিপট্যাপটপ প্রহরের সংগীত’, আঙ্গাসাপুরি অডিটোরিয়ামে। জাভেদ মুত্তাগি, আমার পুরোনো বন্ধু এবিইউর সেক্রেটারি জেনারেল, অনুষ্ঠানের প্রাণপুরুষ। বললেন, আবার কবে দেখা হবে, আব্বাসী?
শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত। ফুলে ফুলে সজ্জিত কাঁঠালচাঁপা, জুঁই, করবী, দোলনচাঁপা। এরা বাংলাদেশেরও ফুল।
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব।
[email protected]