অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে চলমান লকডাউন বেড়েছে আরও এক মাস; সঙ্গে রাত ৯টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত কারফিউ। পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে সেনাসদস্য। শহরের প্রায় ৫০ লাখ বাসিন্দাকে ঘরে থাকার আদেশ জারি করেছে নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্য সরকার।
সিডনিতে করোনা ভাইরাস দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে ছিল। সম্প্রতি ডেলটা ভাইরাসে কিছুটা কাবু অস্ট্রেলিয়ার এই বৃহত্তম শহর। গত জুনে সিডনির পূর্বাঞ্চলীয় এলাকাতে স্থানীয় এক পরিবহনকর্মীর মধ্যে ধরা পড়ে এই ডেলটা ধরন। তারপর প্রতিদিন ৩, ৬, ১২, ৩৬, ৭২, ১৩০, ২৫০, ৩২০, ৪৬৩, ৬৮০ পর করে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৯৪। সারা বিশ্বে সোমবার পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ২১ কোটি ৮ লাখ ৬৪ হাজার ১১০ জন, মারা গেছেন ৪৪ লাখ ১৫ হাজার ২৫২ জন। যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন প্রায় ৬ লাখ ২৭ হাজার, ভারতে ৪ লাখ ৩৩ হাজার এবং ব্রাজিলে ৫ লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন আর অস্ট্রেলিয়ায় আক্রান্তের হার মাত্র শূন্য দশমিক ১৬ শতাংশ।
সংকট উত্তরণে পদক্ষেপ
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অস্ট্রেলিয়া বেশ তৎপর। ভৌগোলিক অবস্থানও সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা করেছে। শুরুতে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সময়োচিত। অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশ ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা’, এই পরামর্শ পুরোপুরি মেনে চলেছে। এ পর্যন্ত দেশটিতে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ ৩৭ হাজার ৮৪৫টি। সরকারের পক্ষ থেকে দেশটি তার নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। দেশজুড়ে কাজ হারানো মানুষ আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। প্রতি সপ্তাহে ৭৫০ অস্ট্রেলীয় ডলার করে দিয়ে গেছে পুরো এক বছর ধরে এবং এবারের লকডাউনেও এই সহায়তা অব্যাহত আছে। কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রণোদনা দিয়েছে। এ ছাড়া রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও স্বল্প পরিসরে হলেও প্রণোদনা দিয়েছে। ফলে মানুষকে ঘরে রেখে দ্রুত সংক্রমণ ঠেকাতে সমর্থ হয় অস্ট্রেলিয়া।
তবে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বন্ধের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় প্রায় ৭৫ লাখ বিদেশি দেশটিতে আটকা পড়েন। দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক ও স্থায়ী বাসিন্দাদের বিদেশ যাওয়ার ওপর ও বিদেশে থেকে অস্থায়ী ভিসাধারীদের অস্ট্রেলিয়াতে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি সমালোচনার মুখে পড়ে। তার চেয়ে বেশি সমালোচনা হয় করোনাভাইরাস যখন তুঙ্গে, তখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যখন বিদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, সরকারি সহায়তা ছাড়া নিজেদের খরচ যাঁরা চালাতে পারবেন না, তাঁরা যেন তাঁর নিজ দেশে ফেরত চলে যান। এবার আবার ভারতে করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নাগরিকদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এসব নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তবে জরিপে মতে, সরকারের উদ্যোগে দেশবাসী সন্তুষ্ট।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে অস্ট্রেলিয়া বেশ তৎপর। ভৌগোলিক অবস্থানও সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সহায়তা করেছে। শুরুতে সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল সময়োচিত। অস্ট্রেলিয়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উপদেশ ‘পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা’, এই পরামর্শ পুরোপুরি মেনে চলেছে।
অর্থনৈতিক মন্দা
করোনাকালে মন্দায় পড়ে অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতি। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে নেওয়া বিধিনিষেধের কারণে গত বছর মার্চ থেকে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে ওই বছরের মার্চ প্রান্তিকের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যায় দেশটিতে এবং এতে করে গত ২৯ বছরে এই প্রথম এমন মন্দায় পড়ে দেশটির অর্থনীতি। আশার কথা করোনাভাইরাস ঘিরে মহামারির পাশাপাশি এই অর্থনৈতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশটির ফেডারেল সরকার, রাজ্য সরকার, বিরোধী দল ও অন্যান্য সহযোগী সংস্থা একযোগে কাজ করছে।জনগণের জন্য রাজ্য সরকারগুলোর প্রণোদনার পাশাপাশি ফেডারেল সরকার ইতিমধ্যে দুই দফায় ৮ হাজার ৩৬০ কোটি ডলারের প্রণোদনা দিয়েছে। এই করোনাভাইরাসে অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ১০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে আরও হারাবেন।
টিকাদান জটিলতা
সব জল্পনা-কল্পনা শেষে চূড়ান্তভাবে অস্ট্রেলিয়া টিকা উৎপাদন শুরু করে। সেই সঙ্গে আমদানিও। অস্ট্রেলিয়ার মানুষজনের মধ্যে টিকা নিতে প্রথম দিকে খুব একটা আগ্রহ ছিল না। প্রাথমিক অবস্থায় যাঁদের টিকা দেওয়া হতো, তাঁদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে সরকার। পর্যবেক্ষণে উঠে এল ভয়ংকর খবর। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রক্ত জমাট বেঁধে ছয়জন মারা গেছেন। সরকার এ তথ্য লুকিয়ে রাখেনি। গত জুলাই পর্যন্ত জনসংখ্যার মাত্র ৯ শতাংশ টিকা নিয়েছিল। করোনার ডেলটা ভেরিয়েন্টে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়া টিকার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। সম্প্রতি ১৬ বছর বয়স থেকেই টিকা গ্রহণ করা যাচ্ছে। চাহিদা বেশি থাকায় ফাইজারের টিকা শেষ হয়ে আসছিল। সম্প্রতি ১০ লাখ ডোজ নতুন করে আমদানি করা হয়। শিগগির আরও চালান চলে আসবে বলে আশাবাদী সরকার। সর্বশেষ পরিসংখ্যান হলো, সিডনি হলো পৃথিবীর বড় শহরগুলোর অন্যতম টিকা সম্পন্নকারী শহর। আজ পর্যন্ত সিডনিতে দুই ডোজ টিকা নেওয়া হয়েছে মোট বাসিন্দাদের ৩১ দশমিক ২৬ শতাংশ এবং এক ডোজ সম্পন্ন করেছেন ৫৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ, আর পুরো অস্ট্রেলিয়াতে যথাক্রমে ৩০ দশমিক ২ শতাংশ এবং এক ডোজ সম্পন্ন করেছেন ৫২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এ পর্যন্ত ১ কোটি ৭৯ লাখ ৩ হাজার ১৮৩ জন টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের অবস্থা
ধারণা করা হয় সিডনিতে প্রবাসী বাংলাদেশি আছেন ৫০ হাজারের বেশি। প্রথম দিকে তাঁদের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছিল শূন্যের কোঠায়। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশিদের মধ্যে সংক্রমণের প্রথম খবরে আসে বাংলাদেশ থেকে সদ্য সিডনিতে ফেরত আসা উলওয়ার্থস সুপারমার্কেটের এক যুবক কর্মীর, তারপর হোটেলকর্মী এক বাংলাদেশি নারীর এবং তারপর বাংলাদেশফেরত হোটেল নিভৃতাবাসের এক বৃদ্ধ মা ও যুবক ছেলের সংক্রমণের খবর আসে। এ ছাড়া সিডনিতে বাংলাদেশফেরত যাত্রীদের মধ্যে ১১ জনের করোনা শনাক্তের খবর এসেছিল অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে। আরও কিছু বাংলাদেশির সংক্রমণের খবর চাউর হয়েছিল, কিন্তু নিশ্চিত করা যায়নি। গত কয়েক দিনে সিডনিতে করোনাভাইরাসে মারা গেছেন দুজন। সংক্রমিত অবস্থায় আছেন আরও কয়েকজন। তা ছাড়া অন্যান্য রাজ্যেও সংক্রমণের কিছু বিচ্ছিন্ন খবরও পাওয়া যাচ্ছে। তবে সার্বিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে।
সীমান্ত খুলছে
করোনা সংক্রমণ রোধে সরকার কঠোর লকডাউন আরোপ করলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারেন। ব্যায়াম করতে বাইরে যেতে পারেন। বিনোদনের কথা মাথায় রেখে অস্ট্রেলিয়ার দল অলিম্পিকে গিয়েছে। ক্রিকেটের দল গিয়েছিল বাংলাদেশসহ অন্যান্য কয়েকটি দেশে টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলতে। সবার টিকা গ্রহণ শেষ হলে বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে বলে আশাবাদী অস্ট্রেলিয়ার সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী অক্টোবরের মধ্যে ৭০ শতাংশ এবং মধ্য নভেম্বরের মধ্যে ৮০ শতাংশ টিকা দেওয়া সম্পন্ন হবে। ৭০ শতাংশ টিকা দেওয়া হলেই অস্ট্রেলিয়া সীমান্ত খুলতে শুরু করবে—এ রকম পরিকল্পনা আছে। সরকার এখন সবকিছু স্বাভাবিক করতে আগ্রহী। সোমবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই কোভিড-১৯-এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে শিখতে হবে।’ ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ডিসেম্বর না হলেও জানুয়ারি থেকে সীমিত আকারে আন্তর্জাতিক সীমান্ত খুলতে শুরু করবে।
শেষ কথা, বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়। ভবিষ্যৎই বলে দেবে করোনাযুদ্ধে কতটা সফল অস্ট্রেলিয়া।
কাউসার খান অভিবাসন আইনজীবী, অস্ট্রেলিয়া। [email protected]