ওমানে ঘূর্ণিঝড়, হাতিয়া-সন্দ্বীপে কান্নার রোল!
ঘূর্ণিঝড় মেকুনু ওমানের উপকূলে আঘাত হানতে শুরু করেছে, আর কান্নার রোল উঠেছে বাংলাদেশের হাতিয়া-সন্দ্বীপ এলাকার অনেক পরিবারে। ৩০ থেকে ৫০ হাজার বাংলাদেশি জেলে ওমান সাগরে ভাসমান জীবন কাটান। ঘূর্ণিঝড় মেকুনু তাঁদের হুমকির মুখে ফেলছে। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় মেকুনুর মূল কেন্দ্র বা ঘূর্ণিঝড়ের আবস্থান ছিল ওমানের উপকূলীয় শহর সালালা থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে। এই উপকূলেই প্রতারিত বাংলাদেশি জেলেরা সাধারণ নৌকায় বা পলিথিনের দুর্বল ঝুপড়িতে বসবাস করেন। সালালা ছাড়াও উপকূলীয় শহর দুখুমেও প্রধানত হাতিয়ার প্রবাসী শ্রমিকদের বাস। সন্দীপ-মনপুরার কিছু মানুষ এখানে থাকলেও হাতিয়ার জাহাজমারার মানুষের সংখ্যাই সেখানে বেশি। বেআইনিভাবে তাঁরা বেদুইনদের নৌকায় মাছ ধরেন। বেদুইনদের বেদেজীবন থেকে থিতু, তথা সভ্য জীবন-জীবিকায় ফিরিয়ে আনার জন্য সে দেশের সরকার বেদুইনদের জেলে বানানোর এক তুঘলকি কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে কয়েক দশক ধরে। এই কর্মসূচির সহজ শিকার হয়েছেন আমাদের নদীভাঙা কতিপয় দ্বীপ আর উপকূলের সব-হারানো মানুষ। তাঁদের চাকরির কথা বলে ওমানে নিয়ে গিয়ে বেদুইনদের কাছে বেচে দেওয়া হয়; ধারদেনা করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশ ছাড়া এই নিরুপায় মানুষদের ক্রীতদাসের জীবন মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ে ৫ জন নিহত ও ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছেন।
বেদুইনদের নৌকায় যেকোনো বিদেশি সে দেশের আইনের চোখে অপরাধী। তাই তাঁদের ডাঙায় এসে স্বাভাবিক চলাফেরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক ভারতীয় আর পাকিস্তানি ব্যবসায়ী বেদুইনদের কাছ থেকে নৌকা ইজারা নিয়ে সেখানে বাংলাদেশিদের খাটাচ্ছেন। মজুরির কোনো ঠিকঠিকানা নেই। মাছ পেলে মজুরি, না পেলে নেই। মাছ পেলে মজুরি ঠিক হয় সেদিন বাজারে ওই মাছের দরের ওপর। যেহেতু নৌকা আর সাগরপাড়ের অস্থায়ী ঝুপড়ি ছাড়া এই জাল-‘ক্রীতদাসেরা’ পুলিশের ভয়ে কোথাও যেতে পারেন না, তাই বাজারের হাল-হকিকত দর-বেদর তাদের জানা হয় না। মালিক যে দর এলান করেন, সেটাই মজুরদের মেনে নিতে হয়। লিজ নেওয়া ভারতীয়-পাকিস্তানিদের ভিড়ে দু-একজন বাংলাদেশি ভাগ্যবান ক্যাপ্টেনও আছেন। তবে নিষ্ঠুরতায় আর প্রতারণায় কেউ কারও থেকে কম নয়।
আমাদের ওমান দূতাবাস আবার ধরা-খাওয়া এসব মানুষের অস্তিত্বই স্বীকারই করে না। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে আইনি সহযোগিতা দূরে থাক, হাসপাতাল বা জেলখানায় গিয়ে দেখা করা বা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলার কোনো রেওয়াজ গবেষকদের চোখে পড়েনি। সম্প্রতি ওমানের উপকূলে কর্মরত হাতিয়া-সন্দ্বীপের শ্রমিকদের জীবন নিয়ে গবেষণারত একজন ফরাসি গবেষক ড. মেরি পেকটের তেমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে। অন্যদিকে, ভারত বা পাকিস্তানি দূতাবাস তাদের নাগরিকদের পুলিশের হাত থেকে ছাড়িয়ে বিচারপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে যথেষ্ট তৎপর থাকে। ওমানের কারাগারে অমানুষিক যন্ত্রণা ভোগ করে প্রায় ছয় মাস জেল খেটে সম্প্রতি খালি হাতে ফিরে আসা এক যুবক হাতিয়ার জাহাজমারায় বসে এই প্রতিবেদককে একই ধরনের কথাই বলেছেন। আমাদের দূতাবাসের মানুষেরা আইন মেনে চলেন। তাঁদের মতে, যেহেতু কাগজে-কলমে জেলে হিসেবে ওমান বাংলাদেশ থেকে কোনো জনশক্তি আমদানি করে না, তাই সেখানে কোনো জেলে থাকতে পারেন না বা নেই। কেউ থাকলে তিনি বেআইনি অভিবাসী। তাঁরা কেন অবৈধদের দায়িত্ব নিয়ে দেশের মান খোয়াবেন? এমন ধরনের যুক্তি তাঁদের কাজ সহজ করে দিলেও অসহায় বাংলাদেশিদের কোনো কাজে লাগে না।
এই ঝড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য কোথাও যেতে পারবেন না পুলিশের ভয়ে, মালিকেরাও তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবেন না। গতকাল পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে ভারত তার জেলেদের উদ্ধারের জন্য মুম্বাই থেকে দুটো উদ্ধারকারী জাহাজ (আইএনএস দীপক ও আইএনএস কচি) ওমান উপকূলে পাঠিয়েছে। উচিত হবে, আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রকে অনুরোধ করা যেন এই জাহাজ দুটি আমাদের হতভাগ্য জেলেদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
গত সাইক্লোন মোরার সময় অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করে আমাদের জলসীমায় এসে ভারতীয় নৌবাহিনী আমাদের বিপন্ন জেলেদের উদ্ধার করেছিল। এবারও চাইলে তারা পারবে। একদিন আমির হয়ে দেশে ফিরে আসার অসম্ভব আশা বুকে নিয়ে সাগরে যেন বেঘোরে কোনো বাংলাদেশির প্রাণ না যায়। দেশে অপেক্ষায় থাকা প্রিয়জনেরা যেন জানতে পারে, তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে। আমাদের দূতাবাসের কর্মকর্তারা একটু ভাবুন এঁদের কথা। তাঁদের পরিবার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত। ‘তাদের পয়সায় আমাদের বেতন হয়’—বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাকে এই কথাই বারবার বলেছিলেন।
গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।