চট্টগ্রামের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত সিআরবি এলাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের বিরোধিতা করে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে এ অঞ্চলের মানুষ। মিছিল, সমাবেশ, মানববন্ধন ইত্যাদি বহুল প্রচলিত পন্থায় তো বটেই, পরিবেশ রক্ষার বিষয়কে উপজীব্য করে নাটক এবং চিত্রশিল্পীদের ছবি আঁকা ও প্রদর্শনীর মতো সৃজনশীল প্রতিবাদের ভাষাও উচ্চারিত হয়েছে এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। নাগরিক সমাজ ও রাজনীতিকদের পাশাপাশি সরকারি দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অনেকেই এ আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন বলে ব্যাপারটা কোনো দল বা গোষ্ঠীর গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না থেকে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষের অনুভূতির প্রতিধ্বনি হয়ে উঠেছে।
সিআরবি রক্ষার আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠেনি, বরং তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি দিয়ে নগর-পরিকল্পনাবিদ, স্থপতি, প্রকৌশলী, পরিবেশবিদ থেকে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ এই প্রকৃতিশোভিত এলাকা রক্ষার দাবি জানিয়ে এসেছেন। প্রথম দিকে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃত্বপরায়ণ মনোভাব দেখিয়ে ও বেফাঁস মন্তব্য করে পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধিক্কৃত হলে শেষ পর্যন্ত সরকারের নানা মহল থেকে বিষয়টি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। খোদ রেলমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বলেছেন, চট্টগ্রামের মানুষ না চাইলে এই সিদ্ধান্ত (রেলের জমিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ) পরিবর্তন করা যেতে পারে। সম্প্রতি সংসদীয় কমিটির সভাতেও সিআরবির পরিবর্তে হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প কুমিরায় স্থানান্তরের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো আসেনি।
এ রকম অবস্থার মধ্যে নতুন একটি সংবাদ ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’য়ের মতো আঘাত হেনেছে চট্টগ্রামবাসীর ওপর। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের সাত কিলোমিটার এলাকা বেসরকারি অপারেটরদের ইজারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এর মধ্যে দেড় কিলোমিটার এলাকা হবে এক্সক্লুসিভ জোন। ইতিমধ্যে এলাকাটি ইজারা দেওয়ার টেন্ডারের প্রক্রিয়াও অগ্রসর হয়েছে অনেক দূর।
কেন? সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি আর অবারিত হাওয়ার সামনে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বিশালত্বকে সবিস্ময়ে উপভোগের জন্য প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার (ছুটির দিনে এর সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি) লোকের সমাগম যেখানে ঘটে, সেই এলাকা উন্মুক্ত রাখা হবে না কেন?
এর উত্তরে সিডিএ বলছে, পতেঙ্গা সৈকতে বর্তমানে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা নেই। গণশৌচাগার, সমুদ্রস্নানের পর ভেজা পোশাক পাল্টানোর কক্ষ, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। সৈকতের চারপাশের ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। সড়কবাতি অপ্রতুল; যা আছে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা নেই...ইত্যাদি। কোনো সরকারি সংস্থা সাধারণত অব্যবস্থাপনার এমন চিত্র অকপটে তুলে ধরে না। তাই এই স্বীকারোক্তির জন্য সিডিএকে ধন্যবাদ। কিন্তু পাশাপাশি এ প্রশ্নও রাখতে চাই, এই নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? যে সংস্থা এই দায়িত্ব পালন করতে পারে না, সেই সংস্থার কার্যকারিতা কী? এর কর্মকর্তারাই-বা পদ আগলে বসে আছেন কেন?
সিডিএ বা সিটি করপোরেশন চট্টগ্রাম নগরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই সংস্থাগুলোই যখন দু-একটি গণশৌচাগার, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য যথেষ্ট তহবিল নেই বলে আহাজারি করে বড় বিনিয়োগকারীর দ্বারস্থ হয়, তখন তাদের পরিকল্পনার দৈন্য বা অসাধু উদ্দেশ্যটাই আসলে ফুটে ওঠে।
আমরা জানি, সিডিএ বা সিটি করপোরেশন এই নগরে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সেই সংস্থাগুলোই যখন দু-একটি গণশৌচাগার, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ইত্যাদির জন্য যথেষ্ট তহবিল নেই বলে আহাজারি করে বড় বিনিয়োগকারীর দ্বারস্থ হয়, তখন তাদের পরিকল্পনার দৈন্য বা অসাধু উদ্দেশ্যটাই আসলে ফুটে ওঠে।
লক্ষণীয়, যেকোনো হাট-মাঠ-ঘাটে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার কথা উঠলেই সেটা বেসরকারি সংস্থার হাতে ইজারা দেওয়ার চিন্তাটা প্রথমেই মাথায় আসে সেবা সংস্থাগুলোর। সিটি করপোরেশনের আয় বৃদ্ধি, রাস্তাঘাটের রক্ষণাবেক্ষণ, সৌন্দর্যবর্ধন ইত্যাদির নামে নগরের বিপ্লব উদ্যান, আউটার স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে জামালখানসহ বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাত পর্যন্ত ইজারাদার-দোকানদের হাতে তুলে দিতে আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। যেসব এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়েছে, সেখানকার সৌন্দর্য উপভোগ দূরে থাক, দোকানপাটের ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়ে হেঁটে চলাচল করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রথম দিকে এটা-ওটা নানা রকম আকর্ষণীয় ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রচার করা হয়; শেষ পর্যন্ত দেখা যায় ব্যবসাটাই আসল উদ্দেশ্য। পূর্ববর্তী সরকারের আমলে ফয়’স লেক, আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ ও সার্কিট হাউসের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ ইজারা দেওয়া হয়েছিল। জনসাধারণের অবাধ ও উন্মুক্ত যাতায়াত বন্ধ করে প্রবেশমূল্য নির্ধারিত হয়েছে সেখানে। কিন্তু আর্থিকভাবে সরকারি সংস্থা যে লাভবান হয়নি, তার হিসাব আমাদের হাতে আছে। পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতের ক্ষেত্রেও একইভাবে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে বলেই ধারণা করি।
পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে লিজগ্রহীতারা ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে বলে জানা গেছে। নির্ধারিত এলাকাজুড়ে শপিং মল, গাড়ি পার্কিং এলাকা, টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কেব্ল কার ইত্যাদি হবে। এই ‘এক্সক্লুসিভ জোনে’ ঢুকতে হবে অর্থের বিনিময়ে; আর যারা এই মূল্য পরিশোধ করতে পারবে না, তাদের জন্য সৈকতের বাকি অংশ তো খোলা রইলই। এই যে বৈষম্য, এটা কত অমানবিক, মুনাফার লোভে যারা অন্ধ, তাদের হয়তো তা চিন্তার বিষয় নয়। কিন্তু সচেতন নাগরিক সমাজের দাবি, বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সব মানুষের অধিকার সমান। মুনাফালোভীদের খপ্পর থেকে এটাকে বাঁচাতে হবে।
তুরাগ নদ দখল ও দূষণ নিয়ে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছিলেন। সেই রায়ে সংবিধানের বিভিন্ন অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, নদীর পাড়, পাহাড়-পর্বত, টিলা, বন, বাতাস ইত্যাদি জনগণের সম্পত্তি। এসব সম্পত্তি নাগরিকের, কোনো একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়। এসব পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তিতে সাধারণ জনগণের মুক্ত ও বাধাহীন ব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র হচ্ছে এখানে ট্রাস্টি। এগুলো কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানিকে বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দেওয়া চলবে না।’
এই রায় একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা। সুতরাং সিডিএ পতেঙ্গার সমুদ্রসৈকত ইজারা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আদালতের রায় তথা রাষ্ট্রের সংবিধানপরিপন্থী।
সিডিএ পতেঙ্গার সৈকতে অব্যবস্থাপনার যে চিত্র তুলে ধরেছে, তার দায় তারা এড়াতে পারে না। নিজেদের ব্যর্থতার দায় ঢাকতে সমুদ্রের জল-হাওয়া বিক্রির যে ব্যবস্থা তারা নিয়েছে, এটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়; বরং পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতকে আরও মনোরম চিত্তবিনোদনের স্থান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে সিডিএকেই। সুষ্ঠু ও দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে সৈকত ব্যবস্থাপনার অর্থও এখান থেকে আয় করা সম্ভব, এর জন্য বড় বিনিয়োগকারীর কাছে হাত পাতার প্রয়োজন পড়ে না।
● বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক