করোনার সংকটে ইউরোপীয় ঐক্য
করোনার সংকট নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর এখন নাজেহাল অবস্থা। বেশি করে দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলো করোনা সংকটে একেবারে দিশেহারা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বজুড়েই অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোয় এই সংকট থেকে থেকে পরিত্রাণের উপায় নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে ইইউ সদস্যভুক্ত দেশগুলোয় নানা রকম বিতর্ক হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণের বিষয়ে ঐকমত্য সৃষ্টি হয়েছে। করোনা সংকট থেকে উদ্ধার পেতে সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকলেও ইউরোপে মানবিক দূরত্ব আরও নৈকট্য হয়েছে।
গত ২৩ মার্চ বৃহস্পতিবার ইইউর ২৭ দেশের সরকারপ্রধানদের চার ঘণ্টার ভিডিও বৈঠকের পর ৫৪ হাজার কোটি ইউরোর অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। করোনাভাইরাস–জনিত সংকট থেকে উদ্ধারের প্রশ্নে এর আগে ইউরোপীয় নেতারা চারবার এই ধরনের বৈঠক করলেও তাঁরা অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের বিষয় নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এ ধরনের মানবিক সংকটের মুখে ইতালি ও স্পেনে ক্রমেই ইইউ জোটের অকার্যকারিতা এবং সংহতির প্রশ্নে অন্য দেশগুলোর দ্বিধায় হতাশা তৈরি হয়েছিল। ইউরোপীয় কমিশনের সাবেক সভাপতি ৯৪ বছর বয়স্ক জ্যাক ডেলার্স এর আগে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন, এই ঐতিহাসিক মানবিক সংকটে ইইউ জোট যদি ইউরোপীয় জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যতে এই ইইউ জোটে নতুন করে সংকটের সৃষ্টি হবে।
দীর্ঘ তিন বছর ধরে ব্রেক্সিট নিয়ে টানাহেঁচড়ার পর অবশেষে গত ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্য সরকার ইইউ থেকে বের হয়ে যায়। ব্রেক্সিট বিচ্ছেদের সংকট কাটতে না কাটতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নতুন সংকটের জন্ম দেয়।
এই মুহূর্তে বিশ্বব্যাপী করোনা সংকটে প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্য যুক্তরাষ্ট্রের পরই ইইউর চারটি দেশ: ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। ইইউ জোটভুক্ত এই চারটি দেশে ইতিমধ্য ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এত অল্প সময়ে এই মৃত্যুর সংখ্যা একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ৭৫ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর, ইউরোপীয় জনগণ এত মৃত্যুর ঘটনা আর দেখেনি। এত মৃত্যু ও ভবিষ্যতে অভাবনীয় অর্থনৈতিক মন্দার কথা ভেবে সবাই দিশেহারা হচ্ছেন। তবু ইইউ জোটভুক্ত দেশগুলোর ভাগ্য বলতে হবে, তাদের নিদেনপক্ষে একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো রয়েছে। আর এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর জোরে তারা তাদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি পুনর্গঠনের সুযোগ পাচ্ছেন।
ইতালি ও স্পেনে করোনা সংকটের আগে থেকেই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছিল। নতুন করে করোনা সংকটে দেশ দুটির অর্থনীতি আরও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই দেশ দুটির বাজেট এখন ইউরোপীয় জোটের ঋণের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়েছে।
এর আগেই ইতালি ও স্পেন ও ফ্রান্সের মতো দেশগুলোয় বাজেট ঘাটতি ছিল, ইইউর ঋণের অর্থে এই ঘাটতি বাজেট পরিচালিত হচ্ছিল। এই দেশগুলো করোনা সংকটের মুখে আরও দিশেহারা হয়ে পড়েছে। দেশগুলোর অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতে তারা করোনা বন্ড অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের কথা বেশ জোরেশোরে বলছিল। এই করোনা বন্ড প্রকল্প নির্দিষ্ট সুদের হারে সব দেশ থেকে ছাড়ার প্রস্তাব এসেছিল।
কিন্তু দক্ষিণ ইউরোপীয় দেশগুলোর এই প্রস্তাব, উওর ইউরোপীয় দেশ যেমন জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ও সুইডেন নাকচ করে দেয়। নাকচ করার কারণ হলো, দক্ষিণের দেশগুলোর বিশাল বাজেট ঘাটতি দীর্ঘদিন থেকেই রয়েছে, তদুপরী নতুন করে ঋণের দায়ভার সমভাগে বণ্টনের বিষয়ে তাদের আপত্তি ছিল। নতুন করে অতিরিক্ত আর্থিক সহায়তা ঋণ হিসেবেই চিহ্নিত করার দাবি ও বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে সেই ঋণ ফেরত দেওয়ার শর্তের বিষয়ে তাঁরা জোর দিচ্ছিলেন। তবে অনৈক্য কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ইইউ জোটভুক্ত দেশগুলো করোনার কারণে আসন্ন মন্দা মোকাবিলার জন্য আলাদা করোনা পুনরুদ্ধার তহবিল গঠন করেছেন।
২৩ মে ইইউ জোটের সভায়, ইইউ কাউন্সিলের সভাপতি চার্লস মিশেল বলেছিলেন, এই জোটের কিছু দেশ যদি করোনা সংকটের কারণে অর্থনৈতিকভাবে আরও দেউলিয়া হয় পড়ে, তবে তাকে রক্ষা বা উদ্ধার করা আমাদের জোট সদস্যদের সবার দায়িত্ব। তিনি আরও বলেছিলেন, জোটের কিছু দেশকে অর্থনৈতিক মন্দায় রেখে অন্য দেশগুলোও ভালো থাকতে পারবে না। ইউরোপীয় কমিশনের সভাপতি ভন ডের লেইন ও মন্দা রুখতে জোট সদস্যদের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলেন।
ইইউ জোটের শীর্ষ নেতাদের বৈঠকের আগেই জোটের অর্থমন্ত্রীরা ৫৪ হাজার কোটি ইউরোর বেলআউট প্যাকেজের বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। এই অর্থনীতি পুনরুদ্ধার তহবিল থেকে আগামী জুন মাস থেকেই ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে দেওয়া হবে। তবে তার আগেই জোটভুক্ত দেশগুলো একটি গ্যারান্টি তহবিল গঠন করবে।
তিনটি পর্যায়ে এই পুনরুদ্ধার তহবিল সংকটপূর্ণ দেশগুলোয় কাজ করবে। প্রথমত, ইউরোপীয় স্ট্যাবিলিটি ম্যাকানিজম বা ইএসএম মন্দার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান বা কাঠামোগুলোকে শনাক্ত করে ঋণসহায়তা দেবে। দ্বিতীয়ত, ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক মন্দায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগ সহায়তা দেবে। তৃতীয়ত, মন্দার কারণে যেসব কর্মীর বেতন–ভাতার সমস্যা হচ্ছে বা তাঁদের চাকরি সংরক্ষণের বিষয়টি দেখবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোয় নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারপরও স্মরণকালের বৃহত্তর মানবিক সংকটে একে অপরকে দূরে না ঠেলে দিয়ে, সংহতি আর সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছে।
সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি