করোনার অভিঘাতে অধিকাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছে। বিনিয়োগ থমকে আছে। ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজগুলো থেকে অধিকাংশ মানুষ নিয়োজনকারী কারবারগুলো সুবিধা নিতে পারেনি। দ্বিতীয় ধাক্কা ব্যবসাগুলোকে বড় পীড়ন করেছে। ব্যবসা ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। অধিকাংশ মানুষ ধুঁকছে। মোট শ্রমজীবীর প্রায় ৮০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। মাত্র ৯০ লাখ মানুষ আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। এর মধ্যে মাত্র ১৫ লাখ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত। বাকি ৭৫ লাখ মানুষ বেসরকারি খাতে। অধিকাংশ মানুষই জীবিকার জন্য বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। আবার ব্যক্তি খাতের প্রতি তিনটি কর্মসংস্থানের দুটিরই ব্যবস্থা করে কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এ খাত ৩ কোটি ১২ লাখ মানুষের জীবিকার ব্যবস্থা করে।
অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থান ধরে রাখতে বাজেটে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তৈরির জন্য বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ আছে? শিল্প খাতের টেকসই পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে কি?
বাজেটীয় অনুমিতি
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কর কমানো ও অবকাশের মাধ্যমে কর্মসংস্থান ধরে রাখবেন এবং বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। সেকেলে এই তাত্ত্বিকতায় বিশ্বাস রেখে দুই অর্থবছর বড় সংঘবদ্ধ ব্যবসার জন্য করপোরেট হার কমানো হয়েছে। এবার কমানো হলো আড়াই শতাংশ। ফলে দুই বছরে করপোরেট কর কমেছে ৫ শতাংশ। কমেছে ব্যবসায়িক টার্নওভার করহার। বিনিয়োগ বাড়েনি। এ রকম পুরোনো কায়দায় বিশ্বের কোথাও কর্মসংস্থান ধরে রেখে বিনিয়োগ তৈরি হয়নি। বরং বিভিন্ন দেশে সরকারি ব্যয় সঠিক ব্যবহার করে মানুষের হাতে নগদ অর্থসহায়তা ও কারবারে অর্থ পৌঁছে দিয়ে সামষ্টিক চাহিদা বাড়ানো হয়েছে। বরং কর বাড়ানো হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে করপোরেট করহার ২৮ শতাংশ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
অধিকাংশ মানুষের কর্ম জোগানদারি কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের (সিএমএসএমই) খাতে আগে ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ বাস্তবায়নের ধীর অগ্রগতির কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে কোনো ব্যাখ্যা বাজেটে নেই। রপ্তানি পণ্য ও বাজারের বৈচিত্র্যকরণ, অঞ্চলভিত্তিক এবং খাতভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন করব্যবস্থা নিলে অর্থনীতির কাঠামোগত রূপান্তর করা যেত। নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হতো।
অন্যদিকে বাজেটে নতুন দরিদ্র মোকাবিলায় ‘চুইয়ে পড়া নীতির’ ওপর ভরসা করা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো সর্বজন খাতে প্রকৃত বরাদ্দ আগের চেয়ে কমেছে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে আগের বছরের চেয়ে বরাদ্দ ১৩ শতাংশ বাড়লেও মাথাপিছু ভাতার পরিমাণ বাড়েনি। উপরন্তু বরাদ্দকৃত অর্থের বেশির ভাগ অংশ সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ ইত্যাদি প্রদানে যাবে।
বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সামগ্রিক চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সম্প্রসারণশীল নীতি-কাঠামো নেওয়া হয়েছে। রাজস্ব নীতি ও মুদ্রানীতির মাধ্যমে ব্যক্তির হাতে এবং কারবারে সরাসরি নগদ অর্থ সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন দারিদ্র্য মোকাবিলা করতে হলে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প নেই।
কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত
প্রণোদনা অর্থের বেশির ভাগই পেয়েছে বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান। বড় প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারলেও কুটির, অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতে (সিএমএসএমই) ঋণপ্রবাহের অগ্রগতি ধীর। বারবার বিতরণের সময়সীমা বাড়ানো হলেও আশানুরূপ ঋণপ্রবাহ হয়নি। ২০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজে এখনো ৫ হাজার ৫৩৮ কোটি টাকা বিতরণ হয়নি। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এক টাকাও সরবরাহ হয়নি। ১০ হাজার কোটি টাকার পুনঃ অর্থায়ন তহবিলের কথা বলা হলেও তা নিয়ে এখনো নীতিমালাই প্রণয়ন করা যায়নি।
অধিকাংশ মানুষের কর্মসংস্থান ধরে রাখতে সিএমএসএমই খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়ানোর দরকার ছিল। কিন্তু এখানে অনেক বাধা রয়ে গেছে। প্রথমত, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে প্রমাণাদি ও নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন কাগজপত্র-দলিল, জামানত বা বন্ধকের প্রয়োজন হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিতদের এসব থাকে না বিধায় ঋণ নিতে পারে না। ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম দ্রুত চালু হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, বড়-ছোট নির্বিশেষে সবার জন্য ঋণের সুদ একই হারে নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যাংকগুলো সিএমএসএমই খাতে ঋণ দিতে উৎসাহ পায় না। কারণ, সুদের হার এক হওয়ায় ব্যাংকের তহবিল খরচ বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক প্রতিষ্ঠানকে এক শ কোটি টাকা ঋণ না দিয়ে বৃহৎ ১০টি প্রতিষ্ঠানকে একই পরিমাণ ঋণ দিলে ব্যাংকের খরচ কম হয়। অনেক বেশি প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে গেলে ব্যাংকের লভ্যাংশ কমে যায়। ব্যাংকের লভ্যাংশ এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সুদের হারে পরিবর্তন আনতে হবে, যেন ব্যাংকগুলো প্রাতিষ্ঠানিক খরচ বাবদ ১ বা ২ শতাংশ হারে লভ্যাংশ পায়। এই ফারাক রাজস্ব ব্যবস্থায় দেওয়া যেতে পারে।
রপ্তানিমুখী শিল্পের উৎপাদন ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্য
রপ্তানিপণ্য এবং বাজারের বৈচিত্র্য না থাকায় এবং এক শিল্পনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে করোনার অভিঘাত বেশি পড়েছে। রপ্তানি পণ্যের ৮৮ শতাংশই পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্য। আবার পোশাক ও টেক্সটাইল পণ্যেও বৈচিত্র্যের ঘাটতি রয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানির ৬৮ শতাংশ মাত্র ১০ রকম পোশাকে সীমাবদ্ধ। রপ্তানি বাজার পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত। বাজার এককেন্দ্রিক হওয়ায় রপ্তানিকারক দেশগুলোর অর্থনীতিতে যেকোনো অভিঘাত এলেই ক্রয়াদেশ কমে দ্বিতীয় ধাক্কার প্রথম কদিনেই ৫০টি বড় কারখানার অর্ডার ৩০ শতাংশ কমেছে। শুধু পশ্চিমা দেশ নয়, রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা বা জিএসপি আদায়ে জোর দিতে হবে। উৎপাদন ও রপ্তানিতে বৈচিত্র্যের পাশাপাশি শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতেও বিনিয়োগ করা দরকার। বাজেটে এ জন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
দেশব্যাপী উৎপাদন ও বিনিয়োগের নেটওয়ার্ক
গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের মূলে ছিল অভিবাসন। ছদ্মবেকার ও উননিয়োজিত শ্রমিক গ্রাম থেকে শহরে ও বিদেশে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন। এতে তাঁদের আয় বেড়ে ভোগ ব্যয় বেড়েছে, দারিদ্র্য কমেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং গ্রামীণ অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন দান করা জরুরি ছিল। প্রতিটি গ্রামকে একটি ‘বিকাশ কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তুলে সৃজনশীল পন্থায় প্রতিটি শহর ও গ্রামকেন্দ্রিক বিনিয়োগ ও উৎপাদন কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা দরকার। এ জন্য প্রণোদনা ও রাজস্ব বরাদ্দ দরকার হলেও বাজেটে তার ব্যবস্থা নেই।
বিনিয়োগের নতুন রাস্তা খুঁজতে হবে
শ্রমঘন শিল্পের ওপর জোর দিলে শ্রমবাজারে যোগ দেওয়া বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। স্বল্প সুদে ঋণ, উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ সাধনে প্রশিক্ষণ, শিল্পপার্ক স্থাপনে কার্যকর উদ্যোগ নিলে সম্প্রসারণ হবে। শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার ওপর জোর জরুরি। সমাজে সব পেশাকে সম্মানের চোখে দেখার মূল্যবোধ তৈরি করা যায়নি বিধায় কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষায় আগ্রহ কম।
অধিকন্তু বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবশ্যই ভোক্তার চাহিদাভিত্তিক বাণিজ্যের ওপর জোর দিতে হবে। যেসব দেশে ভোক্তাদের চাহিদা বেশি, সেসব দেশের উৎপাদন, প্রযুক্তি ও আর্থিক নেটওয়ার্কে নিজেদের সংযুক্ত করতে হবে। বাণিজ্য বৃদ্ধি পেলে দেশের আয়ও বেশি হবে।
বাজেট ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বাজেট সম্পর্কিত সব তথ্য-উপাত্ত গরমিল দূরীকরণ ও প্রাপ্তি সহজ করা প্রয়োজন। বাজেট ব্যবস্থাপনায় গণতন্ত্রায়ণ দরকার। তর্কবিতর্ক ও পরিবর্তনের সুযোগ না থাকায় বাজেটে প্রতিবারই স্বজনতোষণ, সম্পদের গোষ্ঠীতান্ত্রিক কেন্দ্রীভবন প্রাধান্য পায়। অতিমারি জীবন, জীবিকা ও অর্থনীতির যে অভূতপূর্ব ক্ষতি করেছে, বাজেটে তা থেকে উত্তরণে পর্যাপ্ত রূপরেখা এ কারণেই অনুপস্থিত।
● ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন
সাম্প্রতিক বই: যুদ্ধোত্তর থেকে করোনাকাল: বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক অর্থনীতি, প্রথমা প্রকাশন