আজিজুল হাসান (ছদ্মনাম) দেশের প্রখ্যাত এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করছেন। তিনি তাঁর আম্মার অ্যাকসিডেন্ট এবং পরবর্তী অসুস্থতার জন্য বিজ্ঞানের একটি বিষয়ে চার বছরের সম্মান কোর্স বাদ দিয়ে তিন বছরের ডিগ্রি পাস কোর্স করেছিলেন। মেধাবী ছাত্র হাসান ভেবেছিলেন ভালো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে তাঁর মনঃকষ্ট দূর করবেন। হাসানের মনঃকষ্টের অন্যতম কারণ ছিল তিন বছরের ডিগ্রি পাস কোর্স করে দেশের অনেক ভালো চাকরিতেই আবেদন করতে পারতেন না। উপরন্তু, তিন বছরের যে ডিগ্রি ২০১৫ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল, সেটা শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে। প্রচুর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে দুই বছরের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হন। দ্রুত প্রোগ্রাম শেষ করার জন্য উন্মুক্ত ক্রেডিট পদ্ধতিতে প্রতিটি সেমিস্টারে চারটি করে কোর্স করেন, যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাঁর ডিগ্রি শেষ হয়। আজিজুল হাসানের সর্বশেষ সেমিস্টার শুরু হয় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে। একটি কোর্সের পাশাপাশি শুরু করেন ইন্টার্নশিপ। সঙ্গে নিতে থাকেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিসিএস চাকরির প্রাণান্ত প্রস্তুতি।
অন্য আরেকটি ঘটনা এ রকম। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত প্রোগ্রামে অনার্স করছেন প্রশান্ত কুমার (ছদ্মনাম)। প্রশান্ত কুমারদের চতুর্থ বর্ষ শুরু হয় ২০১৯ সালের জুলাইতে। প্রথম সেমিস্টার যথারীতি ২০১৯-এর ডিসেম্বরে শেষ হয় এবং ২০২০-এর জানুয়ারিতে শুরু হয় দ্বিতীয় সেমিস্টার। দ্বিতীয় সেমিস্টার শেষ হওয়ার কথা ছিল জুন ২০২০-এ। কারিকুলাম অনুযায়ী প্রশান্তদের অনার্স কোর্স শেষে ইন্টার্নশিপ শেষ হতো সেপ্টেম্বর ২০২০-এ। সবকিছু স্বাভাবিক থাকলে ২০২০ সালের অক্টোবর কি নভেম্বর মাসের মধ্যেই তাঁদের অনার্সের ফলাফল প্রকাশিত হতে পারত।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, মেধাবী ছাত্র আজিজুল হাসান অথবা প্রশান্তদের। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কবলে, করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত সারা দুনিয়া। করোনার বিষে বিষাক্ত ২০২০ সাল। অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষা খাতেও লাগে করোনার ভয়াল ঢেউ। ২০২০-এর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। সীমিত পরিসরে অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয় জুন মাসের পর থেকে। বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনলাইন বা ওপেন-বুক পদ্ধতিতে নিলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরীক্ষার বিষয়টি ঝুলে থাকে। অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পূর্ববর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা ও ফলাফল অসম্পূর্ণ রেখে অনলাইনে পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করে। আজিজুল হাসানের মতো বহু ছাত্রছাত্রী, যাঁরা পূর্ববর্তী সেমিস্টারে ফাইনাল পরীক্ষা হলেই ডিগ্রি হয়ে যায়, তাঁরা আছেন সবচেয়ে বেকায়দায়। তাঁরা না এখন নিয়মিত ছাত্রছাত্রী হিসেবে ক্লাস করতে পারছেন, না বিভিন্ন চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারছেন।
দুই.
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে সোনার হরিণখ্যাত বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। একসঙ্গে দুই বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। ৪২ এবং ৪৩তম মিলিয়ে পদ প্রায় ৪০০০ (সূত্র প্রথম আলো, নভেম্বর ৩০, ২০২০)। এর মধ্যে ৪২তম বিসিএসটি বিশেষ এবং ৪৩তমটি সাধারণ। করোনা মহামারি মোকাবিলায় সরকার ত্বরিত সিদ্ধান্তে ২০০০ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়। বিধিমালা সংশোধন করে পিএসসি তাদের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়মিত ও চূড়ান্ত করছে ৪২তম বিসিএসের মাধ্যমে। সে অর্থে নতুন নিয়োগ হবে শুধু ৪৩তম বিসিএসের মাধ্যমে, যেখানে পদসংখ্যা ১ হাজার ৮১৪টি।
করোনা মহামারিতে পর্যুদস্ত অর্থনীতি। মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙে দিনাতিপাত করছে সাধারণ মানুষ, বিশেষত মধ্যবিত্ত সমাজ। এ দুর্গতির শেষ কোথায় কেউ বলতে পারছে না। এমন দুর্ভোগপূর্ণ সময়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ সাধুবাদযোগ্য। দেশের চাকরিপ্রার্থী শিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য এ এক আশার নবদিগন্ত।
দেশের মোট চাকরিপ্রার্থীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বিসিএসকে টার্গেট করে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী তাঁদের নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য ব্যাপক পড়াশোনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় পাঠাগারে প্রতিদিন সকালে সার বেঁধে ভেতরে ঢোকা ছাত্রছাত্রীদের চিত্র স্মরণযোগ্য। কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সুপরিসর নিরিবিলি পরিবেশে মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তাঁদের নিয়মিত পাঠের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক বিভিন্ন চাকরির প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনা করতেন বলে শোনা যায়। একই সঙ্গে নিয়মিত ও চাকরির প্রস্তুতিমূলক পড়াশোনা মেধা বিকাশের অনন্য নজির বটে।
চাকরির বিজ্ঞাপন শুধু চাকরিপ্রার্থীর মনেই আশার আলো দেখায় না, সংশ্লিষ্ট চাকরিপ্রার্থীর পরিবার, সমাজও এ ক্ষেত্রে আশার আলো দেখতে পায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় একজন চাকরিজীবী উপার্জনক্ষম ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকে পুরো একটি পরিবার। একজন চাকরিজীবী তাঁর নিজের, স্বীয় পরিবারের এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সমাজের অনেকেরই ভরণপোষণের দায়িত্ব নেন। এ দেশের একজন মেধাবী চাকরিপ্রার্থীকে ঘিরে তাই স্বপ্ন দেখে তাঁর পরিবার, সমাজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত। বিশেষ করে চাকরিপ্রার্থীর অভিভাবক, যাঁরা প্রায়ই খোঁজ করে থাকেন বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি, নিয়োগ ও তার অগ্রগতি। মর্যাদাসম্পন্ন বিসিএস চাকরি এ ক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখে।
তিন.
মর্যাদাসম্পন্ন বিসিএসের চাকরি খুবই প্রতিযোগিতামূলক। পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখা যায়, নিকট অতীতের বিসিএস পরীক্ষায় আবেদনকারীদের সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। যেমন ৪১তম বিসিএসে রেকর্ড ৪,৭৫,০০০ আবেদনকারী অংশগ্রহণ করেন (সূত্র প্রথম আলো, জানুয়ারি ৪, ২০২০) যেখানে ৪০তম বিসিএসে প্রাথমিক আবেদনকারী ছিলেন ৪,১২,৫৩২ জন।
অপর পক্ষে এ দেশে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে বেশ সময় লেগে যায়। ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতার শিক্ষা কারিকুলামে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতেই বয়স ২৪-২৫-এর কোটা পেরিয়ে যায়। বিলম্বে ফলাফল প্রকাশিত হলেও সে ঘানি টানতে হয় মেধাবী শিক্ষার্থীকেই। অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা নির্ধারিত।
নিকট অতীতে বিসিএসের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি মোটামুটি নিয়মিত হলেও পূর্বে এ রকম ছিল না। আগে একজন মেধাবী চাকরিপ্রার্থী তাঁর বয়সসীমা অতিক্রমের পূর্বে ২ থেকে ৩টি বিসিএসে আবেদনের সুযোগ পেতেন, বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতি হয়ে সে সুযোগ ৩ থেকে সর্বোচ্চ ৪-এ এসেছে। অগণিত শিক্ষিত বেকার চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছে অন্তত একটি বিসিএস পরীক্ষায় বেশি অংশগ্রহণের সুযোগ, সে অনেক কিছু।
একনাগাড়ে এত লম্বা সময় পড়াশোনার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে অনেকেই হতাশ। একদিকে চাকরির বয়স সীমার চিন্তা, করোনার ভয়াবহতায় সুদীর্ঘ সেশনজটের বাস্তবতা মাথায় নিয়ে বিমর্ষ দিনাতিপাত করছেন হাজারো শিক্ষার্থী।
করোনা মহামারির সময়ে বিসিএসসহ অপরাপর চাকরির বিজ্ঞাপন তাই কারও কাছে যেমন উৎফুল্লের বিষয়, অনেকের কাছে আবার তা হতাশারও। আজিজুল হাসান বা প্রশান্ত, যাঁদের চাকরিতে অ্যাপিয়ার্ড হিসেবেও আবেদনের যোগ্যতা, শুধু শেষ সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধুলায় মিশে যাচ্ছে তাঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক এমনকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও এ রকম উল্লেখযোগ্যসংখ্যক চাকরিপ্রত্যাশী ছাত্রছাত্রী থাকতে পারেন। পেশাগত কারণে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেই কথা হয়, যোগাযোগ হয়। করোনার সময় অনেক ছাত্রছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিরচেনা পরিবেশ, হলজীবন ছেড়ে গ্রামেগঞ্জে নিজেদের বাড়িতে চলে গেছেন।
একনাগাড়ে এত লম্বা সময় পড়াশোনার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে অনেকেই হতাশ। একদিকে চাকরির বয়স সীমার চিন্তা, করোনার ভয়াবহতায় সুদীর্ঘ সেশনজটের বাস্তবতা মাথায় নিয়ে বিমর্ষ দিনাতিপাত করছেন হাজারো শিক্ষার্থী। যাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে বড় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি হতে পারত হতাশা দমনের হাতিয়ার, আশার আলো। নির্মম বাস্তবতায় আজ তা অনেক সম্ভাব্য চাকরিপ্রার্থীদের সোনার হরিণ হাতছাড়া হওয়ারই নয়, তাঁদের পরিবার-পরিজনের কাছেও দুরাশার নামান্তর।
ড. শহীদুল জাহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের শিক্ষক।