করোনা মোকাবিলা: বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপের রূপরেখা
মহামারি–উদ্ভূত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তীব্র সংকট ছাড়াও অর্থনৈতিক মন্দার পদধ্বনি বিশ্বের সবখানেই নীতিনির্ধারকদের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। চীন বছরের শুরুর দিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতার সম্মুখীন হলেও এ মুহূর্তে সংকট উত্তরণের পথে রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যৎই বলে দেবে চীন এই সংকট কাটিয়ে দ্রুত অর্থনৈতিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না। অন্যদিকে, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও এশিয়া ও আফ্রিকার ছোট-বড় অনেক দেশ অর্থনৈতিক ঝুঁকির মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। এদিক থেকে, সম্পদের নিদারুণ অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সামষ্টিক অর্থনীতির নানা সূচক বিবেচনায় আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে অন্য বেশ কয়েকটি দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দি ইকোনমিস্ট এ ব্যাপারে আশার বাণী শুনিয়েছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে নিমজ্জিত হলে তা বিভ্রান্তির চোরাবালিতে পা দেওয়ার সমতুল্য হবে।
অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কাজের ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অনেকেই আয়–উপার্জনের পথ খোলা না পেয়ে বেকারত্বের সম্মুখীন হচ্ছেন। বিভিন্ন শিল্পজাত পণ্যের রপ্তানি-আদেশ বাতিল বা স্থগিত হওয়া, বিদেশ থেকে শ্রমিকদের টাকা পাঠানো কমে যাওয়া ও দেশীয় নানা পণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার সার্বিক প্রভাব ভবিষ্যতে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
এ ছাড়া শিক্ষা, পরিবহন, ব্যাংকব্যবস্থা, হোটেল-রেস্টুরেন্টসহ নানা ধরনের সেবা খাত বড় রকমের ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। আইএমএফ তার সাম্প্রতিক পূর্বাভাসে (এপ্রিল, ২০২০) বর্তমান অর্থবছরে বাংলাদেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির হার শতকরা ২ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করলেও আগামী অর্থবছরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারলে প্রবৃদ্ধি ৯ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্জিত হতে পারে বলে জানিয়েছে। বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে চাঙা রাখার প্রয়াসে কৃষি খাত এবং মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভালো আকারের সময়োপযোগী প্রণোদনা প্রদান করেছে।
২০১৭ সালের বাংলাদেশের সোশ্যাল অ্যাকাউন্টিং ম্যাট্রিক্স বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, বাংলাদেশ যদি বর্তমান অর্থবছরে ৫ শতাংশ ও পরবর্তী অর্থবছরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায়, তাহলে আরও ব্যাপক আকারে প্রণোদনা প্যাকেজের দরকার হবে। প্রয়োজনের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলো বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ভূমিকা রাখে এমন কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রদান করা জরুরি হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনের ব্যবস্থা সৃষ্টি ও আয় বাড়াতে সক্ষম খাতগুলোতে সরকারি সহায়তা বাঞ্ছনীয় হবে।
বর্তমান অর্থনৈতিক মডেলগুলোর ফলাফল বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই, মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনলেও তার সুফল পেতে বেশ কিছু সময় লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৈদেশিক উৎসের ওপর ভরসা না করে সংকট মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের দিকে নজর দেওয়াই বেশি সমীচীন হবে। বাণিজ্যের বৈশ্বিক নেটওয়ার্কগুলোর গতিবিধি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বড় ধরনের ধাক্কা বা অর্থনৈতিক পতনের মুখে প্রায়ই এসব নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ে এবং তা পুনরায় গড়ে উঠতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হয়। আগামী দিনগুলোয় বিশ্ববাণিজ্যের এসব নেটওয়ার্ক সংকটকালে কতটুকু সাহায্য করতে পারে, তা ভেবে দেখার বিষয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য স্বনির্ভরতার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া।
অন্যদিকে, এসব সামষ্টিক নীতির সুফল জনগণের কাছে সহজে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকেও আমাদের মনোযোগ দেওয়া দরকার। বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে অর্থ ও খাদ্য সাহায্য ঘোষণা করেছে, তা সঠিক মানুষের কাছে বিতরণের ক্ষেত্রে নানা অনিয়মের খবর প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়। আমাদের অজানা নয় যে প্রশাসনের সহায়তায় প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর পারিবারিক তথ্যসহ বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করতে বেশি দিন লাগেনি। বাংলাদেশ সরকারের কাছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য পাওয়ার মতো প্রায় ৫০ লাখ অসহায় ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর তথ্যভাণ্ডার (ডেটাবেইস) রয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক স্থবিরতায় দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছেন এমন আরও অনেক মানুষের সরাসরি সাহায্য প্রয়োজন। আগে দিন এনে দিন খেতে পারতেন এমন অনেক মানুষও বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছেন।
এমন অবস্থায়, সরকারি প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জরিপ করে রুটি-রোজগার হারানো আরও অন্তত ১৫ লাখ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পারিবারিক তথ্য জোগাড় করতে পারে। এ তথ্য নিয়ে যদি বায়োমেট্রিক নিবন্ধন করে কার্ড দেওয়া যায়, তবে তা সুষম বণ্টনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে। কাজটির যথাযথ নজরদারি ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। স্থানীয় সরকার ও জনগণের সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন নিবন্ধন করতে পারলে নগদ অর্থ, চাল, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন সাহায্যসামগ্রী সহজেই দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যূহ ভেদ করে ওয়ার্ড ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সত্যিকারের অনাহারী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশে বর্তমানে খাদ্যের পর্যাপ্ত মজুত আছে, তাই জাতীয় ও অঞ্চলভিত্তিক বায়োমেট্রিক তথ্য–সংবলিত ডেটাবেইস থাকলে তা বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষভাবে সহায়ক হবে। এই ডেটাবেইস ভবিষ্যতেও বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে আসবে। আমরা জানি যে হাওর অঞ্চলে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর ফলে অনেকের আপাত–কর্মসংস্থানের পাশাপাশি সঠিক সময়ে ধান তোলার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে, যা খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম মানুষের নিবন্ধনকৃত তালিকা থাকলে যেকোনো দুর্যোগের মুহূর্তে জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের কাছে সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব একটি অভূতপূর্ব সংকটের মোকাবিলা করছে; এর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে বহুদিন লেগে যেতে পারে। ইতালীয় দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসি চরম দুঃসময়েও ‘পেসিমিজম অব দ্য ইন্টেলেক্ট’ বা বুদ্ধির নিরাশার পাশাপাশি ‘অপটিমিজম অব দ্য উইল’ বা ইচ্ছাশক্তির আশাবাদের কথাও বলেছেন। এই দুঃসময় থেকে শিক্ষা নিয়ে কীভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই জনস্বাস্থ্য খাত ও সুষম সামাজিক নিরাপত্তার একটি সার্বিক সুন্দর ব্যবস্থা তৈরি করা যায়, সে ব্যাপারে আমাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুহারবিষয়ক মহামারিশাস্ত্রের মডেলগুলোর ফলাফল নিয়ে আমরা আলোচনা করার আশা রাখি।
বর্তমান মহামারির নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে, বিশেষ করে নিম্ন–মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীকে কীভাবে বৃহত্তর ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো যেতে পারে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নিয়ে এগিয়ে আসা উচিত। এই সংকটের সময়ে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াও আরও অংশগ্রহণমূলক করতে পারলে তাতে সবারই মঙ্গল। দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা উপলব্ধির মাধ্যমে একটি সুন্দর, সৃজনশীল ও গঠনমূলক ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের দায় আমাদের সবার ওপরই বর্তায়।
জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘শহর’ নামক কবিতায় ‘নিরাশায় মনের ভিতর বিস্বাদে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার’ কথা বলেছেন। তারপরও তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু তবুও শহরের বিপুল মেঘের কিনারে সূর্য উঠতে দেখেছি;/ বন্দরের নদীর ওপারে সূর্যকে দেখেছি.../ শহরের গ্যাসের আলো ও উঁচু উঁচু মিনারের ওপরেও দেখেছি—নক্ষত্রেরা—/ অজস্র বুনো হাঁসের মতো কোন দক্ষিণ সমুদ্রের দিকে উড়ে চলেছে।’
মহামারির এই দুঃসহ সময় পাড়ি দিয়ে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ যেন মেঘের কিনারায় আশা-জাগানিয়া সূর্যোদয় দেখতে পায়, সে জন্য নীতিনির্ধারকদের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে প্রয়োজন বিবেচনায় গতিশীল ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান রইল।
তথ্যসূত্র: Haider A. Khan. 2020. “Economic Impact of COVID-19 On Bangladesh: Agenda for Immediate Action and Planning for the Future.” https://ideas.repec.org/e/pkh22.html
হায়দার আলী খান: জন ইভান্স ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, জোসেফ কর্বেল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ, ডেনভার ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র,
[email protected]
রেজওয়ান মাসুদ: প্রভাষক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণারত),
[email protected]