ঠিক বাস্তব দেখছি, নাকি সিনেমার কোনো দৃশ্য। ৬ মিনিট ৯ সেকেন্ডের একটি ভিডিও। ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। একটা বিশাল কার্গো জাহাজ তার থেকে অন্তত ২০ গুণ ছোট একটা লঞ্চকে পেছন থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে আসছে। লঞ্চটি একসময় ডুবতে শুরু করল। ডুবন্ত লঞ্চটি থেকে প্রাণ বাঁচাতে ছিটকে পানিতে পড়ছেন মানুষ। একসময় লঞ্চটি ডুবে গেল। ডুবন্ত লঞ্চ আর কিছু ভাসন্ত মানুষের ওপর দিয়ে বীরদর্পে চলে গেল কার্গো জাহাজটি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ আর কার্গো জাহাজের চাপে নদীতে যে ঢেউ তৈরি হলো তাতে হাবুডুবু খেতে শুরু করল কয়েকটি মাথা। আশপাশে নোঙর করে রাখা লঞ্চ থেকে নদীতে বয়া ফেলা হলো। নৌকা নিয়ে কিছু মানুষ ছুটলেন ভাসন্ত মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে। কয়েকজনকে নৌকায় তোলা হলো। সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা বোবা চোখে আরেকবার জীবন পাওয়ার বিস্ময়!
কিন্তু এমন ভাগ্যবান হওয়া তো আমাদের এই সহজ মৃত্যুর দেশে সবার ভাগ্যে সবসময় জোটে না। যাঁরা শেষ মুহূর্তে লাফ দিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরতে পারেননি, কিংবা নদীতে পড়েও যাঁরা কার্গোর নিচে চাপা পড়ে তলিয়ে গেছেন শীতলক্ষ্যার অতলে, তাঁদের সবার মৃতদেহের সন্ধান কি শেষ পর্যন্ত মিলবে?
গতকাল রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার পথে শীতলক্ষ্যার সোনাকান্দা ঘাট এলাকায় রূপসী-৯ নামের কার্গো জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যায় যাত্রীবাহী লঞ্চ আফসার উদ্দিন-২। এ ঘটনায় প্রথম আলো অনলাইনে বেশ কয়েকটি সংবাদ প্রকাশ হয়েছে, যার একটির শিরোনাম ‘স্ত্রীর হাত শক্ত করে ধরে রেখেও শেষরক্ষা হলো না’। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ কাজী ফজলুল হক উইমেন্স কলেজের যুক্তিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু তাহের তাঁর স্কুলশিক্ষক স্ত্রী উম্মে খায়রুন ফাতিমাকে নিয়ে ফিরছিলেন। তিনি বলেন, ‘লঞ্চটি ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একে অপরের দুই হাত শক্ত করে ধরে রাখি। স্ত্রীকে প্রাণে বাঁচাতে শত চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হলো না।’ আবু তাহেরের মতো স্বজন হারানো মানুষের কান্না, আহাজারি আর দীর্ঘশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছে শীতলক্ষ্যার তীর। সোমবার সকাল পর্যন্ত ছয়জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এখনও অন্তত ৫ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কার্গো জাহাজের মালিক যে উঠতি ধনী আর ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত, তা আমরা বুঝি। সেই জোরেই জাহাজের চালক যে বেপরোয়া, সেটাও বুঝি। আবার ছোট লঞ্চের মালিকেরাও তাঁদের চৌহদ্দিতে যে ক্ষমতাশালী, সেটাও আমরা বুঝি। তাই ক্ষমতাচক্রের কেন্দ্র ও প্রান্তের এসব মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। বেপরোয়াপনা ও নৈরাজ্যিক ব্যবস্থার কারণে এই সব মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড।
প্রতিবারের মতো এবারও লঞ্চডুবিতে স্বজনেরা প্রিয়জনের লাশটা যেন তাঁদের কাছে দেওয়া হয়, সেই আশাই করছেন। সহজ আর বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনায় মৃত্যুর এই দেশে কার্গো জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চ ডুবে নিমেষেই কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যুও পরিচিত আর সহনীয় হয়ে উঠছে। এই তো গত বছরের এপ্রিল মাসে যাত্রীবাহী এমএল সাবিত আল হাসান লঞ্চকে পেছন থেকে ধাক্কা দেয় এসকেএল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজ। প্রায় ১০০ মিটার দূরে যাওয়ার পর নির্মাণাধীন শীতলক্ষ্যা সেতুর ১৬ নম্বর পিলারের কাছে লঞ্চটি ডুবে যায়। পুরো ঘটনাটি ঘটতে মাত্র ২০ সেকেন্ড সময় লাগে।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, ডুবন্ত লঞ্চে থাকা বেশ কিছু যাত্রী নদীতে সাঁতরাচ্ছেন। আশপাশের মানুষ নৌকা নিয়ে গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করেন। কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় লঞ্চটি টেনে তোলা হয়। কিন্তু মারা যান ৩৪ জন। এসকেএল-৩ কার্গোটির মালিকানা ক্ষমতাসীন দলের একজন তরুণ সাংসদের। কার্গোটির পানিতে চলাচলের ছাড়পত্র ছিল না। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে যখন তিনি, তখন কিসের আইন, কিসের কানুন? রাতারাতি কার্গোটির রং বদল করা হয়। এরপর মানুষের সমালোচনার মুখে চালকসহ কার্গোটি আটক করা হলেও এতগুলো মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচার কতটুকু এগিয়েছে?
আশরাফ উদ্দিন লঞ্চের বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রূপসী বাংলা কার্গোটি কোনো সতর্ক সংকেত না দিয়েই লঞ্চটিকে এসে ধাক্কা দিয়েছে। পেছন থেকে অন্ধ দানবের মতো কার্গোটিকে আসতে দেখে লঞ্চচালককে সাবধান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন যাত্রীরা। কিন্তু লঞ্চচালক ধমক দিয়ে তাঁদের তাড়িয়ে দেন। এই যে কার্গো জাহাজটির চালক সামনে লঞ্চটিকে দেখেও গতিপথ থেকে না সরে লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়ে ডুবিয়ে দিলেন, কিংবা লঞ্চচালক একগুঁয়েমি করে গতিপথ পরিবর্তন না করে এতগুলো মানুষের জীবনকে ভাগ্যের কাছে সঁপে দিলেন—এর মনস্তত্ত্বটা আসলে কী?
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক বাস্তবতায় কার্গো জাহাজের মালিক যে উঠতি ধনী আর ক্ষমতাকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত, তা আমরা বুঝি। সেই জোরেই জাহাজের চালক যে বেপরোয়া, সেটাও বুঝি। আবার ছোট লঞ্চের মালিকেরাও তাঁদের চৌহদ্দিতে যে ক্ষমতাশালী, সেটাও আমরা বুঝি। তাই ক্ষমতাচক্রের কেন্দ্র ও প্রান্তের এসব মানুষ ধরাকে সরা জ্ঞান করেন। বেপরোয়াপনা ও নৈরাজ্যিক ব্যবস্থার কারণে এই সব মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। আমাদের সমাজ নিয়তিবাদী বলে এ ক্ষেত্রে জরুরি প্রশ্নটাই কেউ তোলে না। নিঃসহায়, ভাগ্যতাড়িত স্বজনদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা, বডিব্যাগে মোড়ানো স্বজনের লাশ পাওয়া। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় অনেকের লাশই তো পাওয়া যায় না। সেই স্বজনেরা সান্ত্বনা পাবেন কীসে?
নৌপথ সুশৃঙ্খল ও নিরাপদ রাখার জন্য একটা মন্ত্রণালয় আছে। মন্ত্রী, সচিব, কর্মকর্তা, কর্মচারী আছেন। নৌ পুলিশ আছে, আছে বিআইডব্লিউটিএ। আছে প্রকল্প ও বাজেট। কিন্তু তাঁদের কেউ কি, নৌপথে এ রকম কাঠামোগত মৃত্যু ঠেকানোর কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন? ঝড়ে নৌযান ডুবে যাওয়া ছাড়া নৌপথে আর যেসব দুর্ঘটনা, তার বেশির ভাগই কি অনিয়ম আর নৈরাজ্যের প্রতিচ্ছবি নয়?
পবিত্র রমজান আসার আগেই বাজারে জিনিসের দাম আকাশ ছুঁতে শুরু করেছে। সব জিনিসই এখন দামি। অথচ মানুষের জীবন এখানে কতটা সস্তা। মৃত্যু এখানে কতটা সহজ। ডিএল রায় যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে কি নতুন করে তিনি লিখতেন, ‘এমন সহজ মৃত্যু কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’।
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক