এলএনজি নয়, দেশীয় গ্যাসেই সমাধান

বাংলাদেশ জুলাই মাস থেকে মধ্যপ্রাচ্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির মাধ্যমে দেশে গ্যাস-সংকট মেটানোর উদ্যোগ নিয়েছে। ইতিমধ্যে মহেশখালীর অদূরে সমুদ্রে স্থাপিত ভাসমান টার্মিনাল থেকে তরল এলএনজি গ্যাসে পুনঃরূপান্তর করে পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহের অপেক্ষায় রয়েছে। প্রাথমিকভাবে দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট হারে গ্যাস সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হলেও আগামী বছরের শুরু নাগাদ সরবরাহের পরিমাণ দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট করা হবে। কেবল তা-ই নয়, বরং সরকারি প্রাক্কলন (পিএসএমপি ২০১৬) অনুযায়ী দেশে আমদানি করা এলএনজির সরবরাহ ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি করা হবে, যার পরিমাণ ২০২০ সালে দৈনিক ১২০ কোটি ঘনফুট, ২০৩০ সালে ২২০ কোটি ঘনফুট এবং ২০৪০ সালে ৪২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত হবে।

এলএনজি একটি অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব জ্বালানি এবং বিশ্ববাজারে এটি পর্যাপ্তভাবে পাওয়া যায়, কিন্তু এটি একটি ব্যয়বহুল জ্বালানি। জাপান, কোরিয়া ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির দেশে নিজস্ব জ্বালানির অবর্তমানে আমদানি করা এলএনজি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ গ্যাসের যে সংকটে পড়েছে, তার তাৎক্ষণিক সমাধানে সাময়িকভাবে সীমিত পরিমাণ এলএনজি আমদানির যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ও ব্যাপকভাবে ব্যয়বহুল এলএনজিনির্ভর হলে এ দেশের অর্থনীতির ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ একটি গ্যাস-সম্ভাবনাময় দেশ, যেখানে পর্যাপ্ত অনুসন্ধানের মাধ্যমে যথেষ্ট পরিমাণ নিজস্ব গ্যাস আহরণ করা সম্ভব।
১.
এলএনজি কতটা ব্যয়বহুল এবং এটি দেশের গ্যাসের মূল্যকাঠামোকে কীভাবে প্রভাবিত করবে, বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে তা আলোচনা করা যায়। পেট্রোবাংলার হিসাবমতে, দেশে বিদেশি কোম্পানি ও দেশি কোম্পানির উৎপাদিত দেশীয় গ্যাসের গড় মূল্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৫.৩২ টাকা। বিশ্ববাজার থেকে এলএনজি ক্রয় করে তা দেশে সরবরাহ করতে মূল্য পড়বে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ৩৩.৪৪ টাকা। পেট্রোবাংলার সরবরাহব্যবস্থায় দেশীয় গ্যাস ও আমদানি করা এলএনজি গ্যাসের মিশ্রণ করে যে গ্যাস সরবরাহ করা হবে, তার দাম পড়বে প্রতি ঘনমিটারে ১২.৮৯ টাকা (গণশুনানি ২৪ জুন ২০১৮, পেট্রোবাংলা)। অর্থাৎ এলএনজি আনার কারণে দেশে গ্যাসের মূল্য প্রতি ঘনমিটার প্রায় ৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ১৩ টাকা হবে, যা কিনা দ্বিগুণের বেশি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বিভিন্ন খাতে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন মাত্রায় এই গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে।

গ্যাসের দাম যে সহসা আরও বৃদ্ধি পাবে, তার কারণ নিম্নরূপ। ওপরের হিসাবে আমদানি করা এলএনজির ক্রয়মূল্য ধরা হয়েছে প্রতি হাজার ঘনফুট ৮.৫ ডলার, যা স্থিতিশীল নয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজির মূল্য বৃদ্ধি পায়। পেট্রোবাংলা হিসাব করছে, এলএনজির মূল্য ইউনিটপ্রতি ৮.৫ ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ ডলার হওয়ার যে ইঙ্গিত দিচ্ছে, তাহলে বাংলাদেশে এটির সরবরাহ মূল্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাস প্রায় ৩৩ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৪১ টাকা হবে। সে ক্ষেত্রে এই এলএনজির সঙ্গে দেশীয় গ্যাস চলমান অনুপাতে মিশ্রণ করে যে দাম নির্ধারিত হবে তা হলো প্রতি ঘনমিটারে ১৫ টাকা, অর্থাৎ পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী বর্তমান মূল্যের তিন গুণ বেশি।

গ্যাস মূল্যের হিসাবে আরও একটি বিষয় হলো, দেশীয় গ্যাস ও এলএনজি মিশ্রণের অনুপাত যা কিনা গ্যাস মূল্যকে আরও বাড়াবে। উল্লিখিত হিসাবসমূহে দেশীয় গ্যাস ও এলএনজি গ্যাসের মিশ্রণে তাদের অনুপাত যথাক্রমে ২৭০ ইউনিট (দেশীয় উৎপাদন) বনাম ১০০ ইউনিট (আমদানি করা এলএনজি) ধরা হয়েছে। কিন্তু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানির পরিমাণ প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট থেকে ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০৪০ সালে দৈনিক ৪২০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত হবে। সুতরাং দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রণে উচ্চ মূল্যের এলএনজির অনুপাত বৃদ্ধি মিশ্রিত গ্যাসের মূল্যকে সে অনুযায়ী বৃদ্ধি করবে। সামগ্রিকভাবে অপর এক হিসাবে দেখানো হয়েছে যে প্রতিদিন ৫০০ ইউনিট এলএনজি আমদানি করতে বাংলাদেশের ব্যয় হবে প্রতিবছর প্রায় ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা (পদ্মা সেতুর নির্মাণব্যয় ২৮ হাজার কোটি টাকা)।

২.
বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদ সহসা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পথে, এ রকম একটি ধারণা ভুল ও অসম্পূর্ণ তথ্যের ওপর গড়ে উঠেছে। একসময় বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে বলে একটি ধারণা প্রচার করে একটি মহল গ্যাস রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। একইভাবে দেশ গ্যাসশূন্য হয়ে যাচ্ছে, এ ধারণাটি কোনো মহলের কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের প্রচেষ্টা কি না, তা নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। অথচ দেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে কিংবা দেশ গ্যাসশূন্য হতে চলেছে-উভয় ধারণা বৈজ্ঞানিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে জ্ঞাত গ্যাস মজুত সহসা শেষ হলেও এখনো অনাবিষ্কৃত গ্যাসের পরিমাণ যথেষ্ট বলে জোরালো বৈজ্ঞানিক যুক্তি রয়েছে।

বাংলাদেশে ভূপ্রকৃতির স্বরূপ বিশ্লেষণে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করে থাকেন যে পর্যাপ্ত অনুসন্ধানের অভাবে দেশের প্রকৃত গ্যাস সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়নি। ঐতিহাসিক (প্রাক্-পাকিস্তান যুগ থেকে) উপাত্ত বিবেচনায় নিলে দেখা যায় যে এ দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গড়ে বছরে একটি বা তারও কম কূপ খনন করা হয়, যা কিনা যেকোনো মানদণ্ডে কোনো গুরুত্বের পর্যায়ে পড়ে না। তদুপরি অপেক্ষাকৃত স্বল্প ও সহজভাবে অনুসন্ধানকাজের ফলাফল হিসেবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে, তা যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য। অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রম যথেষ্ট জোরালো হলে যে সম্ভাবনাগুলো উন্মোচিত হতে পারে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যায়।

প্রথমত, আজ অবধি দেশে গ্যাস অনুসন্ধান মূলত সহজভাবে চিহ্নিত কাঠামোগুলোর (ঊর্ধ্বভাঁজ) মধ্যেই সীমিত। দেশের পূর্বাঞ্চলে এ ধরনের কাঠামোগুলোতে যথেষ্ট গ্যাস পাওয়া গেলেও এর পরবর্তী পর্যায়ে তুলনামূলকভাবে জটিল ও অপেক্ষাকৃত সুপ্ত প্রসপেক্টসমূহকে অনুসন্ধান কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়নি। অথচ বাংলাদেশের মতো বৃহৎ বদ্বীপ অঞ্চলে ভূগর্ভে এ রকম সম্ভাবনা যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান। দেশের এক বিরাট ভূখণ্ড আজ অবধি অনুসন্ধান কার্যক্রমের বাইরে রয়ে গেছে। দেশের মূল ভূখণ্ডের বাইরে বিরাট সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের ম্যাপে যুক্ত করার কৃতিত্বে আমরা গর্বিত। কিন্তু সমুদ্রবক্ষে গ্যাস অনুসন্ধানকাজের মাত্রা হতাশাজনক। অগভীর ও গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের মোট ব্লকের সংখ্যা ২৬ অথচ কেবল ৪টি ব্লকে সীমিত অনুসন্ধান ছাড়া বাকি ২৪টি ব্লক খালি পড়ে রয়েছে। অথচ ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নিষ্পত্তি হওয়ার পর মিয়ানমার রাখাইন সমুদ্রসীমানায় যে জোরালো অনুসন্ধানকাজ শুরু করে, তার সুফল দেখা যায় সেখানে বহুসংখ্যক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এদিকে ২০১২-পরবর্তী সময়ে পেট্রোবাংলা সমুদ্রবক্ষে মাল্টি ক্লায়েন্ট সার্ভে করার যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তা কেন, কীভাবে বা কোন মহলের প্রভাবে সম্পন্ন করা গেল না, তা বোধগম্য নয়।

দ্বিতীয়ত, জাতীয় কোম্পানিসমূহের অধীনে যেসব গ্যাসক্ষেত্র পরিচালিত হয়, তাতে বিদেশি কোম্পানির অধীনে পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্র থেকে অনেক কম মাত্রায় গ্যাস উৎপাদিত হয়। এর একটি কারণ, প্রতি কূপে গ্যাস উৎপাদনের হার দেশীয় কোম্পানির কূপের তুলনায় বিদেশি কোম্পানির কূপে অনেক বেশি। কারিগরি ব্যবস্থাপনার কারণে হয়ে থাকা এই পার্থক্য কারিগরিভাবে দূর করা সম্ভব এবং সে ক্ষেত্রে গ্যাসের যে বাড়তি উৎপাদন হবে, তা বর্তমান গ্যাস-সংকট মেটাতে সহায়ক হবে।

তৃতীয়ত, অতীতে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কূপ খননের পর পর্যাপ্ত ও চূড়ান্ত পরীক্ষা না করেই কূপসমূহ শুষ্ক ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ওই সব কূপে নতুনভাবে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে পরীক্ষা করা হলে গ্যাসের সন্ধান মিলবে বলে ভূবিজ্ঞানীরা মনে করেন (ডেইলি স্টার, ১ জুন ২০১৮)। চতুর্থত, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনের সনাতনী পন্থাসমূহের বাইরে অসনাতনী গ্যাস সম্ভাবনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি মোক্ষম এলাকা বলে ভূতাত্ত্বিকভাবে জানা যায়। কারিগরি ভাষায় এগুলোর মধ্যে থিন বেড প্রসপেক্ট, সিনক্লাইনাল প্রসপেক্ট, হাই প্রেশার প্রসপেক্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য, যাদের কোনো কোনোটি পার্শ্ববর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গ্যাসের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

৩.
বাংলাদেশের গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অসম্পূর্ণ ও অপরিপক্ব পর্যায়ে থাকা অবস্থায় গ্যাসসম্পদ নিঃশেষ হওয়ার স্লোগান দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। অথচ এটিই দেশের নীতিনির্ধারণী মহলকে প্রভাবিত করেছে বলে মনে হয়, যার ফলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের চেয়ে উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানির ওপর অধিকতর আগ্রহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় আনা হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে তা টেকসই করতে হবে আর এ জন্য আলোচ্য বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বটে।

ড. বদরূল ইমাম: অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ