রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে কোনো কথা নেই। আজ যে শত্রু, কাল সে বন্ধুও হতে পারে। তারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখন। কংগ্রেস ও সিপিএম পরস্পর বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে দীর্ঘদিন ধরেই। ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভা বা ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এই দুটি দল পৃথকভাবে নির্বাচন করেছে। তবে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল ২০১১ সালে। সেই বাম দল বা সিপিএম রাজনৈতিক কারণেই এবার কংগ্রেসের দিকে হাত প্রসারিত করেছে। কিন্তু কেন? জাতীয় কংগ্রেস একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৩০ বছরের এই পুরোনো দলটি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছিল ‘সাম্প্রদায়িক’ আদর্শে লালিত বিজেপির কাছে। ফলে ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে বিজেপির মতো একটি সাম্প্রদায়িক দলের উত্থানকে মেনে তিনি পারেনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি। কংগ্রেস এখনো অসাম্প্রদায়িক দল। ধর্মনিরপেক্ষতা তাদের আদর্শ। সিপিএমের আদর্শও ধর্মনিরপেক্ষতা।
এই প্রেক্ষাপটে আগামী বছরের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে এই দুটি দল কমাচ্ছে দূরত্ব। নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অন্যান্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি হালে পানি পেতে শুরু করেছে। আগে রাজ্যে বিজেপির ভোটের হার ছিল মাত্র ৪ শতাংশ, এখন তা বেড়ে হয়েছে ১৮ শতাংশ। বিজেপির এই উত্থানকে মেনে নিতে পারছে না ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেস এবং বাম দলগুলো। বিশেষ করে সিপিএম। দ্বিতীয়ত, এই রাজ্যের শাসনক্ষমতায় এখন তৃণমূল। তৃণমূলও ক্ষমতায় আসার পর এই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি হয়নি। শিল্পায়ন হয়নি। সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে শাসক তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়ক।
এখনো ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প বা চিটফান্ডের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে চলছে আন্দোলন। জনগণ সরকারি দলের ওপর বিতৃষ্ণ হলেও ২০১৬ সালের নির্বাচনে মমতা ফের ক্ষমতায় আসবেন বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। কিন্তু এটা মানতে চাইছে না কংগ্রেস, বিজেপি বা বাম দলগুলো। এই তিন দলের এখন লক্ষ্য একটাই, মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করা। কিন্তু এটা যে এককভাবে সম্ভব নয়, সেটা এখন কংগ্রেস, বিজেপি বা সিপিএমের নেতারা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। কারণ, এই তিনটি দলের কারোর শক্তি নেই এককভাবে লড়ে তৃণমূলকে হটানোর। বরং তৃণমূলের সঙ্গে এই তিনটি দল বা জোট পৃথকভাবে নির্বাচন করলে আখেরে লাভবান হবে তৃণমূল। ভোটের হিসাবে এগিয়ে যাবে তৃণমূল। আবার কংগ্রেস বা সিপিএম কোনোভাবেই নির্বাচনী জোট করবে না ‘ধর্মান্ধ’ বিজেপির সঙ্গে। তাই একটি মাত্রই পথ এখন খোলা কংগ্রেস এবং সিপিএমের নেতৃত্বাধীন বামজোট যদি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে একজোট হয়ে লড়তে পারে, সে ক্ষেত্রে হয়তো তৃণমূলকে বিরাট চাপের মধ্যে রাখা যাবে।
>রাজ্যের মানুষ এখন চাইছে তৃণমূল রাজ্যপাট থেকে সরে যাক। সে জন্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন
তাই পশ্চিমবঙ্গ থেকে তৃণমূলকে হটিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এখন এই দুটি দল বা জোট পরস্পরের কাছাকাছি আসছে। কংগ্রেসও জানে বাম দলের সঙ্গে জোট হলে তৃণমূলকে বেগ দেওয়া যাবে। তাই এখন কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও বাম দলের নেতাদের কাছে এই নয়া সমীকরণের বার্তা যেতে শুরু করেছে। বাম দলও জানে, তাদের একার পক্ষে তৃণমূলকে হটানো সম্ভব নয়। হটাতে গেলে সঙ্গী চাই কংগ্রেসকে। আর এসব হিসাব–নিকাশ করেই এই দুটি দল বিপরীত মেরুতে অবস্থান করলেও ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে পরস্পরের কাছাকাছি আসতে শুরু করেছে। আর তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতা গৌতম দেবের কণ্ঠে। ১৯ জুন বারাসাতে এক সংবাদ সম্মেলনে এই দুই দলের নির্বাচনী জোট হওয়ার পক্ষেই ইঙ্গিত দেন তিনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম দলের নির্বাচনী কৌশল কী হবে—সেই প্রশ্নের জবাবে গৌতম দেব সরাসরি জানিয়ে দেন, কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা হতেই পারে। তবে সেই সম্ভাবনা এখনো তৈরি হয়নি। ভবিষ্যৎই বলবে। এরপর গৌতম দেব ওই দিনই কলকাতার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মোদি-মমতাকে হারাতে বামদের অনেক দূর যেতে হবে। বামেরা যাবে।’
এদিকে তৃণমূলকে হারাতে কংগ্রেসের সঙ্গে কৌশলী নির্বাচনী বোঝাপড়া হওয়া উচিত বলে মনে করছে সিপিএমের একাংশ। গৌতম দেব এ দিন এ কথাও বলেন, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন প্রথম ইউপিএ সরকারকে বামেরা সাড়ে চার বছর সমর্থন করেছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও বিভিন্ন ইস্যুতে কংগ্রেসের সঙ্গে আন্দোলন করেছে বামেরা। সারদা-কাণ্ডে প্রতারিতদের আন্দোলনে কংগ্রেসের শরিক হয়েছিল তারা। সুপ্রিম কোর্টে সারদা নিয়ে কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের দায়ের করা মামলায় লড়েছেন প্রখ্যাত আইনজীবী, কলকাতার সাবেক মেয়র ও সিপিএম নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য। গৌতম দেব আরও বলেছেন, ‘আমরা একা লড়াই করে তৃণমূলকে হারাতে পারব না। তাই সিপিআইএমএল (লিবারেশন) এবং এসইউসিআইয়ের সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্য গড়েছি। মমতা চরম “কর্তৃত্ববাদী” নেত্রী। মমতা ও নরেন্দ্র মোদিকে সরানোর জন্য আমাদের বাড়তি পথ হাঁটতে হলে আমরা হাঁটব।’
আর এসব আলোচনার মাঝেই কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা আবদুল মান্নান জানিয়ে দেন, রাজ্যের মানুষ এখন চাইছে তৃণমূল রাজ্যপাট থেকে সরে যাক। সে জন্য গণতান্ত্রিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেছেন, এক বছর আগে তিনি কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, বিজেপি ও তৃণমূল কংগ্রেসকে ঠেকাতে বামদের সঙ্গে হাত মেলানো দরকার। কংগ্রেসের সাবেক রাজ্য সভাপতি সোমেন মিত্রও মনে করেন, জোট ছাড়া গতি নেই। তৃণমূলকে ঠেকাতে রাজ্যে একটি ধর্মনিরপেক্ষ জোটের প্রয়োজন। এটা সম্ভব হলে তৃণমূলকে ঠেকানো যাবে। আর অন্যদিকে সিপিএম নেতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্যামল চক্রবর্তী এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, জোট হতেই পারে। হাজার দুয়ারির হাজার দরজা রয়েছে। এর মধ্যে যেকোনো একটি দরজা খুলে যেতে পারে। এই নিয়ে দলে আলোচনাও হতে পারে। আর এসব আলোচনার মাঝে তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, বিরোধীরা যা–ই বলুক, আগামী বছরের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে তারাই জিতবে।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।