এশিয়ায় পানির সংকট ক্রমেই বাড়ছে, তবে সেটা শুধু সমুদ্রসীমার দ্বন্দ্ব নিয়ে নয়। দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা নিয়ে চীনের সঙ্গে অন্যদের যে দ্বন্দ্ব, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ আছে। এর সঙ্গে সমুদ্রসীমা ও নৌ চালনার ব্যাপার জড়িয়ে আছে, যার সঙ্গে অন্য দেশের স্বার্থ জড়িত। কিন্তু অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কৌশলগত প্রতিযোগিতার যে নানা রূপ দেখা যাচ্ছে, তা-ও কিন্তু কম শঙ্কার কারণ নয়।
অন্য যেকোনো মহাদেশের তুলনায় এশিয়ায় মাথাপিছু পানির পরিমাণ সবচেয়ে কম। এমআইটির এক সমীক্ষা অনুসারে, সেখানে ইতিমধ্যে পানির সংকট শুরু হয়ে গেছে। এটা আরও তীব্র হবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়ায় পানির সংকট সৃষ্টি হয়ে যাবে। একদিকে ভূরাজনীতিতে চলছে ব্যাপক মতানৈক্য, অন্যদিকে সুপেয় পানি নিয়ে যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাচ্ছে, তা এশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। কথা হচ্ছে, এই লড়াই ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, যেখানে চীন প্রধান আগ্রাসী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরে সে কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়ে দখলদারি চালাচ্ছে। একই সঙ্গে তারা অনেকটা নীরবেই আন্তর্জাতিক নদীর অববাহিকাও দখল শুরু করছে। তারা মূলত আন্তর্জাতিক নদীর পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে এশিয়ায় নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব বিস্তার করছে।
এই কৌশল বাস্তবায়নে চীন বর্তমানে খুবই শক্তিশালী অবস্থায় আছে। সেখানে যত নদীর উৎপত্তি হয়েছে, তা অন্য কোনো দেশে হয়নি। দেশটি থেকে ১১০টি আন্তর্জাতিক নদী ও হ্রদ বেরিয়ে ১৮টি উজানের দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বাঁধও আছে চীনে। পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে তারা কখনোই এর ব্যবহারে পিছিয়ে থাকেনি। তাদের চোখ এসব আন্তর্জাতিক নদীর ওপর।
চীনের এসব আন্তর্জাতিক নদীর বেশির ভাগের উৎস হচ্ছে তিব্বতের মালভূমি, যাকে তারা ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে দখল করে নিয়েছিল। ফলে তিব্বতে যে প্রচুর বাঁধ হচ্ছে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। সম্প্রতি চীনে যে ত্রয়োদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা হয়েছে, সেখানেও তিব্বতে প্রচুর বাঁধ নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া চীন সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা নদীর প্রবাহ বন্ধ করে দিয়েছে, যেটা বাংলাদেশ ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জীবন। তিব্বতে একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অংশ হিসেবে তারা এটি করেছে। এমনকি তারা ব্রহ্মপুত্রের আরেকটি শাখা নদী আটকে বাঁধ নির্মাণের কথা ভাবছে। এটা বন্ধ করে তারা কয়েকটি কৃত্রিম হ্রদ নির্মাণ করতে চায়।
এদিকে চীন মেকং নদীতে ছয়টি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছে, যে নদীটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রবাহিত হয়েছে। সেখানে এর প্রভাব ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তা সত্ত্বেও চীন থামেনি, তারা এই নদীতে আরও কটি বাঁধ নির্মাণ করতে চায়। একইভাবে চীন ইলি নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করায় মরুময় মধ্য এশিয়ায় পানির সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সম্ভাবনা আছে, কাজাখস্তানের বলখাশ হ্রদ অনেকটাই শুকিয়ে যেতে পারে, যার অবস্থা অনেকটা উরাল হ্রদের মতো হতে পারে। এই বিশাল হ্রদটি ৪০ বছরেরও কম সময়ে একরকম শুকিয়ে গেছে। এখানেই শেষ নয়, চীন ইরতিশ নদী থেকেও পানি প্রত্যাহার করছে, যে নদীর পানি কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় সরবরাহ করা হয়। এই নদীর পানি রাশিয়ার ওবি নদীকেও সজীব রাখে।
আন্তর্জাতিক নদীর পানির প্রবাহ কমে যাওয়া মধ্য এশিয়ার একমাত্র সমস্যা নয়। ওদিকে জিনজিয়াংয়ে কৃষিসহ যেসব শিল্প–কারখানা চলছে, তার ঝুঁকিপূর্ণ সার ও রাসায়নিক এখানকার আন্তর্জাতিক নদীতে গিয়ে মিশছে। হান প্রদেশেও চীন একই কাজ করেছিল। হ্যাঁ, এটা ঠিক, পৃথিবীতে শুধু চীনই পানি নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করছে না। এটা বলা দরকার যে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের যে দ্বন্দ্ব রয়েছে, তার কারণ যেমন ভূমি, তেমনি পানিও। পাকিস্তান এক দশকের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো ১৯৬০ সালের সিন্ধু নদের পানিবণ্টন চুক্তি নিয়ে সালিসি ট্রাইব্যুনালে গেছে। ব্যাপারটা স্ববিরোধী, কিন্তু সত্য হচ্ছে, এটি দুনিয়ার সবচেয়ে উদার পানিবণ্টন চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও এবং পাকিস্তানকে ৮০ শতাংশ পানি দেওয়ার পরও তারা এই চুক্তিকে ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্ব জিইয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।
এদিকে ভূমিবেষ্টিত লাওস চীনকে জানিয়েছে, তারা ৯১২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পাক বেং বাঁধ নির্মাণ করতে যাচ্ছে। তারা মূলত চীনের কাছে জলবিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে। এর আগেও তারা যখন জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করেছে, তখনো তারা পানি প্রত্যাহারের ব্যাপারে অন্যদের আপত্তি অগ্রাহ্য করেছে। ফলে এবার তারা অন্যের কথা শুনবে, তেমনটা ভাবার কারণ নেই।
পানি নিয়ে এই ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার পরিণতি এ অঞ্চলের বাইরেও অনুভূত হবে। ইতিমধ্যে এশিয়ার কিছু দেশ সাব-সাহারা আফ্রিকা অঞ্চলে ভূমি লিজ নিয়েছে। তারা নিজেদের দেশে ফসল উৎপাদন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিল। কিন্তু এতে কিছু কিছু জায়গায় প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। ২০০৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার দেইউ কোম্পানি যখন মাদাগাস্কারের অর্ধেক চাষযোগ্য জমি লিজ নেওয়ার চুক্তি করেছিল, তখন যে প্রতিবাদ ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছিল, তাতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একটি সরকারের পতন হয়েছিল।
এই প্রতিযোগিতার কারণে এশিয়ার কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দেশগুলোর মধ্যে মারাত্মক অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতাও সৃষ্টি হচ্ছে। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। এশীয় দেশগুলোর উচিত হবে, পানি নিয়ে এই জল ঘোলা করার রাজনীতি নিয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা দেওয়া। একই সঙ্গে পানিবণ্টন নিয়ে আরও স্বচ্ছ চুক্তি হওয়া প্রয়োজন। কথা হচ্ছে, এশিয়া মহাদেশ পানি ব্যবস্থাপনার জন্য আরও সমন্বিত ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, অন্তত এখন সেটা সম্ভব নয়।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট। অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন।
ব্রহ্ম চেলানি: নয়াদিল্লির সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের অধ্যাপক।