করোনাভাইরাস: সামনে চীনে যা যা ঘটতে পারে
পশ্চিমা ঘরানার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেভাবে সরকার পরিবর্তিত হয়, চীনে সে ধরনের ব্যবস্থার অনুপস্থিতি দেশটিতে এর আগে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে। সম্প্রতি আবার সেখানে সে ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, দেং জিয়াপিং ১৯৭৮ সালে দেশটিতে ‘সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ’ নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তিনি একাধিক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণভিত্তিক নির্বাচনব্যবস্থার ধারণাকে খারিজ করে দিয়েছিলেন, তথাপি তিনি এ নীতির মাধ্যমে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নীতিগত নির্দেশনা এবং একই সঙ্গে দলটির অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বণ্টন প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন এনেছিলেন।
গত বছরের ডিসেম্বরে উহানে যে করোনাভাইরাসজনিত মহামারি শুরু হয়, তা চীনের রাজনৈতিক অঙ্গনে সে ধরনের ঐতিহাসিক বাঁকবদলের সূচনা করতে পারে। কোভিড-১৯ নাম দেওয়া এ ভাইরাসের বিধ্বংসী অবস্থা সিপিসির ওপর এতটাই চাপ তৈরি করেছে যে তাকে এখন আর একটি ক্ষণস্থায়ী ঝঞ্ঝা বলে ধরে নেওয়া যাচ্ছে না। ভবিষ্যতে এ সংকট কী পর্যায়ে গড়ায়, সে বিষয়ে বিশ্বকে এখনই তৈরি হতে হবে।
গত চার দশকে সিপিসি বহু সংকট সফলতার সঙ্গে কাটিয়ে উঠেছে। ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন ট্র্যাজেডি এবং ২০০২-২০০৩ সালের সার্স ভাইরাসজনিত মহামারি থেকে শুরু করে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা—সব কটিকেই চীন ভালোভাবে সামাল দিয়েছে।
চীন সরকারের সমালোচকদের মধ্য থেকে অল্প কিছু লোক এর আগে এসব সংকটের কারণে চীনের শাসনব্যবস্থা বদলে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তবে সেসব ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ক্ষমতায় আসার আগে চীনের প্রশাসনিক পদ্ধতি ছিল অভিযোজনমূলক ও বিকেন্দ্রীকরণমুখী। ওই আমলে সমাজের নানা পর্যায়ের পরামর্শ গ্রহণ করা হতো। সমালোচকদের নানা পরামর্শ গ্রহণের প্রবণতাও ওই সব সরকারের মধ্যে দেখা যেত। সুশীল সমাজ ও সরকারের সমালোচনাভিত্তিক সাংবাদিকতার বিস্তারও সে সময় চীন সরকার মেনে নিচ্ছিল।
কিন্তু এখনকার সময়টা সম্পূর্ণ আলাদা। ২০১২ সালে সি চিন পিং ক্ষমতায় এসেই দেশের মধ্যে তাঁর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজ্র আঁটুনিতে বেঁধেছেন এবং বিদেশে চীনকে পরাশক্তি হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া হয়েছেন। তাঁর এ নীতি চীনের বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের বিপদে ফেলেছে, পশ্চিমা শক্তিগুলোকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান চাপা উত্তেজনাকে আরও জোরালো করেছে। এর সব কটিই চীনের সামগ্রিক অর্থনীতির গতিকে শ্লথ করে ফেলেছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ সি সরকারের ওপর নতুন চাপ যোগ করেছে। এ মহামারি নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকলে চীনের পক্ষে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো মুশকিল হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা পথে বসে যাবেন, কর্মীরা চাকরি হারাবেন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর আগে চীনের নেতাদের একটি একটি করে সমস্যা মোকাবিলা করতে দেখা গেছে। কিন্তু এবার একসঙ্গে একগুচ্ছ পর্বতসম সমস্যা তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড (যিনি বর্তমানে এশিয়া সোসাইটির প্রেসিডেন্ট) সম্প্রতি তাঁর একটি কলামে লিখেছেন, ‘এ সংকট কেটে গেলে চীনের প্রশাসনিক ভবিষ্যতে হেরফের হবে বলে মনে হয় না।’ কিন্তু তাঁর এ বক্তব্যে মাত্রাতিরিক্ত আশাবাদ আছে বলে মনে হচ্ছে। আসল অবস্থা হলো, সি চিন পিংয়ের শীর্ষ নেতৃত্বে চিড় ধরার বিষয়টি ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, করোনাভাইরাস সংক্রমণের খবর প্রথম দিকে চীন সরকার চেপে যাওয়ায় জনক্ষোভ যখন তুঙ্গে, তখন সি চিন পিং প্রকাশ্যে আসা বন্ধ করে দেন। ২৮ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেডরোস অ্যাডানোম গেব্রিয়েসাসের সঙ্গে মিটিংয়ের পর তিনি অন্তরালে চলে যান। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে বৈঠকের দিন তাঁকে প্রকাশ্যে দেখা যায়। যে নেতাকে চীনের সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিন দেখা যেত, জাতীয় আতঙ্কের সময় তাঁর অনুপস্থিতি সন্দেহের উদ্রেক করে এবং চীনের ঘটনাবলির দিকে নজর রাখা বিশ্লেষকদের এ ধারণা দেয় যে ক্ষমতা হয়তো আগের মতো তাঁর মুঠোর মধ্যে নেই।
অনেকেই কয়েক বছর ধরে বলছেন, বৈশ্বিক পুঁজিপতি আমেরিকার স্থলে চীন নিজেকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য যেভাবে দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে, তা আমেরিকান রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্পকে অস্থির করে ফেলবে। চীনের রাশ টেনে ধরতে তাঁর প্রশাসন সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এখন চীনের সামনে সম্ভাব্য তিনটি বিষয় দেখতে পাচ্ছি। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক যে ঘটনা ঘটতে পারে, সেটি হলো এ শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এটা এমন নয় যে হুট করে সরকারের পতন হবে। এ মহামারি আরও বিস্তৃত হলে জন-অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে এবং তা গৃহযুদ্ধে মোড় নিতে পারে। গৃহযুদ্ধের একপর্যায়ে ইরাকের সাদ্দাম হোসেন এবং লিবিয়ার গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়েছিল। চীনে যদি সে ধরনের গৃহযুদ্ধ বাধে, তাহলে তা সারা বিশ্বের জন্য মহাদুর্যোগ বয়ে আনবে।
সৌভাগ্যের বিষয়, সে ধরনের পরিস্থিতি আসার কোনো লক্ষণ এখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি না। চীন যদিও এখন প্রচণ্ড অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে আছে, তবে অর্থনীতি এখনো স্থবির হয়ে যায়নি। এর একটি কারণ হিসেবে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্যাং জিন উয়ি বলেছেন, চীনের উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিগুলো সাধারণ মানুষকে ঘরে বসে কেনাকাটা করার সুযোগ করে দিয়েছে। এতে কেনাকাটা বন্ধ হওয়ার হাত থেকে অনেকটাই বাঁচা যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে কয়েক লাখ লোক এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং আক্রান্ত এলাকায় কোটি কোটি লোক বিক্ষুব্ধ হয়েছে। তবে দেশের বাকি এলাকায় মানুষ সেই মাত্রায় এখনো ক্ষুব্ধ হয়নি।
দ্বিতীয় যে ঘটনাটি ঘটতে পারে, সেটি হলো নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে পরিবর্তন আসতে পারে। চীনের অভ্যন্তরীণ কড়াকড়ি নীতি নিয়ে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে, তার দায় সি চিন পিং এড়াতে পারেন না। যে চিকিৎসক করোনাভাইরাসের বিষয়ে প্রথম সবাইকে সতর্ক করার পর সরকারের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছিলেন, সেই লি ওয়েনলিয়াং এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করায় সরকারের ওপর মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। অনলাইনে সি চিন পিংয়ের তীব্র সমালোচনা হয়।
আইন করে সি চিন পিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে এবং এর ফলে তিনি চাইলে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবেন। তাঁর বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে ২০২২ সালে। এ মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি সত্যিই ক্ষমতায় থাকবেন কি না, তা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
চীনের সব ব্যবস্থার কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা এখন প্রেসিডেন্টের হাতে। ফলে তাঁর সিদ্ধান্ত সমাজের সব স্তরের ওপর প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালে যদি সি ক্ষমতা ছেড়ে দেন এবং নতুন কোনো নেতা ক্ষমতায় আসেন, তাহলে সেই নতুন নেতা সির নীতিকে বাতিল করে নতুন নীতি গ্রহণ করবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। আর সেটি করা হলে বাকি বিশ্বও চীন এবং তার বৈশ্বিক ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাববে।
সর্বশেষ সম্ভাব্য চিত্র হতে পারে, সি চিন পিং ২০২২ সালে ক্ষমতা ছাড়বেন না এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন। এটি করতে গিয়ে তিনি আরও বেশি আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বী তৈরি করবেন।
এটি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেমে যাওয়ার পর চীনের বর্তমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিস্থিতি এখনকার মতো থাকবে না। জনশ্রুতি ছড়িয়েছে, ইতিমধ্যেই সি চিন পিংয়ের ক্ষমতা এখনই আগের মতো আর কেন্দ্রীভূত অবস্থায় নেই। জীবনের প্রতি পদে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা ও বিধিনিষেধ কতটা বিধ্বংসী হয়ে উঠতে পারে, তা চীনের মানুষ প্রাণ দিয়ে বুঝতে পারছে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
ইউয়েন ইউয়েন অং: ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক