সবাই স্বীকার করেন বাংলাদেশের ইতিহাসে একদা ছাত্ররাজনীতি এক উজ্জ্বল অধ্যায় রচনা করেছে। ভাষা আন্দোলন, আইয়ুববিরোধী আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের নেতৃত্ব গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। সাধারণত নির্বাচিত ছাত্রসংসদের নেতৃত্ব এই ভূমিকা রেখেছে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন। ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যায় ছাত্ররাজনীতির ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পর ছাত্ররাজনীতির এক নেতিবাচক ভূমিকা লক্ষ করা যায়। কারণ, এই সময় থেকে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়নি। ফলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনটি ছাত্ররাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছে। ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে ছাত্রদের মধ্যে একধরনের ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন পাওয়ার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো কিছু কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে। এই সময়ে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়, বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শুরু হয় এবং ছাত্রনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন। আজকে যাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত নেতা, তাঁদের অধিকাংশই ছাত্ররাজনীতি থেকে আসা। ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের অভাবে নেতাদের ছাত্রজীবন প্রলম্বিত হচ্ছে। নিয়মিত ছাত্রসংসদ নির্বাচন হলে তাঁরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারেন এবং একটা সময় ছাত্ররাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার জন্য একধরনের স্বীকৃতিও পেয়ে যান।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কর্মরত শিক্ষকদের নির্বাচন হয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের নির্বাচন হয়, কিন্তু যাঁদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, সেই ছাত্রদের নির্বাচন হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকসু ভবন আছে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও ছাত্রসংসদ ভবন আছে। এই ভবনগুলোতে বর্তমানে কী কাজ হয়, তা আমার জানা নেই। নির্বাচিত সংসদ থাকলে অবশ্যই কর্মচাঞ্চল্যে ভরা থাকত এই ভবনগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কারণে-অকারণে বন্ধ হয়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন মাঝেমাঝেই টালমাটাল অবস্থায় পড়ে। নির্বাচিত ছাত্রসংসদ থাকলে ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারত।
একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিপুল টাকা লগ্নি হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বেরিয়ে আসা শিক্ষার্থীরা দেশের প্রশাসনে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে, চিকিৎসাবিদ্যায়, প্রযুক্তিতে সর্বোপরি রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব সৃষ্টির প্রয়োজনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর সব রাজনৈতিক দলের যথার্থ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। যদিও এ দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা, মধ্য আয়ের যেকোনো মানুষ ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুল ও বিদেশে পাঠাতে প্রবল আগ্রহী। বিদেশে না পাঠাতে পারলে অন্ততপক্ষে দেশের যেকোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান, উদ্দেশ্য বিদেশযাত্রা। বিপুলসংখ্যক দায়িত্বশীল নাগরিক যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে যথার্থ আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা না করে বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তাহলে শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতিই বা কী করে হবে। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বড় সংকট দেখা যাচ্ছে। ছাত্ররা কোনো অবস্থাতেই যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী হয়ে উঠছে না, এদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়েও নতুন ভাবনা অবশ্যই করতে হবে।
দেশটাকে গণতান্ত্রিক করতে হলে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি পরিবার থেকে সূচনা হলে সুবিধা হয়। ছাত্র নেতৃত্বের ক্ষেত্রে মেধাবী ছাত্রদের অগ্রাধিকার থাকা উচিত। যদিও মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতিবিমুখ। সুস্থ রাজনীতি ছাড়া সমাজ এগোবে না, এ এক চিরন্তন সত্য। এই সত্যকে সামনে রেখে ছাত্ররাজনীতিতে সুস্থ ধারা অনুসরণ করার লক্ষ্যে রাজনীতিবিদ, অভিভাবক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনমুখী। নির্বাচনকে তারা উৎসব বিবেচনা করে। বর্তমানে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভাসছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের নাগরিকেরা। রাজনীতির আকাশে মেঘ কিছুটা হালকা হয়েছে। নির্বাচনকে তারা আন্দোলন ভাবতে শুরু করেছে। নির্বাচন একধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। শিক্ষাঙ্গনে তেমনি একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে ছাত্ররাজনীতির নেতিবাচক দিকের হয়তো একটা অবসান হবে। কিন্তু এই পরিবেশ সৃষ্টি করাটাও খুব সহজ কাজ নয়।
কারণ, গত ২৪ বছর যে আবর্জনা জমেছে, তা রাতারাতি পরিষ্কার করা সম্ভব না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোভাব ও সংস্কৃতিটাও প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থায়। পরমতসহিষ্ণুতা নেই, অসহিষ্ণুতাই মুখ্য একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এখান থেকে উঠে আসার জন্য শিক্ষকদের একটা বড় ভূমিকা পালন করতে হয়।
কিন্তু শিক্ষকেরাও বিভক্ত নানা দলে। শিক্ষকদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই পাওয়া যাবে, যাঁরা দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে। একদা সিভিল সোসাইটির অগ্রভাগে ছিলেন শিক্ষকেরা, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে তাঁরাই ছিলেন মুক্তবাক। তাঁদের কণ্ঠস্বরে শোনা যেত আমজনতার কণ্ঠ, যথার্থই সিভিল ভয়েস। শিক্ষকদের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছাত্ররাজনীতি। তবু কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয়, তাহলে আশা করা যায়, ছাত্ররাজনীতিতেও একটা সুবাতাস বইবে এবং ভবিষ্যতে তা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।