দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ কী হবে—একটা আলাপ চলছে। কেউ বলছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশ শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে পারে। বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন করা বড় বড় প্রকল্পের অর্থ ফেরত দিতে গিয়ে বাংলাদেশ সংকটে পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যস্ফীতি ও ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক অবমূল্যায়ন। এর বিপরীত মতও আছে। এই পক্ষ বলছে, বিদেশি ঋণে বাস্তবায়ন করা প্রকল্পগুলো খুব বেশি চাপ ফেলবে না দেশের অর্থনীতির ওপর। পোশাকশিল্পনির্ভর রপ্তানি আয় ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেওয়া যাবে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পে অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত ব্যয়, অর্থের লুট এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের কারণে দেশের অর্থনীতি খুব একটা স্বস্তিতে নেই। মূলত, উদ্বেগজনক মানবাধিকার পরিস্থিতি, গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের সংকোচন ও বিরোধীদের ওপর সরকারি দলের অব্যাহত চাপের কারণে নানা ধরনের কথাবার্তা ডালপালা মেলছে।
এসব আলাপ-আলোচনার মধ্যেই বিদ্যুতের মূল্য পাইকারি পর্যায়ে ৫৮ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পরিবহনভাড়া বৃদ্ধি, বাসাভাড়া বৃদ্ধি—নানাবিধ চাপের মধ্যেই নতুন করে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি জনজীবনকে আরও কঠিন করে ফেলবে। পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়লেও তা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের কাঁধে এসে পড়ে। বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি মানে বাজারে সবকিছুরই দাম বাড়বে আরও এক দফা।
আমরা উন্নয়নের নানা ফিরিস্তি শুনি নিত্যদিন। বৃহৎ বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু জনজীবনে এসব উন্নয়নের কোনো প্রতিফলন নেই; বরং নানামুখী সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সাধারণের জীবন। সব জিনিসেরই দাম ঊর্ধ্বমুখী। হাতের নাগালে থাকছে না নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। বাজারে সবজিতে হাত দেওয়ার অবস্থা নেই। চাল, ডাল ও তেলের দাম অনেক আগে বেড়েছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের অনেকেই বাজারে গিয়ে ফিরে আসছেন। এক সংবাদে দেখলাম, রেস্টুরেন্টে কাজ করা এক নারী কারওয়ান বাজারে ফুটপাতে বসে আছেন, কিন্তু সবজি কিনতে পারছেন না। মধ্যবিত্তদের অনেক হিসাব-নিকাশ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের উন্নয়নের সুফল কোথায় যাচ্ছে বা কারা এর সুফল ভোগ করছে?
বিদ্যুতের মতোই অন্যান্য খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার কথা বলে অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অপখরচ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। অনেকেই সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে চীনের ঋণের কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মতো বিভিন্ন খাতে লুটের কথা খুব বেশি বলছেন না। বিদেশি ঋণের চেয়ে এ ধরনের লুট বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। সমস্যা ঋণের নয়; সমস্যা হচ্ছে নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের।
মূল বিষয় হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির আকার ও ব্যাপ্তি বাড়লেও অপখরচ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে। নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের মধ্যে ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে। সরকারি হিসাবে এখন রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলার, আর আমদানি ব্যয় ৮০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে একপর্যায়ে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলের ওপর আরও চাপ বাড়বে। সাদাচোখে আমরা বুঝতে পারি, উচ্চাভিলাষী বাজেট ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার এ সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এ সংকট কাটাতে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করছে সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের হিসাবমতে, চলতি অর্থবছরেই এপ্রিল পর্যন্ত সরকার ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ করেছে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বিপরীতে মার্চ পর্যন্ত রাজস্ব আয় হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা।
ঋণের পাশাপাশি সরকার বিভিন্ন সেবা খাতের মূল্য পুনর্নির্ধারণ করে অর্থ সংগ্রহে মনোযোগী হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খাত হচ্ছে বিদ্যুৎ। গত ১২ বছরে কয়েক দফায় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ এবং গ্রাহক পর্যায়ে ৯৬ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে সরকার। এবারও হয়তো বিইআরসির প্রস্তাব পুরোপুরি অনুসরণ করবে না সরকার। তবে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দাম বাড়াতে পারে।
দাম বাড়ানোর পক্ষে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের যুক্তি হচ্ছে উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম দামে বিক্রি করায় লোকসানের মুখে পড়েছে। গত অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়াবে। জ্বালানি তেল, ফার্নেস তেল ও কয়লার দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে। এর সঙ্গে সরকার ফার্নেস তেল আমদানিতে শুল্ককর ও কয়লার ওপর মূল্য সংযোজন কর আরোপ করেছে। ফার্নেস তেল আমদানি খরচ বেড়ে ৩৪ শতাংশ বেড়েছে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, সরকার দুদিক থেকেই আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করছে। প্রথমত, বিদ্যুৎ খাতে জ্বালানি আমদানির ওপর কর আরোপ করে আয় করছে। আবার গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধি করছে।
পিডিবি বা সরকারের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির মূল কারণ হচ্ছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেওয়া। গত ১০ বছরে সরকার বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রেখেই ৭০ হাজার কোটি টাকা দিয়েছে। দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা হচ্ছে ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। আর ১৩ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিতরণ করতে পারে। গত এপ্রিলে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। ১০ থেকে ১১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার না করেও সরকারকে অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। পর্যাপ্ত বিতরণ ও সঞ্চালন লাইনের ব্যবস্থা না করে বিদ্যুতের উৎপাদনক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রয়োজন ছিল না।
তাই বিদ্যুতের দাম না বাড়িয়ে কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টসহ অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করতে হবে। বসিয়ে বসিয়ে জনগণের পকেট থেকে টাকা নিয়ে এদের পরিশোধ করার কোনো যুক্তি নেই। বিদ্যুৎ খাত অপরিকল্পনা, অপচয় ও লুটপাটের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিদ্যুৎ খাত উন্নয়ন গালগল্পের এক বিশাল শুভংকরের ফাঁকি। দৃশ্যত, এ খাতের উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের উৎপাদনক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু এ সক্ষমতা কাজে লাগছে না। দেশে লোডশেডিংও আছে। এ উন্নয়ন অত্যন্ত দামি, খরুচে উন্নয়ন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিক্রি করে যা আয় হচ্ছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ বেরিয়ে যাচ্ছে। এ খরচ বহন করার সক্ষমতা আমাদের নেই।
বিদ্যুতের মতোই অন্যান্য খাতে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি, প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনার কথা বলে অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় অপখরচ সম্পর্কে আমাদের সতর্ক হতে হবে। অনেকেই সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে চীনের ঋণের কথা বলছেন। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মতো বিভিন্ন খাতে লুটের কথা খুব বেশি বলছেন না। বিদেশি ঋণের চেয়ে এ ধরনের লুট বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি করতে পারে। সমস্যা ঋণের নয়; সমস্যা হচ্ছে নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। আমাদের অর্ধেক খরচে ভারত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। সড়ক নির্মাণের ব্যয় আমাদের দেশে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় কয়েক গুণ বেশি। এসব অপব্যয় ও দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। তা না হলে বিদেশি ঋণ না নিলেও ধসের মুখোমুখি হবে আমাদের অর্থনীতি নিশ্চিতভাবেই।
● ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক