করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার অংশ হিসেবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাণিজ্যসংক্রান্ত মেধাস্বত্ব চুক্তির (অ্যাগ্রিমেন্ট অন ট্রেড রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইন্টালেকচুয়াল প্রোপার্টি রাইটস বা ট্রিপস) কয়েকটি ধারার পরিপালন সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা যৌথভাবে এ বিষয়ে একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন করে ট্রিপস কাউন্সিলের বৈঠকে। জেনেভায় বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কার্যালয়ে গত ১৫-১৬ অক্টোবর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এই প্রস্তাবের ওপর তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হয়। যেহেতু সদস্যরা সবাই একমত হতে পারেননি, সেহেতু প্রত্যাশিত ছাড় মেলেনি ট্রিপস চুক্তির কয়েকটি ধারা থেকে।
অবশ্য বৈঠকের আগে থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল যে ডব্লিউটিও-ও উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আগের বহু বিষয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও একমত হতে পারবে না। সেটাই ঘটেছে। যদিও বৈঠক শেষ হয়েছে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া হবে। বাস্তবতা হলো, তেমন কোনো অগ্রগতি আগামীতেও হবে না।
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার দাখিল করা যৌথ প্রস্তাবটির সারমর্ম হলো এ রকম: ট্রিপস চুক্তির কপিরাইট, পেটেন্ট, শিল্প নকশা ও অপ্রকাশিত তথ্যেও সুরক্ষাবিষয়ক ধারাগুলোর বাধ্যতামূলক পরিপালন সাময়িকিভাবে সব সদস্যদেশের জন্য স্থগিত রাখা হবে। কেননা, উল্লিখিত ধরনের মেধাস্বত্ব বিধির পরিপালন করতে গেলে করোনাভাইরাসের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী (টিকা, ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা উপাদান) একদিকে যেমন ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ এই ভাইরাসের প্রতিকারমূলক টিকা উদ্ভাবনের পর তা থেকে বঞ্চিত হবে। ওষুধের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য হবে। কেননা, টিকা বা ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করছে ও করবে, তা মুনাফাসহ তুলে আনার জন্য মেধাস্বত্বের কঠোর প্রয়োগ চাইবে। অথচ বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে এই ধরনের কঠোরতা কাম্য নয়। যদি ট্রিপসের উল্লিখিত ধারাগুলো পরিপালনে ছাড় দেওয়া হয়, তাহলে তুলনামূলক কম খরচে এসব টিকা ও ওষুধ মিলবে, যা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য উপকার হবে।
মেধাস্বত্ব বিধি মানলে করোনাভাইরাসের জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসামগ্রী একদিকে যেমন ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ এই ভাইরাসের প্রতিকারমূলক টিকা উদ্ভাবনের পর তা থেকে বঞ্চিত হবে।
বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, চাদ, মিসর, তিউনিসিয়া, মালি, মরিশাস, মোজাম্বিক, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাস ও নিকারাগুয়া বৈঠকে এই প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং এর সমর্থনে কথা বলে। প্রস্তাবে ছাড় বজায় রাখার সময়সীমা সম্পর্কে বলা হয় যে যত দিন পর্যন্ত বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ তথা বেশির ভাগ মানুষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন না করবে, তত দিন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো পরিপালনের বাধ্যবাধকতা থেকে সব দেশ মুক্ত থাকবে। এর ব্যাখ্যায় বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয় যে এর মানে এটা নয় যে অনির্দিষ্টকালের জন্য এই ছাড় বহাল থাকবে।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান ও যুক্তরাজ্য তথা উন্নত দেশগুলো ট্রিপস চুক্তি পরিপালন ও বাস্তবায়নে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। ব্রাজিলসহ গুটিকয় উন্নয়নশীল দেশও একই অবস্থান নেয়।
এই দেশগুলো মোটাদাগে পাল্টা যুক্তি দেয় যে বিদ্যমান ট্রিপস চুক্তির মধ্যেই নানা রকম ছাড়ের সুযোগ আছে, যা ব্যবহার করে উন্নয়নশীল দেশগুলো মহামারিসহ বিভিন্ন দুর্যোগ বা আপৎকালীন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে, পারে সস্তায় ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রীর জোগান দিতে। মেধাস্বত্ব আইন কঠোরভাবে পরিপালনকারী উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে এ–ও বলা হয় যে এ রকম ছাড় দিলে তা একদিকে মেধাস্বত্ব সুরক্ষাকে দুর্বল করে দেবে, অন্যদিকে ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী প্রস্তুতের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও আনুষঙ্গিক উপাদান সহজে পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবে না। তা ছাড়া কোভিড-১৯ মহামারিকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে ইতিমধ্যেই নিম্নœমানের ও মানহীন ওষুধ এবং চিকিৎসা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী অনেক দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়েছে। এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য বিরাট স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে। এসব বিষয়ে প্রশাসনিকভাবে নজর না দিয়ে বৈশ্বিক মেধাস্বত্ব আইনে ছাড় কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলেও তারা উল্লেখ করে।
এ ছাড়া করোনাকালে ট্রিপসের সংশ্লিষ্ট ধারার কড়াকড়িতে কোথাও ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রীর উৎপাদন বা জোগানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে, এমন কোনো উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত এই ছাড় প্রস্তাবকারী ও তাদের সমর্থকেরা দেখাতে পারেনি বলেও প্রস্তাবের বিরোধিতাকারী কেউ কেউ বৈঠকে উল্লেখ করে।
সর্বোপরি ছাড় বজায় থাকার অনিশ্চিত সময়সীমাও এই প্রস্তাবের বিরোধিতার অন্যতম কারণ হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি বৈঠকে জানান, জটিল রোগপ্রতিরোধক টিকা উদ্ভাবন করতে ১০ বছর পর্যন্ত লেগে যায়। যদিও এই মহামারিকালে সরকারি সর্বাত্মক সমর্থনে ও অর্থায়নে এই সময় কমিয়ে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এলডিসি: এ রকম অবস্থার মধ্যে পড়ে এলডিসিগুলোর পক্ষ থেকে বৈঠকে উত্থাপন করা আরেকটি ছাড় প্রস্তাবও খারিজ হয়ে যায়। এলডিসিগুলোর পক্ষে আফ্রিকার দেশ চাদ এই প্রস্তাব পেশ করেছিল। এতে বলা হয়েছিল যে করোনা মোকাবিলায় এলডিসিগুলো সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে। অথচ ট্রিপস চুক্তি পরিপালনের বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে দেওয়া ছাড় আগামী বছরের বা ২০২১ সালের ৩০ জুন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় এই ছাড় সব এলডিসির জন্য আরও ১২ বছর বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। তার মানে ২০৩৩ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত এলডিসি ও এই সময়কালে এলডিসির কাতার থেকে বাংলাদেশসহ যেসব দেশে বের হয়ে আসবে, তাদের জন্য ছাড় দেওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয় এলডিসিগুলো।
এর আগে এলডিসিগুলো দুই দফায় ট্রিপস চুক্তির শর্তাবলি পরিপালনে ছাড় পেয়েছে। ১৯৯৪ সালে মারাকাশ চুক্তির মাধ্যমে ডব্লিউটিও আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশকালে ট্রিপস চুক্তিতে ১০ বছরের জন্য বা ২০০৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এলডিসিগুলোকে ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে এলডিসিগুলোর সীমাবদ্ধতা ও সক্ষমতার কথা বিবেচনায় নিয়ে ২০১৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এই ছাড়ের মেয়াদ বাড়ানো হয়। আবার ২০১৩ সালের জুন মাসে এলডিসিগুলোর দাবি মেনে নিয়ে এই ছাড় দ্বিতীয় দফায় বাড়ানো হয় ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে আসবে। বর্তমান নিয়ম অনুসারে এরপর থেকে বাংলাদেশ আর ছাড়ের সুবিধা পাবে না, যা দেশের ওষুধশিল্পকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সুতরাং গোটা ট্রিপস বাস্তবায়নে ছাড় আদায় করা ও উত্তরণ ঘটে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশের জন্য সেই ছাড় কার্যকর রাখার লড়াইটা সামনে বেশ কঠিনই হবে।
অবশ্য বর্তমানে ট্রিপস চুক্তির আওতায় স্বল্পোন্নত দেশগুলো ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব আইন পরিপালনে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ছাড় পেয়েছে। ২০১৫ সালে ট্রিপস কাউন্সিল এই ছাড় অনুমোদন করে, যা আগে ছিল ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এর ফলে বাংলাদেশসহ এলডিসিগুলো বৈশ্বিক নামকরা ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মেধাস্বত্ব রক্ষিত বা পেটেন্ট করা ওষুধ স্বদেশে প্রস্তুত করতে পারছে, যা মেধাস্বত্ব লঙ্ঘন বলে বিবেচিত হচ্ছে না। এলডিসিগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই কেবল ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানিতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে আছে।
এই ছাড় না থাকলে পেটেন্ট করা জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের জন্য চড়া হারে রয়্যালটি বা মূল্য দিয়ে অনুমতি সংগ্রহ করতে হতো। অথবা পেটেন্টের মেয়াদ (২০ বছর) শেষ হওয়ার পর ওই ওষুধ উৎপাদনের সুযোগ পাওয়া যেত। এতে ওষুধের দাম অনেক বেড়ে যেত। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বা নরওয়ের মতো উন্নত দেশ কোনো ওষুধ তৈরি করে তা বাজারে ছাড়লে বাংলাদেশি প্রস্তুতকারকেরা একই ওষুধ এ দেশে নিজস্ব পদ্ধতিতে তৈরি করতে পারছে জেনেরিক নাম ব্যবহার করেই। সেটি ট্যাবলেট হলে ট্যাবলেট, আবার ক্যাপসুল হলে ক্যাপসুল। কম দামে এসব ওষুধ শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও রপ্তানি করা যাচ্ছে এবং পেটেন্ট দিয়ে সুরক্ষিত ওষুধের সঙ্গে একধরনের প্রতিযোগিতা করেই। সবটাই সম্ভব হচ্ছে ট্রিপসের ওষুধ বিষয় মেধাস্বত্বেও ছাড়ের কারণে।
ট্রিপস চুক্তি বাস্তবায়নের পূর্ণ ছাড় তৃতীয় দফায় বাড়ানোর জন্য এলডিসিগুলোর বর্তমান প্রয়াস প্রথম দফায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে কোনো বাধা নেই। এ জন্য এলডিসিগুলোর ঐক্যবদ্ধভাবে সমঝোতা ও তদবির করে যেতে হবে। আলোচ্য বৈঠকে ছাড়ের যে প্রস্তাব দেওয়া হয়, তা ওষুধের পেটেন্টবিষয়ক ছাড়ের মেয়াদের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো, এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে গেলেও নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ছাড়ের সুবিধা যেন ওই সব দেশের জন্য বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করা। সবকিছু ঠিক থাকলে বাংলাদেশ ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে আসবে। বর্তমান নিয়ম অনুসারে এরপর থেকে বাংলাদেশ আর ছাড়ের সুবিধা পাবে না, যা দেশের ওষুধশিল্পকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে। সুতরাং গোটা ট্রিপস বাস্তবায়নে ছাড় আদায় করা ও উত্তরণ ঘটে যাওয়া স্বল্পোন্নত দেশের জন্য সেই ছাড় কার্যকর রাখার লড়াইটা সামনে বেশ কঠিনই হবে।
আসজাদুল কিবরিয়া সাংবাদিক
[email protected]