কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছে তিস্তাও

.
.

‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে’। ‘হাঁকাও গাড়ি চিলমারী’ আমাদের সংগীতাঙ্গিক ভাওয়াইয়ার একটি বিখ্যাত চরণের অংশ। ১১ সেপ্টেম্বর ভোর সাড়ে পাঁচটায় আমরা রাজশাহী থেকে চিলমারী বন্দরের জেলা কুড়িগ্রামের উদ্দেশে গাড়ি হাঁকাই। মহিষ বা গরুর গাড়িকে হাঁকডাক পেড়ে দ্রুত ব্রহ্মপুত্র নদের বন্দর চিলমারীতে নিয়ে যাওয়ার তাড়া রয়েছে এতে। গানটিতে বাংলার উত্তরাঞ্চলের ভৌগোলিক অবস্থান, সংগ্রামী জীবন-জীবিকা, বিরহ-বেদনা, সুখ-দুঃখ—সবকিছুর চিত্রই আঁকা আছে। শুধু এই গান নয়, ভাওয়াইয়ার গায়কি ও সুরের অনন্য বৈশিষ্ট্যটিও এসেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবনবাস্তবতা থেকে। গাড়িয়াল উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতে গেয়ে যান। গাড়িটি যখন হঠাৎ হঠাৎ রাস্তার নিচু খাদে পড়ে, তখন গায়কের স্বাভাবিক কণ্ঠস্বর ধাক্কা খায় এবং সুরও ভেঙে যায়। সুরের এই ‘ভাঙা’ ভাওয়াইয়াকে অসাধারণ এক শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের ওপর দাঁড় করিয়েছে, যা অন্য কোনো সংগীতে বিরল।
আমি ও আমার কয়েক সহকর্মী অবশ্য মহিষ বা গরুর গাড়িতে নয়, মাইক্রোবাসে রওনা হই। গন্তব্য কুড়িগ্রাম থেকে আরও ২০ কিলোমিটার দূরে নাগেশ্বরী উপজেলা সদর। ভারতের পেটের মধ্যে ঢুকে আছে উপজেলাটি। উত্তর-পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার, উত্তরে আসামের ধুবড়ি আর পূর্বে মেঘালয়ের অরণ্যবেষ্টিত পাহাড়।
ব্যক্তিগত কাজে গেলেও রাস্তার দুপাশে নজর রাখি। কেননা, প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ আমাদের যে জেলাগুলোর ওপর দিয়ে যেতে হবে, সেগুলোতে কোথাও দ্বিতীয় দফা আবার কোথাও তৃতীয় দফা বন্যা হয়েছে এবার। ৮ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর শেষ পাতার একটি খবর থেকে পাওয়া এ তথ্য আমার হাতে আছে যে ‘টানা বৃষ্টি ও বন্যায় ২১ জেলার প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর জমির আউশ ও আমন ধান তলিয়ে আছে। ডুবে আছে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমির সবজি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১২ লাখের বেশি।’ এ হিসাব দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
এখন অবশ্য পানি কমছে। এই সঙ্গে ফসল-ঘরবাড়ির ক্ষতির পাশাপাশি পুকুর ও মাছের খামার ভেসে যাওয়া, উপদ্রুত এলাকায় পেটের পীড়া ছড়িয়ে পড়া এবং গবাদিপশুর খুরারোগে আক্রান্ত হওয়ার খবরও আসছে প্রতিদিন। নাগেশ্বরী যেতে রাজশাহী ছাড়া আর যে জেলাগুলোর ওপর দিয়ে যেতে হয়, সেগুলো হলো নাটোর, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রাম। সবগুলো জেলার কৃষকই বন্যার ছোবলে কমবেশি বিধ্বস্ত।
রাস্তায় চারটি বড় নদী চোখে পড়ে। আত্রাই, করতোয়া, তিস্তা আর ধরলা। একমাত্র নাটোরের সিংড়া-চলনবিলসংলগ্ন আত্রাই কিছুটা উদ্ধত। বাকি তিনটি এই ভরা মৌসুমেও নিষ্প্রভ। চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রের অবস্থাও জানলাম প্রায় একই। নাটোরের সিংড়া থেকে বগুড়ার নন্দিগ্রাম পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে চলনবিলে পানি দেখা গেল। আর কোথাও পানি চোখেই পড়ে না। নদীগুলোতেও বর্ষার ভয়াল রূপ নেই। তাহলে বন্যা হলো কোথায়? মানুষের দুর্ভোগের রহস্যই বা কী?
আসলে অতীতে আমরা যে ধরনের বন্যায় অভ্যস্ত ছিলাম, ২০০৮ সালের পর থেকে দেশে সে ধরনের বন্যা হয়নি। এবারও অতীতের তুলনায় বন্যা হয়নি। কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বলা হয়েছিল, প্রশান্ত মহাসাগরের ‘এল নিনো’র প্রভাবে এবার বৃষ্টিপাত কম হবে। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে কিন্তু এই পূর্বাভাস কাজে লাগেনি। বৃষ্টিপাত অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশিই হয়েছে। তবে এই বৃষ্টি প্রথম দিকে ভাটির দিকে যতটা হয়েছে, উজানে ততটা হয়নি। মধ্য আগস্ট পর্যন্ত রংপুর অঞ্চলে তো প্রায় বৃষ্টিই ছিল না। ভাটির দিকে বৃষ্টি হলে দ্রুত তা বঙ্গোপসাগরে নেমে যায়। দেশের মধ্যাঞ্চল এতে কিছুটা প্রভাবিত হলেও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তেমন প্রভাব পড়ে না।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যা তীব্র আকার ধারণ করে উজানে বেশি বৃষ্টি হলে। হিমালয়-সংলগ্ন এলাকার এই বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে আসে ভাটির নিচু অঞ্চলে। সেই সঙ্গে সূর্যের প্রখর তাপে হিমালয়ের বরফগলা পানিও নেমে আসতে থাকে। দুইয়ে মিলে দেখা দেয় বন্যা। গত ছয় থেকে সাত বছরে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয়নি। তবে এবার আগস্টের শেষ সপ্তাহে রংপুরসহ উজান অঞ্চলে হঠাৎ বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় অবস্থা কিছুটা বেসামাল হয়ে পড়েছে।
শহর-বন্দর রাস্তা ডোবেনি, নদীসংলগ্ন চরাঞ্চল ছাড়া তেমন পানি চোখে পড়ে না। অথচ বন্যায় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কীভাবে সম্ভব? বর্তমান সময়ে বন্যার এ এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ হলো চোরাগোপ্তা হামলার মতো; খালি চোখে যা প্রায় দেখাই যায় না। প্রধানত দুটি কারণে সৃষ্টি হচ্ছে এ অবস্থা। একটি হলো অনভ্যস্ততা, অন্যটি দ্রুত পানি নেমে যাওয়ার সুযোগ না থাকা।
আমাদের দেশ বন্যায় কী রকম অভ্যস্ত ছিল, সে বিষয়ে গত শতকের ষাটের দশকে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। সিরাজগঞ্জের চলনবিল-সংলগ্ন উল্লাপাড়া উপজেলায় আমার বাড়ি। গ্রামের নাম কানসোনা। গণমাধ্যম, বিশেষ করে ছাপমাধ্যমের অনেকেরই চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের ‘কানসোনার মুখ’-এর কথা মনে থাকতে পারে। আমাদের সেই গ্রাম কানসোনার পাশে রয়েছে আরও দুটি গ্রাম। একটি সলপ, অন্যটি হাঁড়িভাঙ্গা। বন্যার ব্যাপারে এই তিনটি গ্রাম নিয়ে একটা ছড়া আছে। ছড়াটি এমন: ‘হাঁড়িভাঙ্গা ডুবুডুবু সলপ গাঁও ভাসে/ সোনার কানসোনা মনে মনে হাসে’। অর্থাৎ কানসোনা গ্রামটি অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে হওয়ার গর্ব থেকেই ছড়াটি কেউ সৃষ্টি করেছিলেন বোঝা যায়। কিন্তু উঁচু স্থানের সেই গর্বটি কেমন? বন্যার সময় আমাদের ঘরের মেঝেতে জলের স্রোত বয়ে যেত। আমরা উঁচু চৌকিতে রাতে ঘুমাতাম। ভোরবেলায় ঘরের দরজা দিয়ে নৌকার গলুই চৌকি স্পর্শ করত, আর আমরা নৌকায় গিয়ে উঠতাম। প্রতিবছর এমন বন্যা হতো। এটাই ছিল স্বাভাবিক। রিলিফের জন্য কেউ হা-হুতাশ করত না। ফসলও বোনা হতো এই স্বাভাবিকতার কথা মাথায় রেখেই। বরং বন্যা না হলেই বিশেষ করে বোনা বা ছিটানো আমনের (যে আমন পানির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারত) ক্ষতি হতো। অর্থাৎ বর্ষায় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে মহিষ-গরুর গাড়ি হাঁকানোতেই অভ্যস্ত ছিল দেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষ।
ওই ষাটের দশকের শেষেই তৎকালীন ‘ওয়াপদা’ প্রথমে যমুনায় বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ শুরু করে। ধীরে ধীরে অন্যান্য নদ-নদীতেও অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। এরপর সত্তর দশকের প্রথমার্ধে উজানে ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণের মধ্য দিয়ে পানি প্রত্যাহার শুরু হয়। এতে নদ-নদীর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। অপরিকল্পিত রাস্তা নির্মাণও এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করে। নতুন এই পরিস্থিতিতে চাষবাসেও পরিবর্তন আসে। আগে যেসব নিচু জমিতে চাষ হতো না, সেসব জমিতে ফসল বুনতে শুরু করেন কৃষক। ফলে প্রতিবছর শুরু হয় বাঁধ ভেঙে ফসল ডোবার ঘটনা। এদিকে উজানে পানি প্রত্যাহারের কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় ভরাট হতে থাকে নদ-নদী।
৪০ থেকে ৪২ বছর ধরে চলে আসা নতুন এই অবস্থা স্বাভাবিক বন্যার ব্যাপারে মানুষকে কেবল অনভ্যস্তই করে তোলেনি, পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে সামান্য বৃষ্টিতেই যেকোনো অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা দেখা দিচ্ছে। দ্রুত পানি নামার উপায় না থাকায় হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে ফসল। এ বছর শেষ বর্ষায় উত্তরাঞ্চল ও উজানে কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে দ্রুত। নদীতে পানির ধারণক্ষমতা না থাকায় পানি ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের ফসলের খেতে। মাত্র কয়েক দিনেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক।
জীবনের প্রয়োজনেই আজ হাঁকাও গাড়ি চিলমারীর যুগে ফিরে যাওয়ার উপায় আমাদের নেই। তবে নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য ভারতের সঙ্গে যৌক্তিক পানি চুক্তির পাশাপাশি অবিলম্বে নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া না হলে বড় বিপর্যয় যে অনিবার্য, তা আগাম বলে দেওয়া যায়।
নাগেশ্বরী উপজেলা সদর থেকে মাত্র নয় কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ভারতের কোচবিহার সীমান্তে কাঁটাতারে ঝুলে ছিল সীমান্তরক্ষীর গুলিতে নিহত আমাদের ফেলানীর দেহ। ঘটনার বিচারের ওপর এখন আর আমাদের প্রত্যক্ষ কোনো হাত নেই। নাগেশ্বরীতে প্রবেশের আগে সকাল সাড়ে ১০টায় আমাদের গাড়ি কাউনিয়ায় তিস্তা সেতু অতিক্রম করে। কাজ শেষে ফেরার পথে তিস্তা সেতুতে আমরা আবার এলাম বিকেল সাড়ে চারটায়। মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানেই চোখে পড়ার মতো পানি কমেছে তিস্তায়। আরও বেশ কয়েকটি চর জেগে উঠেছে; হয়েছে ক্ষীণপ্রভা। ফেলানীর কথা মনে হলো। অন্যের ছোড়া ‘গুলিতে’ তিস্তাও আজ মৃত; ঝুলে আছে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায়।
মলয় ভৌমিক: অধ্যাপক, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়; নাট্যকার।