করোনায় বাড়তি মৃত্যু থেকে আমরা কী শিক্ষা নেব

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব বলছে, করোনা মহামারি শুরুর পর থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে করোনায় ১ কোটি ৪৯ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে সংস্থাটির দাপ্তরিক তথ্য অনুযায়ী, করোনায় আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে ৫৪ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নতুন হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, মোট মৃত্যুর সংখ্যা দেশগুলোর সরকারের প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় ২ দশমিক ৭ গুণ বেশি।

নতুন এ তথ্য অনুযায়ী, করোনায় ভারতেই মৃত্যু ঘটেছে ৪৭ লাখ মানুষের। দেশটির সরকারিভাবে প্রকাশিত করোনায় মৃত্যুর হিসাবের চেয়ে এ সংখ্যা ১০ গুণ বেশি, যা বিশ্বে করোনায় মোট মৃত্যুর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশে এ সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় ব্যবহার করা পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাড়তি মৃত্যু’ (এক্সেস ডেথ)। এ পদ্ধতিতে করোনা মহামারির আগে কোনো অঞ্চল বা দেশের প্রত্যাশিত মৃত্যুর চেয়ে মহামারি শুরুর পর কী পরিমাণ বেশি মৃত্যু হয়েছে, তা সরকারিভাবে দেওয়া তথ্য ও স্থানীয়ভাবে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে খতিয়ে দেখা হয়েছে। একই সঙ্গে পরিসংখ্যানের বিভিন্ন মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ, অনেক দেশই করোনায় মৃত্যুর হিসাব সঠিকভাবে সংগ্রহ করেনি বা রাখেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তা প্রাসঙ্গিক।

বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশে করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ২৯ হাজার ১২৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে করোনায় মৃত মানুষের সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৭২। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশে মৃত্যুর এ সংখ্যা অন্তত ১ লাখ ৪০ হাজার ৪৬৪। সরকার বলেছে, আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নিশ্চিতের ভিত্তিতে করোনায় মৃত্যুর তথ্য প্রদান করেছে। তবে এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, দেশে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়নি—এমন অনেকেরও করোনায় মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর এ সংখ্যা ও হার পরিমাপে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) যথেষ্ট কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বিবিএস প্রকাশিত (২০২১) ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’–এর তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে স্থূল মৃত্যুহার ছিল ৫ দশমিক ১ (প্রতি হাজার জনসংখ্যায়)। ২০১৯ সালে তা ছিল ৪ দশমিক ৯। এক বছরে স্থূল মৃত্যুহার বেড়েছে।

বিবিএসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১৬ কোটি ৯১ লাখ। ফলে এ সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে পরিমাপ করলে বাংলাদেশে ২০২০ সালে ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি মৃত্যু ঘটেছে ৪৬ হাজার ১১৬ জনের মতো। তবে এ বাড়তি মৃত্যু করোনার কারণে কি না, তা বলার মতো কোনো তথ্য রিপোর্টে নেই! সংখ্যাটি কেবল হিসাব করে বের করা। ফলে, করোনার মতো অনেক বিষয়েই আমাদের দরকার নির্ভরযোগ্য ও সময়োপযোগী উপাত্ত। এখন ২০২২ সালের মে মাস চলছে অথচ বিবিএসের ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২১’ প্রকাশিত হয়নি। আগের রিপোর্টে রোগ–সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক শ্রেণীকরণ ব্যবহার ও কোভিড-১৯–সংক্রান্ত তথ্য থাকা উচিত ছিল, অথচ তা রাখা হয়নি। ২০২১ সালে জনশুমারি ও গৃহগণনা হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা এখনো সরকার করতে পারেনি। নতুন জনশুমারি হলে তা থেকে স্থূল মৃত্যুহার সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যেত। সময়োপযোগী ও নির্ভরযোগ্য উপাত্ত তৈরিতে বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

আরও পড়ুন
শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই (বিশেষ করে উন্নয়নশীল) লক্ষ করা গেছে, মহামারি-পূর্ব ও মহামারিকালে মৃত্যুর নিবন্ধন ঠিকমতো করা হয়নি। ফলে করোনায় যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের সঠিক হিসাব সরকারগুলো দিতে পারেনি। পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় মৃত মানুষের সংখ্যা সরকারিভাবে কম দেখানো হয়েছে বলেও মনে করা হয়।

শুধু বাংলাদেশ নয়, অনেক দেশেই (বিশেষ করে উন্নয়নশীল) লক্ষ করা গেছে, মহামারি-পূর্ব ও মহামারিকালে মৃত্যুর নিবন্ধন ঠিকমতো করা হয়নি। ফলে করোনায় যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের সঠিক হিসাব সরকারগুলো দিতে পারেনি। পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় মৃত মানুষের সংখ্যা সরকারিভাবে কম দেখানো হয়েছে বলেও মনে করা হয়। ফলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্টে মূলত ‘বাড়তি মৃত্যু’ ঘটেছে সরাসরি কোভিড-১৯ এবং অতিমারির পরোক্ষ প্রভাবের কারণে। করোনা অতিমারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর করোনাভাইরাসে সংক্রমিত না হওয়া রোগীরা স্বাস্থ্যসেবা পেতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কিংবা সেবা পাননি। এ কারণে যাঁদের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের মৃত্যুর কারণ মূলত অতিমারির পরোক্ষ প্রভাব। এ ছাড়া অতিমারির সময় যেসব মৃত্যু এড়ানো যেত, সেসব মৃত্যুও এতে যোগ করা হয়েছে। যেমন যোগ হয়েছে বিধিনিষেধের সময় ট্রাফিক (সড়ক দুর্ঘটনা) কিংবা ভ্রমণে হওয়া মৃত্যু। ফলে বাড়তি এ মৃত্যুর পরিমাপ প্রক্ষেপণে ব্যবহৃত পরিসংখ্যানজনিত মডেলের ব্যাপারে কারও আপত্তি থাকলেও এ তথ্য আমাদের মহামারির সত্যিকার প্রভাবকে বুঝতে সহায়তা করে।

এখনো বিশ্বের অনেক দেশেরই নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান নেই। একবিংশ শতকের এ সময়ে এসেও মৃত্যুর কারণ নিয়ে পরিসংখ্যান তথ্য সংগ্রহ করে না—এ রকম দেশ আছে বিশ্বে ৭০টির মতো। তবে আফ্রিকা মহাদেশেই এ সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ফলে এ সীমাবদ্ধতা পূরণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে পরিমাপ প্রাক্কলনে তুলনাযোগ্য একটি উদ্ভাবনী পরিসংখ্যান মডেলের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।

বাড়তি মৃত্যু পরিমাপের আগে মহামারির আগে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১০টি মৃত্যুর ৬টি মৃত্যুর নিবন্ধন হয়নি। বাড়তি মৃত্যুর এ তথ্য উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় দাপ্তরিক তথ্যের কাছাকাছি থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে তা বিপরীত। বাড়তি মৃত্যু নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ রিপোর্ট থেকে আমাদের বাংলাদেশকে কী শিক্ষা নিতে হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারকে কঠোর নিয়ম ও অধিকতর স্বচ্ছতার ভিত্তিতে হালনাগাদ তথ্য প্রদান করতে হবে এবং স্বাস্থ্য তথ্যের রিপোর্টিংয়ের মান বাড়াতে হবে। সুরক্ষাহীন বা ভালনারেবল জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের স্বাস্থ্য-পরিচর্যা কর্মসূচির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, বিশেষ করে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা যেন কোনো অবস্থাতেই বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। পাশাপাশি শক্তিশালী স্বাস্থ্যতথ্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত ও বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের আলোকে এ মহামারিতে কতজন মারা গেলেন, এ তথ্য জানার মধ্য দিয়ে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য অধিকতর ভালো প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সঙ্গে এ ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।

ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক

[email protected]

আরও পড়ুন