কর বাড়ানোর চেয়ে তামাক পণ্যের করের আওতা বাড়ানো জরুরি

সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের ওপর করারোপ অনেক ক্ষেত্রেই বেশ সহজ আবার বেশ কঠিন। আমরা যদি তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর বক্তব্য শুনি, সিগারেট ও তামাক সেবনকে নিরুৎসাহিত করার জন্য অতি সহজেই হয়তো বর্তমান কর কমবেশি ৮০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০-২০০ শতাংশে নিয়ে যেতে পারি। অন্যদিকে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের ওপর করারোপকে কিছুটা বুদ্ধি প্রসূত করার জন্য এই খাতের ওপর করারোপে কিছুটা আধুনিকতা এবং গবেষণাপ্রসূত উদ্যোগের সহায়তাও নিতে পারি। এ ক্ষেত্রে আমরা কিছুটা গভীরে গেলেই জানতে পারব কী ধরনের তামাকজাত পণ্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবৈধভাবে উৎপাদন ও বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের সিগারেট। সেই কারণে প্রতিবছর সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এসব সিগারেট সরকারনির্ধারিত দামের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে। ফলে অনেক ক্রেতা এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি ঘাটতির সুযোগ নিয়ে ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে অবৈধ সিগারেটের এই বাজার।

করোনা অতিমারির কারণে সার্বিক রাজস্ব আদায়ে প্রভাব পড়লেও সিগারেট খাতের রাজস্বে বরং প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি বছর সিগারেট খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় আশা করা হচ্ছে প্রায় ২৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী এটি অপরাপর যেকোনো খাত থেকে বেশি।

অন্যদিকে সিগারেট খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর বাজেটে সিগারেটের দাম বৃদ্ধি হয়। এ কারণে মানুষ যেহেতু কম দামি সিগারেটের দিকে ঝুঁকছে, সে কারণে বেড়ে চলেছে অবৈধ সিগারেটের বাজার। ব্যবসায়ীরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন করছেন। বিক্রির জন্য বেছে নিচ্ছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোকে। কারণ সেখানে পুলিশ বা রাজস্ব কর্মকর্তাদের নজরদারি বা অভিযান নেই।
দেশে সর্বনিম্ন ১০ শলাকার এক প্যাকেট সিগারেটের নির্ধারিত দাম ৩৯ টাকা। কিন্তু মফস্বল ও গ্রামের বাজারে ২০-২৫ টাকায় এক প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যাচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার বাজার পরিদর্শন করে দেখা গেছে, কম দামে বিক্রির মূলে রয়েছে রাজস্ব ফাঁকি। অন্য অনেক ব্যবসার মতো এ ক্ষেত্রেও কোম্পানিগুলোর মুনাফা বা টিকে থাকার প্রধান উৎস হচ্ছে কর বা রাজস্ব ফাঁকি।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, সিগারেটের মূল্য থেকে সরকার গড়ে প্রায় ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব আয় করে থাকে। যার মধ্যে আছে সম্পূরক শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর ও স্বাস্থ্য বা হেলথ সারচার্জ। অনেকেরই জানা আছে অসাধু উৎপাদনকারীরা সিগারেটের প্যাকেটের গায়ে নকল ব্যান্ডরোল/ট্যাক্স স্ট্যাম্প ব্যবহার করার মাধ্যমে প্রায়ই শুল্ক ফাঁকি দেন।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, দেশের বাজারে নিম্নস্তরের সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ২৫টির বেশি। তবে এর মধ্যে আইন মেনে নির্ধারিত মূল্যে সিগারেট বিক্রি করে মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান। বাকি উৎপাদকেরা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সিগারেট বিপণন করে। এসব প্রতিষ্ঠান শুধু রাজস্ব ফাঁকি দেয় না বরং অনিয়মতান্ত্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামগ্রিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

ছাড়পত্র ছাড়া সিগারেট উৎপাদনের অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৭০ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। জরিমানা পরিশোধ না করে আরও বৃহৎ পরিসরে অবৈধ সিগারেট উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ায় গত বছর প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেওয়া হয়।
এনবিআরের গোয়েন্দা সেলের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন সিনেমা হল, রাইস মিল, তেলের মিলের আড়ালে এবং জনবসতিপূর্ণ স্থানে আইনের তোয়াক্কা না করে উৎপাদন চলে মানহীন এসব অবৈধ সিগারেটের। অধিকন্তু পরিবহনে ভ্যাট চালান বাধ্যতামূলক হলেও তা এড়াতে কুরিয়ার সার্ভিসে এসব অবৈধ সিগারেট পরিবহন করা হয়।

বর্তমানে প্রচলিত চারটি মূল্যস্তরের মধ্যে শুধু নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তাই প্রায় ৭০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নিম্নস্তরের সিগারেটের মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। ফলে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া সিগারেটের প্রসার হয়। ওই অর্থবছরে এনবিআরের প্রায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। এ রকম রাজস্ব ফাঁকি এড়াতে ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সহনীয় পর্যায়ে সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি করা উচিত বলে মনে করছেন এ খাত সম্পর্কিত বাজার জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা।
এমনকি তামাকবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের গবেষণায় দেখা গেছে, নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তা সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ।

অতিমারির কারণে এমনিতেই তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এমন অবস্থায় সিগারেটের দাম বৃদ্ধি পেলে নিম্নস্তরের সিগারেটের ভোক্তারা কম দামি অবৈধ সিগারেটের দিকে ঝুঁকবে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন বাড়বে, পাশাপাশি বড় ধরনের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে সরকার। উৎসাহ পাবে কর ফাঁকি দেওয়া সিগারেট উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

যে সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যগুলো কর ফাঁকি দিয়ে বা চোরাচালান হয়ে আসে সেগুলোই অবৈধ। আবার দেশের ভেতরেই অনেকগুলো আছে, যারা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। কোনো ধরনের লাইসেন্স নেই। এগুলোও অবৈধ সিগারেট। ধোঁয়াহীন তামাক, যেমন জর্দা, গুল, এসবও কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই তৈরি ও বাজারজাত হয়।

পুরো বিষয়টাই কিন্তু আসলে করজালের বাইরে রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের যে প্রচলিত কর আইন আছে, সেগুলোরই বরং বেশি করে কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
কোনো ধরনের বাজার গবেষণা না করে, খাতসংশ্লিষ্ট বৈশ্বিক মানের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে কথা না বলে শনৈঃশনৈঃ সিগারেটের ওপর কর বাড়ালে অবৈধ বা কর ফাঁকি দেওয়া কিংবা নিম্নমানের সিগারেট বা তামাকজাত পণ্যের উৎপাদন ও বিক্রয়ই উৎসাহিত হবে। আজীবন অধূমপায়ী জন-অর্থনীতির একজন বিশ্লেষক হিসেবে আমি এ ব্যাপারে প্রায় নিশ্চিত।

হিসাব-নিকাশ না করে অপেক্ষাকৃত ভালো পণ্যের দাম বাড়ালে বেশির ভাগ ভোক্তা অকস্মাৎ ধূমপান ত্যাগ না করে নিম্নমানের বা কর ফাঁকি দেওয়া অবৈধ তামাকজাত পণ্যের দিকে যাবেন। কয়েক বছর ধরে দেখেছি কিছু জনপ্রতিনিধি বা কর্তাব্যক্তি বরং নিম্নমানের বিড়ির ওপর কর কমানো বা না বাড়ানোর পক্ষে সাফাই গাইছেন। ধূমপান করলে মানুষ যাতে নিম্নমানের তামাকজাত পণ্য বা সিগারেটে আসক্ত না হয়, সেটাও যথাযথ কর্তৃপক্ষের দেখার দায়িত্ব রয়েছে।

স্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি বিবেচনায় আমরা অবশ্যই ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করব। বেশির ভাগ দেশেই বাংলাদেশের মতো এত উচ্চ না হলেও সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের ওপর অধিক হারে করারোপ করা হয়। তবে সিগারেটের ওপর কর বাড়ালেই ধূমপায়ীরা ধূমপান একেবারে বাদ দেবেন, তা কিন্তু নিশ্চিত নয়। আমরা বরং দেখতে পাচ্ছি, ক্রমাগত কর বৃদ্ধিতে সিগারেটের দাম বেড়ে যাওয়ায় বড় কোম্পানিগুলো নিরুৎসাহিত হচ্ছে আর নিম্নমানের ও প্রায় অবৈধ সিগারেট ও বিড়ি উৎপাদনকারীরা কর তো ফাঁকি দিচ্ছেই পাশাপাশি সস্তা ও ক্ষতিকারক তামাকজাত পণ্য সেবনে সাধারণ মানুষকে অনেকটা প্রণোদিত করছে।

কর কর্তৃপক্ষের জন্য বিষয়টি সুকঠিন, বিশেষ করে যেখানে তাদের করের বড় অংশ আসে সিগারেট, টেলিকম আর আর্থিক খাত থেকে। তারপরও চেনা বাক্সের বাইরে গিয়ে ভাবারও বিকল্প নেই।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক