ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কোন পক্ষ নেবে, তা নিয়ে তুরস্ক দোটানায় পড়ে গেছে। কারণ, দুটি দেশের সঙ্গেই তুরস্ক ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিকভাবে জড়িয়ে আছে। আঙ্কারা যেকোনো উদ্যোগ এক পক্ষকে খুশি এবং আরেক পক্ষকে ক্ষুব্ধ করবে। এ কারণে একটি জটিল কূটনীতির মধ্য দিয়ে তাকে এগোতে হচ্ছে। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের জন্য দুই দিক মানিয়ে চলা কঠিন হচ্ছে। ন্যাটো যদিও সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক তৎপরতা দেখাবে না বলে ঘোষণা করেছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটাচ্ছে।
তুরস্ককে দলে ভেড়াতে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ন্যাটো—এই তিন পক্ষই চাপ দিচ্ছে। এর মধ্যে ন্যাটোর চাপকেই গুরুতর মনে করা হচ্ছে। এমনিতেই এরদোয়ান নিজেকে কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে পরিচিত করায় ন্যাটোর দিক থেকে তাঁর ওপর চাপ আছে। তার ওপর সম্প্রতি তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে বিমান–বিধ্বংসী এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে। এটি সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ইউক্রেন এবং রাশিয়া উভয়ের সঙ্গেই তুরস্কের অর্থনৈতিক সম্পর্ক গভীর। তুরস্ক তার প্রয়োজনীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৪৫ শতাংশ পায় রাশিয়া থেকে। এই রাশিয়া থেকেই দেশটি তার মোট চাহিদার ৭০ শতাংশ গম আমদানি করে (বাকি ৩০ শতাংশের মধ্যে ১৫ শতাংশ শস্য সরবরাহ করে ইউক্রেন)। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের পর্যটকদের কাছে গরমের ছুটি কাটানোর শীর্ষস্থানীয় পছন্দের জায়গা হলো তুরস্ক। এই দুই দেশ থেকে বছরে ৫০ লাখ পর্যটক গরমের ছুটি কাটাতে তুরস্ক যায়। ফলে দুটি দেশই এরদোয়ানের কাছে অতিগুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে তাঁকে সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে।
তুরস্ক আগে থেকেই সামরিক চুক্তির আওতায় ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রি করে আসছে, যা মস্কো প্রথম থেকে ভালোভাবে নেয়নি। তুরস্কের ড্রোন অসংখ্য যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। এই ড্রোন বর্তমান যুদ্ধে ইউক্রেন ব্যবহারও করছে। গত বুধবার কিয়েভ ঘোষণা করেছে, তারা মাত্রই এই ড্রোনের একটি নতুন চালান হাতে পেয়েছে। তুরস্ক ইউক্রেনে এগুলো রপ্তানি অব্যাহত রাখলে তা রাশিয়াকে আরও রাগিয়ে দেবে।
এরদোয়ান বলছেন, তিনি ন্যাটো কিংবা রাশিয়া—কাউকে ঘাঁটাতে চান না। তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে পুতিনকে রাগাতে চাননি। কিন্তু পরে পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার হামলার নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেন। তুরস্ক ইতিমধ্যে বলেছে, তারা পশ্চিমাদের অনুসরণ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেবে না। এর দুটি কারণ আছে।
এমন অনেক খাত আছে, যেখানে নিজেদের কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনে তুরস্ককে রাশিয়ার ওপর নির্ভর করতে হয়। সে রকমই একটি ক্ষেত্র হলো সিরিয়া। সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল–আসাদকে একচেটিয়া সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন পুতিন। পশ্চিমাদের সামরিক অভিযানের মুখে বাশারের এত দিন ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কথা ছিল। মূলত রাশিয়া সমর্থন দেওয়ার সুবাদেই বাশার এখনো টিকে আছেন। কিন্তু বাশারবিরোধী যোদ্ধাদের সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক মনে করে, তার ভূখণ্ডে তৎপর কুর্দিদের সঙ্গে সিরিয়ার কুর্দিদের নিবিড় যোগাযোগ আছে এবং সিরিয়ায় কুর্দিরা শক্তিশালী হয়ে উঠলে তুরস্কের জন্য তা হুমকি হয়ে দেখা দেবে। এ বিবেচনায় তারা উত্তর সিরিয়ায় কুর্দিদের উত্থান ঠেকিয়ে রাখছে। এ নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের টানাপোড়েন আছে।
তুরস্কের জন্য ভৌগোলিক অবস্থান আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। ১৯৩৬ সালের মনট্রিয়াক্স কনভেনশন অনুযায়ী, কৃষ্ণসাগরের বসফরাস ও দারদানেল প্রণালির ভোগদখলে আছে তুরস্ক। কৃষ্ণসাগরকেন্দ্রিক শক্তি রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয়ের কাছেই এই দুটি প্রণালি সাংঘাতিক গুরুত্ব বহন করে। তুরস্ক আজ অবধি কনভেনশনটি যথাযথভাবে অনুসরণ করছে। এ কারণেই দেশটি ইউক্রেন ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে। তবে এরপরও তুরস্কের কিছু পদক্ষেপ রাশিয়ার বিপক্ষে যাচ্ছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তুরস্ককে কনভেনশনটির ‘যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ কার্যকর করতে বলেছে, যাতে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ বসফরাস এবং দারদানেল প্রণালি ব্যবহার করতে না পারে। তুরস্ক গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার অনুপ্রবেশকে একটি ‘যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করে এবং রুশ জাহাজের জন্য প্রণালি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। বর্তমানে তুরস্ক দুটি প্রণালিই ন্যাটোভুক্ত দেশসহ সব দেশের যুদ্ধজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।
এরদোয়ান বলছেন, তিনি ন্যাটো কিংবা রাশিয়া—কাউকে ঘাঁটাতে চান না। তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে পুতিনকে রাগাতে চাননি। কিন্তু পরে পশ্চিমাদের সমালোচনার মুখে পড়ে তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার হামলার নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেন। তুরস্ক ইতিমধ্যে বলেছে, তারা পশ্চিমাদের অনুসরণ করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেবে না। এর দুটি কারণ আছে।
প্রথম কারণটি রাজনৈতিক। বছরের পর বছর এরদোয়ান এবং তুরস্কের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম পশ্চিমাদের সমালোচনা করে এসেছে। এখন যদি তাদের সুরে এরদোয়ান সুর মেলান, তাহলে দেশবাসীর কাছে তা ভালো লাগবে না। এটি এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা নষ্ট করবে। দ্বিতীয় কারণটি হলো অর্থনৈতিক। তুরস্কের ওপর নানা ধরনের অবরোধ থাকায় এমনিতেই দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গেছে, মুদ্রার মান পড়ে গেছে এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। রাশিয়ার গম, জ্বালানি ও পর্যটকের ওপর তুরস্ক অনেকাংশে নির্ভরশীল। ফলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নেওয়া তার পক্ষে কঠিন।
তবে যুদ্ধ যদি দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকে, তাহলে এরদোয়ানের পক্ষে বেশি দিন নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হবে না। তাঁকে হয়তো ন্যাটোর দিকে, তথা ইউক্রেনের দিকেই ঝুঁকতে হবে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
● হেনরি জে বারকি পেনসিলভানিয়ার লেহাই ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের অধ্যাপক