করোনায় অর্থনৈতিক মুক্তাঞ্চল হতে পারে গ্রাম

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

সাদা চোখে কোথায় করোনার সময়ে মানুষ বেশি স্বস্তিতে আছে: গ্রাম না শহর, রাজধানী না মফস্বল? বেশির ভাগ মানুষই মনে করে, গ্রাম বেশি নিরাপদ। করোনা নিয়ে আতঙ্কের শুরুতেই লাখে লাখে খেটে খাওয়া মানুষ গ্রামে ফিরে গেছেন। লকডাউনের মধ্যে ড্রামে লুকিয়েও বাড়ি গেছেন তাঁরা। যেন ঢাকাই আতঙ্ক, ঢাকা ত্যাগ করাই যেন করোনার প্রাথমিক উপায়। কী শহর বানালাম আমরা, এ ঘটনা তা দেখাল।

করোনার সময়ে শহরে খাদ্য ও চিকিৎসা এবং বাড়িভাড়ার সুরাহা যখন নেই, তখন গ্রামে ফেরার ওই সিদ্ধান্ত বেঠিক বলা যায় না। অভাব সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ করোনার মধ্যে কম আতঙ্কে আছেন।

ভারতেও লাখো মজুর শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে, পায়ে হেঁটে, দুর্গম পথে বাড়ি ফিরেছেন। সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যাচ্ছে, তাঁদের অনেকেই গ্রামে কষ্ট করবেন, কিন্তু ওই সব বড় বড় শহরে ফিরবেন না। বিহারের যাদব নামের একজনের কথা: ‘তারা আমাকে ছুড়ে ফেলেছে, যদি না খেয়েও মরি বরং নিজের গ্রামে মরব, যারা তুচ্ছ করেছে তাদের শহরে ফিরব না।’ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেই এই অবস্থা। শহর নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না মহামারি ও ক্ষুধা থেকে।

গ্রামে সম্পদ নেই, সম্পদ সব শহরে জমা। অথচ সেই শহর ছেড়ে মানুষ গিয়েছে গ্রামে, করোনার তাড়া চলতে থাকলে আরও অনেকে যাবে। প্রতিবার তা-ই যায়। কিছু আছে ঈদের যাওয়া, আর কিছু আছে তাড়া খেয়ে ‘দেশে ফেরা’।

১৯৭১-এও এভাবে শহর বিরান হয়েছিল। গ্রাম তাদের খাইয়েছিল শুধু নয়, সংসার ও কৃষিকাজ টিকিয়ে রেখে, ফসলের প্রতিটি দানা, প্রতিটি সবজির লতা বাঁচিয়ে যুদ্ধের মধ্যেও দেশটাকে টিকিয়ে রেখেছিল। শহরের লোক গ্রামে পালাতে পারেন, কিন্তু কৃষকের কোথাও পালানোর নেই। মাটি কামড়ে তাঁকে ফসল ফলাতে হবেই। আমাদের মতো দেশে এটা এক বিরাট ভরসা। এবার অন্তত ৫০ লাখ মানুষ গ্রামে চলে গেছেন। ক্যামেরাগুলো সব শহরের ওপর, এত বড় ‘এক্সোডাসের’ পর গ্রামের কী হাল, সেই খবর কম। এত বিপুল মানুষকে গ্রামগুলো ‘অ্যাবসর্ব’ করে নিল, ভেতরে নিয়ে নিল, সেটা খুবই খেয়াল করার দিক। দুই মাস হতে চলল, এখন পর্যন্ত শহরের চেয়ে গ্রামে অভাবের কঠিন পীড়ন কম। করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার গ্রামে কম। আইসোলেশন-কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থাও বন্দিত্বের মতো করে করতে হয় না। গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে, অর্থনীতি বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে।

এই সব কিছুর কারণ কী? গ্রামে সমাজ আছে, নিজের এলাকাবোধের আত্মবিশ্বাস সেখানে কাজ করে। কিন্তু সেটাইবা কেন হয়? এই সব কিছুরই গোড়ার কারণ কৃষি। এই কৃষি মানে ধান, ধান মানে বিরাট রহমত, বিরাট শক্তি, বিরাট অর্থনৈতিক ভিত।

পোশাকশিল্পের বৈদেশিক অর্ডার কিংবা রেমিটেন্সের প্রবাহ ঠিক থাকবে না সামনের বছরগুলোতে। এই দুর্দিনে কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনই হলো একমাত্র ক্ষেত্র, যা আমাদের হাতে আছে। করোনা-পরবর্তী নতুন অর্থনীতিতে খাদ্য থাকবে আমাদের মতো দেশের বড় পুঁজি। এর সদ্ব্যবহার করলে ভবিষ্যতের অনুরূপ সংকটে অন্তত একটা ফ্রন্টে জয়ী থাকা যাবে।

শহর আমরা বানাইনি কখনো। শহরবাসীদের ৯০ শতাংশ এক পুরুষ আগে গ্রামের কৃষি খাতেই নিয়োজিত ছিলেন। এখনকার নগুরে জনগোষ্ঠীর বড় অংশটার পেছনে গ্রাম-সম্পর্ক উঁকি দেয়। বসবাসের বড় শহর আমরা কখনো বানাইনি। ঢাকা-কলকাতা মোগল ও ইংরেজের বানানো। আর সেই শহর এমন শহর, তাতে না আছে পাশ্চাত্যের নাগরিক সুবিধা, না তা আমাদের দেশের সমাজ-অর্থনীতির জন্য উপযোগী। এ ধরনের প্রতিকূল শহরে বসবাসের কায়দা গত ১০০ বছরেও রপ্ত হয়নি আমাদের। মুষ্টিমেয় লোকের বিপুল সম্পদ ঘিরে বিপুল দরিদ্রের অস্থায়ী পুঞ্জীভবনকে সিটি বা নগর বলা যায় না। এই নগর শ্রমিক ও পেশাজীবীর জন্য তৈরি হয়নি, এটা বড়লোকদের জন্যও তৈরি হয়নি। গরিবেরা গ্রামে আর বড়লোকেরা বিদেশে—বিপদে এই ছিল রাস্তা। গ্রামের রাস্তা এখনো খোলা, বিদেশের রাস্তা আপাতত বন্ধ শুধু নয়, সহসাই তা আগের মতো খোলা হবে বলে মনে হয় না।

করোনার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে যদি মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ হয় বা অর্ধেকও যদি ফিরে আসে; এই শহর সেটাও নিতে পারবে না। মাত্র কয়েক শ প্রবাসীকে নিয়েই হিমশিম খাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের করোনাকাহিনি।

গ্রামের ‘বাড়ি’ ছাড়া আর সবই যে ‘বাসা’ ছিল অধিকাংশ মানুষের, সেটা এই করোনার ক্রান্তিতে হাড়ে হাড়ে বোঝা যাচ্ছে। ঢাকা এক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ। বিপদের দিনে মানুষ যেখানে ফিরে যায় সেটা তার উৎস, সেটা তার ‘হোম’, সেটা তার গ্রাম। ঢাকা এক ভাড়াজীবী শহর, বেশির ভাগ লোক এখানে ভাড়াটে, উন্মূল। বাসস্থানের অধিকারের সঙ্গে বিপুল আপস করে থাকতে হয় এখানে। যার যার ফ্ল্যাটে সবাই এখানে একা। করোনার সময়ে শহর কোনো ভরসা হতে পারেনি।

এই শহর নিজেকে রক্ষার ব্যাপারেও উদাসীন। করোনার শুরুর দিকে প্রবাসীদের আসার সময় সেটা স্পষ্ট হয়েছে আরও। গ্রাম-মফস্বলের কোনো যুবক প্রবাস থেকে বাড়ি যেতে গেলে ঢাকার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, এটা তো তার দোষ নয়। এটা ঢাকার ব্যবস্থা, ঢাকা নিজের স্বার্থেই করবে। তা ছাড়া ঢাকা রাজধানী এবং সরকারের সরাসরি কেন্দ্র।

দ্বিতীয়ত, পোশাক কারখানা খোলা হবে কি না, তা নিয়ে বুদ্ধিবিভ্রাটের শিকার হলেন হাজারো শ্রমিক। পোশাক কারখানার মালিকেরা শোডাউন করলেন দুবার!

ঢাকা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিকভাবে যা-ই হোক, বসবাসের জায়গা হিসেবে অযোগ্যতার বিশ্ব রেকর্ডধারী শহর। এ বিষয়ে ঢাকাবাসীর সন্দেহ কম। তাঁরা তো ভুক্তভোগী। কিন্তু এই লকডাউনে হারানো ঢাকার জন্য মন নিশ্চয় পোড়ে। সেই অচল যানজট, জলাবদ্ধতা, ডেঙ্গু উপদ্রুত ঢাকা, পরিচিত ঢাকাই ন্যুনতম চাওয়া। সেই স্বাভাবিকতার অর্ধেকের জন্যও রাজি আছেন অনেক মানুষ।

ঢাকা সচল না হলে দেশ সচল হবে না। যত দ্রুত সম্ভব ঢাকা আংশিক হলেও সচল হোক, এটা সবাই চায়। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের কী হবে? দীর্ঘমেয়াদের ব্যবস্থা না করে স্বল্পমেয়াদের জোড়াতালি বারবার কাজে দেবে না।

২.
গত শতকের সত্তরের দশকে জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ই এফ শুমাখার ‘স্মল ইজ বিউটিফুল’ নামে উন্নত ও টেকসই অর্থনীতির মডেলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। একমাত্র না হলেও বাংলাদেশের জন্য এখন গ্রাম ও শহরে কৃষিকেন্দ্রিক এবং অন্যান্য ছোট শিল্প বিকল্প দিতে পারে। আগামী বাজেটে কৃষি ও গ্রামনির্ভর ছোট ছোট শিল্পের সহায়তার ব্যবস্থা তাই থাকা দরকার। গ্রাম ও ছোট ছোট শহরে অজস্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগ, উৎপাদন, কেন্দ্র তৈরিতে এখন সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা শুরু করা দরকার।

কম সুদে, সরকারি সুবিধাসংবলিত ঋণ দিতে হবে। ওই ঋণে তৈরি প্রতিষ্ঠানের কর হ্রাসসহ অন্যান্য সুবিধা লাগবে। ভর্তুকির টাকা আসবে অপ্রয়োজনীয় খাতে কর বাড়িয়ে। পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। একে কাজে লাগানো যায়।

কৃষি ও নগরায়নের নয়া ধারণা নিয়ে অনেকে কথা বলে আসছেন। তাঁদের হুঁশিয়ারি কানে না দেওয়ার কুফল কি এখন টের পাওয়া যাচ্ছে না? এই নয়া কৃষি মানে গ্রাম নয় শুধু, শহরকেও নতুনভাবে উপযোগী করা, যাতে মহামারি ও যুদ্ধে সে শহর খাঁ খাঁ না করে। শহর শুধু ব্যবসা ও কারখানার জায়গা হয়ে থাকবে নাকি বসবাসের জায়গা হবে, সেই ফয়সালা ছাড়া এগোনোর উপায় আসলেই নেই। করোনায় এবং তার পরের সময়ে অর্থনৈতিক মুক্তাঞ্চল হতে পারে গ্রাম।

ফারুক ওয়াসিফ: প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ও লেখক।
[email protected]