ভারতের জন্য রাজনৈতিক বিতর্ক অভিনব কোনো বিষয় নয়। নানা দল ও মতে বিভাজিত ভারতের জনসমাজে সব সময় অর্ধডজন বিতর্ক চলমান থাকে। তবে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে যে অপ্রীতিকর বিতর্ক এখন চলছে, তেমনটা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি।
ভারতে কোভিড মহামারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে ২০২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসে মহামারির দ্বিতীয় দফা আঘাতটি ছিল মারাত্মক। সে সময়ে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত অসংখ্য মানুষ হাসপাতালের অপেক্ষমাণ কক্ষে কিংবা গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গায় মারা যান। মেডিকেল অক্সিজেনের অভাবে অনেক মানুষ তাঁদের বাসাবাড়িতেও মারা যান। দিনের পর দিন গঙ্গা নদীর তীরজুড়ে সারি সারি চিতা জ্বলে উঠেছিল, আর ধোঁয়ায় পুরো আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক গরিব মানুষের শেষকৃত্য করার মতো অর্থ ছিল না। তাঁরা তাদের প্রিয়জনদের মরদেহ কাঁধে করে বয়ে নিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
একটি বিপর্যয়কর মহামারিতে মৃত্যুর এই প্রত্যক্ষ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ভারতের সরকারি দপ্তর সম্পূর্ণ ভিন্ন তথ্য দিয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে শুরু করে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার জানিয়েছে, কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা ৫ লাখের কিছুটা বেশি। সরকারিভাবে মৃত্যুর এ সংখ্যা নিয়ে অনেক সাংবাদিক সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কেননা কোভিডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য রাজ্য সরকারগুলো ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে তালিকা করেছে, সে সংখ্যা সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যার চেয়ে বেশি। যুক্তরাজ্যের ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতে মৃতের সংখ্যার বড় অংশটা গণনার আওতায় আসেনি। কিন্তু ভারত সরকার নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভারতের পরিসংখ্যান একসময় আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। লজ্জার বিষয় হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যানে এখন সরকারের পছন্দের বয়ান প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারতে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর তথ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় সন্দেহ ছিল। এর মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভারতকে এমন সব দেশের কাতারে ফেলল, যে দেশগুলোর সরকারি পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য নয়।
এ মাসের প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিস্ফোরক এক প্রতিবেদন কোভিডে মৃত্যু নিয়ে ভারত সরকারের দাবিটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মৃতের সংখ্যা গণনার জন্য ‘এক্সেস ডেথস’ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছে। একই এলাকায় মহামারির আগের ও পরের মৃত্যুর হারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯-এ ভারতে ৪৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সরকারি হিসাবের চেয়ে মৃতের সংখ্যা ১০ গুণ বেশি। এ সংখ্যা মহামারিতে বৈশ্বিক যে মোট মৃত্যু (দেড় কোটি), তার তিন ভাগের এক ভাগ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন যথারীতি প্রত্যাখ্যান করেছে ভারত সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গণনার পদ্ধতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রকৃত পক্ষে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা কম দেখিয়ে সরকার একটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিতে চাইছে। সেটি হলো, মহামারি ব্যবস্থাপনায় সরকার যে ব্যর্থ হয়েছে, সেটার বিপরীত বয়ান দাঁড় করানো।
ভারত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। মহামারির প্রথম বছরে সংস্থাটির নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এ বিবেচনায় প্রতিবেদনটি সম্পর্কে যে ধারণা করা নিরাপদ হবে, সেটি হলো জাতিসংঘের সংস্থা হিসাবে এর কোনো নেতৃত্ব প্রদানকারী সদস্যরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের অভিপ্রায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নেই। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা বের করা জরুরি, কেননা ভবিষ্যৎ মহামারি মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে এটি সহায়তা করবে। এ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সংবেদনশীলতা মেনে চলতে বাধ্য। ভারতে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে করা অন্যান্য হিসাব ও জরিপে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রায় একই ফলাফল (৩০-৫০ লাখ) পাওয়া যায়।
এখানে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য এ-ও ইঙ্গিত করছে যে মহামারি মোকাবিলায় ভারত অন্য দেশের তুলনায় খারাপ করেনি। নিশ্চিত শনাক্ত হওয়া রোগীর বিপরীতে (বৈশ্বিক বিবেচনায় সপ্তম) ভারতে মৃত্যুহার ১ দশমিক ২ শতাংশ। প্রতি ১০ লাখে মৃত্যুর বিবেচনায় ভারত শীর্ষ ১০০ দেশের মধ্যে নেই। এটা সত্য যে ভারতে শনাক্ত হওয়া রোগীর তুলনায় শনাক্ত না হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। সে বিবেচনায় প্রকৃত মৃত্যুর হার কম। ভারতের যে বিপুল জনসংখ্যা, সে তুলনায় কোভিডে প্রকৃত মৃতের সংখ্যা কি খুব বেশি?
কোভিড মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যে তথ্য, সেটা গ্রহণ করা এবং সেটাকে ভালো খবর বলে বিবেচনা করাটাই মোদি সরকারের জন্য উত্তম হতো। এর বদলে সেই তথ্য নিয়ে অযথা বিতর্কে জড়ানো আন্তর্জাতিক পরিসরে ভারতের জন্য প্রীতিকর কিছু হচ্ছে না। বিশ্বের মহামারি বিশেষজ্ঞরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। যে পদ্ধতিতে তাঁরা এটা তৈরি করেছেন, সেটা সুপ্রতিষ্ঠিত একটা পদ্ধতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ জানানোর মধ্য দিয়ে বরং ভারতের নাগরিক নিবন্ধন ব্যবস্থার দুর্বলতা, সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য নথিভুক্ত করার দুর্বলতা এবং সরকারি পরিসংখ্যানের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে বড় প্রশ্ন তৈরি করছে।
ভারতের স্বীকার করে নেওয়া উচিত যে ২০২০ সালে মহামারির প্রথম ধাক্কার সরকার চীনা ধরনের কঠোর যে লকডাউন (বিধিনিষেধ) আরোপ করেছিল, তাতে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বিকল হয়ে গিয়েছিল। শুধু কোভিড সংক্রমণ ও মৃত্যুর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছিল। মাঠপর্যায়ে জরিপ সে সময়ে করা যায়নি।
পরিসংখ্যান তৈরির জন্য পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করাও সম্ভব হয়নি। মহামারির দ্বিতীয় ধাক্কায় লকডাউনের ধরন বদল করা হলেও সেবারও সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিবেদনটির পাদটীকায় ব্যাখ্যা দিয়েছে কেন ভারতের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নির্ণয় করতে গিয়ে ‘এক্সেস ডেথস’ পদ্ধতির প্রয়োগ করেছে, সেখানে ওপরের কারণগুলোর কথায় বলা হয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে ভারতের পরিসংখ্যান একসময় আদর্শ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। লজ্জার বিষয় হচ্ছে, সেই পরিসংখ্যানে এখন সরকারের পছন্দের বয়ান প্রতিফলিত হচ্ছে। ভারতে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর তথ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে বড় সন্দেহ ছিল। এর মধ্যেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভারতকে এমন সব দেশের কাতারে ফেলল, যে দেশগুলোর সরকারি পরিসংখ্যান নির্ভরযোগ্য নয়।
জীবন ও মৃত্যু মতামতের বিষয় নয়।। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা যেকোনো দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিপর্যয়ের মাত্রা অনুধাবন, মৃত ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, জীবিত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং ভবিষ্যতের জনস্বাস্থ্যসংকট মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার—সেসব ক্ষেত্রে মৃতের সংখ্যা নির্ণয় জরুরি। নিজেদের ভাবমূর্তি উদ্ধারে ভারতকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার এই কদর্য প্রচেষ্টা মোদি সরকার আবারও করল।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: মনোজ দে
• শশী থারুর জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব এবং ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। বর্তমানে ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি