কচুরিপানা মানা না-মানা
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, প্রতিদিন নতুন নতুন চিন্তা, উদ্ভাবন আসছে। আগে মাশরুম দেখলে বলা হতো ব্যাঙের ছাতা, নিষিদ্ধ খাবার। এখন তা খাওয়া হচ্ছে। হয়তো এমন দিন আসবে, কচুরিপানা থেকেও খাবার আবিষ্কৃত হবে। মন্ত্রী মহোদয় অযৌক্তিক কিছু বলেননি। কারণ, আজ যা ফেলনা বা অচ্ছুত মনে হচ্ছে, পরবর্তী সময়ে তা খাবার হয়ে যাওয়ার ঘটনা তো কম নয়।
এর আগে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কথায় কচুরিপানার একটি প্রসঙ্গ হইচই তুলে পাদপ্রদীপে আসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল। খাবার হিসেবে এটি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে সরস আলোচনায় মেতেছেন অনেকে। মজা করে রসে ভরা রেসিপি দিচ্ছেন।
কচুরিপানার ফুলের রেসিপি অবশ্য আছে। এই ফুলের পাকোড়া একবার অবশ্য খেয়েছি। সেটা শৈশবে। এক ফুফাতো বোনের বিয়েতে ‘সাগরানা’ বলে পরিচিত বরকে দেওয়া বিশেষ ভোজে আমিও ভাগ বসিয়েছিলাম। সেখানে লম্বাটে কী একটা মুচমুচে জিনিস মজা করে খেলাম। পরে শুনি যে ওটা কচুরিপানার ফুল। নতুন জামাইকে সাত রকমের ফুল ভেজে খাওয়াতে হয়, সেই ঐতিহ্যে যোগ হয়েছে ফুলটি। এরপর আর চেখে দেখিনি বা সুযোগ হয়নি। কারণ, এটা আমাদের ঘর-দুয়ারের প্রচলিত খাবার নয়। এ নিয়ে সবারই কমবেশি খুঁতখুঁতে ভাব থাকা স্বাভাবিক। তাই বলে গাঁও-গেরামের এই সহজলভ্য জিনিসকে খাদ্য হিসেবে বিবেচনায় আনার মতো গবেষণা চালাতে সমস্যা কোথায়?
গানে আছে, ‘থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিপানা...’। বাঙালি জীবনে কলহ-বিবাদেও প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় কচুরিপানা। প্রতিপক্ষের কথায় তেড়ে গিয়ে অপরজন বলে, ‘ভেসে আসা কচুরিপানা পেয়েছিস, ঠেলা দিলেই সরে যাব!’
গানের এই কলি আর বাগ্যুদ্ধের বুলিতেই বোঝা যায় এটি কত সহজলভ্য জিনিস। জনবহুল দেশগুলোয় মৌলিক চাহিদাগুলোর মধ্যে সাধারণত খাদ্য নিয়ে প্রায়ই একটা সংকট তৈরি হয়। সোয়া শ কোটি মানুষের দেশ চীনে খাদ্যসমস্যা মেটাতে কত কিছুই না খাবার হিসেবে যোগ হচ্ছে। পোকামাকড় থেকে শুরু করে হেন জিনিস নেই যে তারা খায় না। এমন অনেক চীনা খাদ্য আছে যে আমরা নাম শুনলেই নাক সিটকাব, পেট চেপে ধরে বেসিনের দিকে দৌড়াব, কিন্তু এসব দেখলে তাদের চলবে না। পেটে কিছু দিয়ে বেঁচে তো থাকতে হবে।
আমাদের দেশও এ অঞ্চলের একটি জনবহুল দেশ। ভূমির তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। নিত্যনতুন খাদ্যসংকট লেগেই আছে। এখানে খাবারে ইনোভেশন বা নতুন নতুন খাবারের প্রচলন হওয়াটা জরুরি। জনবহুল দেশ নির্দিষ্ট কিছু খাবারের ওপর নির্ভরশীল হলে তা কোনো না কোনো সময় দুর্গতি ডেকে আনে। এক পেঁয়াজই কত খেল দেখাল! নতুন পেঁয়াজ এসে গেছে, এরপরও দেশি পেঁয়াজের দাম এক শ টাকার নিচে নামছেই না। আমদানির অপ্রতুলতা বা ব্যবসায়ী চক্রের কলকাঠিকে যতই দোষ দিই না কেন, পেঁয়াজনির্ভর জীবন বলেই কিন্তু এমন পরিস্থিতি। পেঁয়াজকে গয়রহভাবে বাদ দিতে পারলে হয়তো পেঁয়াজ ফুলে কলাগাছ হতো না।
আমাদের দেশ মানবসম্পদের যেমন বিশাল আধার, তেমনি উদ্ভিদও কম নেই। ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে গেলে সমবয়সী অনেকের সঙ্গে বিলে ঘুরতে যেতাম। ওই সময় জলজ কিছু উদ্ভিদের কাণ্ড, ফুল ও ফল খেয়েছি। যেগুলোর নাম মনে নেই, কিন্তু কচি মুখে এর স্বাদ মন্দ লাগেনি। কাঁচা ঢ্যাপ যে কত খেয়েছি, এর হিসাব নেই। শাপলা লতাও কিন্তু কাঁচা খাওয়া যায়। কাজেই খাল–বিলের জলজ সম্পদ বা বনজ উদ্ভিদ থেকে খাদ্য অন্বেষণ করলে এবং তা থেকে নিয়মিত খাওয়ার মতো কিছু পেলে আমাদের খাদ্যঘাটতিই পূরণ হবে।
কচুরিপানা বাঙালির গ্রামীণ জীবনের ঐতিহ্য ও সুন্দর একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি আমাদের খাদ্য হিসেবে প্রচলিত না হোক, অন্যভাবে উপকার করে থাকে। কচুরিপানা থেকে একধরনের কাগজ উৎপাদন বহু আগেই শুরু হয়েছে। তা দক্ষিণাঞ্চলে অনেকের গ্রামীণ জীবনের এনে দিয়েছে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য। এই কাগজ বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে তথ্যচিত্রে দেখলাম। কচুরিপানা নদী, পুকুর বা জলাশয়ে যেখানে থাকে, সেখানে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর বিচরণ থাকে বেশি। হাটবাজারে খাল, বিল ও নদীর মাছ নিলে এতে সিলছাপরের মতো মাছের ওপর কচুরিপানা সাজানো থাকে। মানে, এটা চাষের মাছ নয়। সাচ্চা প্রকৃতির সন্তান।
কচুরিপানা রোদ ঠেকায় বলে পানাপুকুরের পানি হয় হিমশীতল। গরমকালে এ পুকুরে গোসল করে বেশ আরাম। অবশ্য শীতকালে এ পুকুরে নামা দায়। তখন এই পুকুরের পানি একেবারে বরফগলা জল। গ্রামে পাকা ভবনের মেঝের আস্তর মজবুত করতে পানিসহ কচুরিপানা দেওয়া হয়। পানির বাষ্পীভবন ঠেকায় এ পানা।
শুনেছি, শোল মাছ দিয়ে কচুরিপানার ঝোলের প্রচলন কোথাও কোথাও আছে। জানি না সে ঝোল কেমন। জানি না এর পুষ্টিগুণ বা খাবার হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। তবে কচুরিপানা যদি কলমি শাক বা শাপলার মতো জলজ উদ্ভিদের মতো নিজগুণে আমাদের খাদ্যতালিকায় সেভাবে জায়গা করতে নিতে পারে, এতে মন্দ কিছু তো দেখি না।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক
[email protected]