দুই দশকে দেশে উল্লেখযোগ্য হারে দারিদ্র্য কমেছিল। তবে করোনাকালে নতুন করে দরিদ্রের কাতারে যোগ হয়েছে অনেক মানুষ। পিপিআরসি ও ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা জরিপ বলছে, করোনার এক বছরে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, সংখ্যায় তা প্রায় ২ কোটি ৪৫ লাখ।
করোনার আগে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমে সাড়ে তিন কোটিতে নেমে এসেছিল। সংস্থা দুটির প্রাক্কলন বিবেচনায় নিলে এখন দরিদ্রের সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি। যদিও এটি প্রকৃত অর্থে গবেষণা নয়, বরং জরিপটি টেলিফোনে করা বলে প্রকৃত সংখ্যাটি নিয়েও সন্দেহ থাকতে পারে, তবে করোনাকালে দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল এমনকি ক্ষুদ্র আয়ের জনগোষ্ঠী যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট অনেকাংশে বন্ধ। এতে অর্থনীতি, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মসংস্থানে বড় ধরনের ধস দৃশ্যমান। এ অবস্থায় অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কায় দারিদ্র্য হার আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যের কোটায় অন্তর্ভুক্তি দারিদ্র্য বিমোচনের ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
করোনাকালে দারিদ্র্য হার দ্রুত বাড়ার প্রধান কারণ মানুষের কর্মহীনতা ও আয় হ্রাস। গত বছর করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রায় আড়াই মাস সাধারণ ছুটি ছিল। ওই সময় কৃষি খাতে শস্য উৎপাদন, সংগ্রহ ও সামাজিক দূরত্ব মেনে বিপণন ছাড়া অন্য প্রায় সব খাতের কার্যক্রম বন্ধ থাকে।
গণপরিবহন, হোটেল, রেস্তোরাঁ, ট্যুরিজমসহ বন্ধ হয়ে পড়ে জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা সেবা খাত। বন্ধ থাকে কাঁচাবাজার, ওষুধ ও নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের দোকান বা বাজার। এর অভিঘাত পড়ে অনানুষ্ঠানিক খাতে।
ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী কাজ হারায়। পরে সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও অনেকেই আর কাজে ফিরতে পারেনি। অন্যদিকে বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে অনেকের আয় বাড়েনি। ফলে তাদের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। চলমান লকডাউনেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু বন্ধ থাকায় শ্রমজীবীদের বড় অংশেরই কাজ নেই। এতে দারিদ্র্য যে আরও বাড়বে, তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় যথাযথ তালিকা করে দরিদ্রদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসুচি জোরদার করাটা জরুরি।
করোনার আঘাত সব জায়গায় একইভাবে অনুভূত হয়নি। শহরের তুলনায় গ্রামে অতিমারির প্রভাব বেশ কমই দেখা গেছে। জাকাত প্রদানের জন্য প্রকৃত গরিব খুঁজতে গিয়ে জানতে পারলাম, গ্রামে এখন প্রকৃত গরিব পাওয়া খুবই কঠিন। অন্তত আমাদের কুমিল্লার গ্রামাঞ্চলে।
অন্যদিকে ব্র্যাকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক জরিপ দেখিয়েছে, শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত। বস্তিবাসী করোনার আগে যে আয় করত, এখনো সে অবস্থায় ফিরতে পারেনি। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ১৪ শতাংশ কম আয় হচ্ছে। সংগত কারণে তাদের জীবনমান বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
অথচ গ্রামাঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচনে সরকারের বরাদ্দ যেমন বেশি, তেমনি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোও সেখানে অনেক বেশি সক্রিয়। তুলনায় শহরাঞ্চলে তাদের কার্যক্রম খুবই সীমিত। সরকার অন্যান্য ক্ষেত্রে শহরকে অগ্রাধিকার দিলেও দরিদ্রদের সহায়তায় এখনো উদাসীন। এ প্রবণতার পরিবর্তন প্রয়োজন। দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলের পুনর্বিন্যাস করার সময় এসেছে। নগর দারিদ্র্যকে উপেক্ষার সুযোগ আর নেই। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন নীতির অগ্রাধিকারেও পরিবর্তন আনতে হবে। শহরের দারিদ্র্য কমাতে হলে অবিলম্বে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী শুধু বাড়ানো নয়, তাতে অভিনবত্ব আনতে হবে। একই সঙ্গে উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রমও জোরদার করতে হবে। সনাতনী চিন্তা ও গতানুগতিক দারিদ্র্য কৌশল থেকে তাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।
করোনাসৃষ্ট দারিদ্র্য মোকাবিলায় সামাজিক সুরক্ষায় বিরাজমান ঘাটতিগুলোও দূর করা প্রয়োজন। নতুন মাত্রাগুলো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী, সুচিন্তিত পদক্ষেপ নিতে হবে। বাড়াতে হবে নগদ সহায়তা। সরকার এরই মধ্যে ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে আড়াই হাজার টাকা করে সহায়তার পদক্ষেপ নিয়েছে। ইতিমধ্যে অনেকে এটি পেয়েও গিয়েছে। ব্যক্তির মোবাইল হিসাবের মাধ্যমে এটা দেওয়ার কথা।
এ ক্ষেত্রে সুফলভোগীর তালিকা থেকে বিতরণের সব পর্যায়ে আগের ত্রুটির পুনরাবৃত্তি রোধ ও স্বচ্ছতা আনতে হবে। করোনাকালীন সহায়তার ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দেশটি একটি হটলাইন নম্বর চালু করেছে। সাহায্যপ্রার্থী যে কেউ সেখানে ফোন করতে পারে। প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে কর্মীরা তাদের নাম অনলাইনে নিবন্ধন করে নেন। এতে তালিকা তৈরি ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় আসে স্বচ্ছতা। আমাদের দেশেও এটা অনুসরণ করা যেতে পারে। এটুআই (এক্সেস টু ইনফরমেশন)সহ অন্যান্য কিছু প্রকল্প এ কাজে লাগানো যায়।
পাশাপাশি বিশেষায়িত কর্মসূচি নিতে হবে। টোকেন কর্মসূচি নয়। নতুন আড়াই কোটি দরিদ্রকে অন্তর্ভুক্ত করে দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সাজাতে হবে। কুটির, ক্ষুদ্র ও এসএমই খাতে প্রণোদনা বাস্তবায়নের পন্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। করোনা-পরবর্তী শ্রমবাজার পুনরুদ্ধারের কথাও ভাবতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সামাজিক সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ। যেসব দেশ এ রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তাদের পন্থা পর্যালোচনা করতে হবে। মোদ্দাকথা, করোনা সংক্রমণ রোধের পাশাপাশি অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান উন্নয়নের বিষয়টিও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের ভাবনায় রাখা চাই।
সেই সঙ্গে ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের কার্যকর সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে কর্মসৃজন এবং অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে প্রণোদনা সৃষ্টির বিষয়টিকেও অবহেলা করলে হবে না। তা করতে পারলেই দারিদ্র্য হ্রাসে আমরা অতীতে যে নৈপুণ্য দেখিয়েছি করোনা পরবর্তীকালে আবার তা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ সৃজনে সরকারি, বেসরকারি এবং ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে আবার একযোগে কাজে নেমে পড়তে হবে।
মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক