এটা কি শুধুই সাম্প্রদায়িকতা

দেড় লাখ টাকার মালামাল ছিল কনিকা রানীর এই দোকানে। দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে তাঁর দোকান পুড়ে ছাই। বাড়িতেও হয়েছে লুটপাট। গতকাল সকালে রংপুরের পীরগঞ্জের বড় করিমপুরেছবি: মঈনুল ইসলাম

১৯৯০ সালের অক্টোবরে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার একটি গুজব ছড়িয়ে পড়ে একটি পত্রিকার উসকানিতে। তখন ফেসবুক ছিল না, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয়নি। ঢাকায় সাপ্তাহিক বিচিত্রার আরামদায়ক অফিসে বসেও আমরা তা টের পাই দ্রুত। আমাদের সবার প্রিয় ছিলেন যিনি, সদাহাস্যময়, বন্ধুভাবাপন্ন, বিচিত্রার একঝাঁক উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিংবা আত্মম্ভরি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে যিনি নির্বিরোধ, দেখি তাঁর মুখ ঢেকে গেছে উদ্বেগ আর ভীতির অন্ধকারে। তিনি যে একজন ‘হিন্দু’ধর্মাবলম্বী, হঠাৎ যেন সেটি এক কর্কশ উপলব্ধির বিষয় হয়ে দাঁড়াল। আমাদের সেই প্রিয় মানুষটি ভয়ংকর কিছুর শিকার হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে অসময়ে বাসার দিকে রওনা হলেন। তাঁকে পৌঁছে দিতে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে তরুণ বয়সের সাহস নিয়ে আমিও।

তাঁর রামপুরার বাসায় থাকেন বউদি আর দুটি ফুলের মতো মেয়ে। বাসার দরজা খোলা হলো ভয়ে ভয়ে। বিকেল আর সন্ধ্যা কাটল চমকে ওঠা আতঙ্কে। রাস্তায় মানুষের মিছিল, কোথাও একটা পটকার আওয়াজ, ওপরের ফ্ল্যাটে চেয়ার টানার শব্দ, সবকিছুর লক্ষ্য যেন তাঁরা। দুই মেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল, দাদা আর বউদির সঙ্গে আমি থাকলাম কিছুক্ষণ ভয় তাড়ানো আড্ডার ছলে।

রাতে, শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও যখন কমে এল অনেকটা, তাঁর বহু অনুরোধে রওনা দিলাম বিচিত্রা অফিসের দিকে। রাস্তায় টায়ার পোড়া আগুন আর ধোঁয়া, সেনা আর পুলিশের টহল, কোথাও অল্প কিছু ছন্নছাড়া মানুষের জটলা। অনেকটা পথ হেঁটে দৈনিক বাংলায় থেমে চেনা টেবিলের সামনে বসি। কথা বলতে বলতে মনে হলো আমরা শুধু মানুষ না, বাঙালি না, সাংবাদিক না; আমরা মুসলমান বা হিন্দুও, আর এই খুব একান্ত পরিচয়টা একসময় বাকি সব ছাপিয়ে কী ভয়ংকর ভীতিপ্রদ বা হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে আমাদের জন্য।

আমার এখন বয়স হয়েছে। যুদ্ধ, শান্তি, প্রকৃতি আর দেশশাসনের আইন পড়েছি আমি। মনে হয়, পৃথিবীতে সবকিছুতে কিছুটা বিবেচনাবোধ থাকে মানুষের। এমনকি যুদ্ধের সময়ও অস্ত্র ফেলে দেওয়া সৈন্য ভাবতে পারে নিজেকে নিরাপদ, নির্বাচনে বসে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী, অভয়ারণ্যে প্রাণীরা। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিচার-বিবেচনা নেই, এতে কারও নিষ্কৃতি নেই। ধর্ম নিয়ে হানাহানি হলে নিরাপদ নয় কোনো মানুষ। এটা সবচেয়ে ভয়ংকর, সবচেয়ে অমানবিক, সীমাহীন অসভ্যতা।

আমরা জানি, এই সবকিছুর মধ্যেও অন্য একটা পক্ষ আছে। আছে তাদের কুৎসিত আনন্দ আর অর্জন। তাদেরই কেউ পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছে, কেউ ফেসবুক, গুজব আর পুলিশ দিয়ে ধাপে ধাপে উত্তেজিত করেছে মানুষকে, কেউ এসব ঘটনায় রাজনীতির জাল ফেলেছে, কেউ কেউ হয়তো বৈষয়িক লাভের হিসাব করছে।

২.

কুমিল্লার পূজামণ্ডপের ঘটনা এবং এরপর যা কিছু ঘটছে এর সবকিছুই শোচনীয়। বিভিন্ন জেলায় নির্বিচার হামলায় আক্রান্ত, ভীতসন্ত্রস্ত বা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে হিন্দুধর্মাবলম্বী মানুষ, আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত তো অবশ্যই। পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। পুলিশের গুলিতে মারা গেছে তাদের চারজন, তাদের হামলায় অন্য ধর্মের একজন। এখন পুলিশের গণমামলার ভয় একদলের মনে, সেই দলের অব্যাহত আক্রমণের আতঙ্ক অন্য একদলের মনে। সবাই পরাজিত, অবনত, ভীত।

কিন্তু আমরা জানি, এই সবকিছুর মধ্যেও অন্য একটা পক্ষ আছে। আছে তাদের কুৎসিত আনন্দ আর অর্জন। তাদেরই কেউ পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছে, কেউ ফেসবুক, গুজব আর পুলিশ দিয়ে ধাপে ধাপে উত্তেজিত করেছে মানুষকে, কেউ এসব ঘটনায় রাজনীতির জাল ফেলেছে, কেউ কেউ হয়তো বৈষয়িক লাভের হিসাব করছে। এরা কেউ ভিকটিম নয়, এরা অসভ্যতম ঘটনার বেনিফিশিয়ারি ও কুশীলব। আমরা কি জানি এরা কারা? জানতে চাই? যদি না চাই রামু, শাল্লা, নাসিরনগর, কুমিল্লার ঘটনা আরও ঘটবে।

৩.

কিছু মানুষকে চিনি। সৎ ও দেশপ্রেমিক হিসেবে ভালোবাসি। তাঁদের একজন ইমতিয়াজ মাহমুদ, আমাদের সময়ের জনপ্রিয় ও শক্তিশালী কবি। তিনি লিখেছেন, পূজামণ্ডপে কোরআন রাখা হয়েছে ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কারণে। তাঁর মতে, এই রাজনীতি বাইরের, তবে এর বাস্তবায়ন বাংলাদেশের ‘নব্য রাজাকারদের’। ফারুক ওয়াসিফ তরুণ চিন্তক, জাকির তালুকদার লেখক ও সচেতন মানুষ। তাঁরাও মনে করেন, এসব ঘটনার পেছনে রাজনীতি আছে এবং সেটা আন্তদেশীয়। যতটুকু পড়েছি, সিংহভাগ মানুষের মতামতও এমন।

আমি চাঁছাছোলা মানুষ। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই রাজনীতিটা কার? এখনকার বৃহত্তর ভূরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে কে পায় এর সুবিধা? বাংলাদেশে মৌলবাদী আছে, ধর্মীয়ভাবে চরম অসহিষ্ণুতা আছে—এসব প্রতিষ্ঠিত হলে লাভ কার, দেশে বা কোন কোন বিদেশে? এসব ঘটনার পরে অজ্ঞাতসংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে ঢালাও মামলা দিয়ে, জামিন না দিয়ে অনেককে জেলে পুরে রেখে বা বিচার না করে বিচারের থাবা ঝুলিয়ে রেখেই বা লাভ হয় কার? এসব ঘটনার পর প্রচারণার সুযোগ কার বেশি, কারা কতটুকু নিতে পারে সেই সুযোগ? ডিজিটাল আইনে মামলা খাওয়ার আশঙ্কা নেই শুধু কাদের?

এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের ভাবতে হবে। যেসব দেশে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হওয়ার বা এর আশঙ্কার খবর শোনামাত্র পুলিশ ছুটে আসে, দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা বা উত্তেজিত জনতার প্রতি গুলিবর্ষণের জন্যও পুলিশকে জবাব দিতে হয়, পুলিশের তদন্তের আগেই দায়ী কে, তা সরকারিভাবে বলা শুরু হয় না, অজ্ঞাতসংখ্যক আসামি রেখে হয়রানির সুযোগ রাখা হয় না, বিচার বিভাগকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়া হয়, সেখানে ওপরের প্রশ্নগুলো তোলার প্রয়োজন হয় না।

আমাদের এখানে এসব প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন আছে।

উন্নত দেশেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে। তবে এমন ঘটনা ঘটলে তাঁরা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা সেক্যুলারিজমের বাণী দিয়ে থেমে থাকেন না। সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ থাকে, তাঁরা সেগুলোর বিচার করেন। বিচার নিয়ে রাজনীতি হয় না, দাবি তুলতে হয় না, সরকার বিচারপ্রক্রিয়াকে অনুগত রাখতে পারে না।

৪.

পৃথিবীতে সব দেশে সম্প্রদায় আছে। ধর্ম আর জাতি শুধু নয়; ক্ষমতা, বিত্ত এমনকি যৌনাভ্যাসের সম্প্রদায়ও রয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার মতো প্রকট, বোধশক্তি লোপকারী এবং নিষ্ঠুর আর কিছুই হয় না। কারণ, দুই দুনিয়ার স্টেক থাকে এখানে মানুষের মনোজগতে।

উন্নত দেশেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটে মাঝেমধ্যে। তবে এমন ঘটনা ঘটলে তাঁরা শুধু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বা সেক্যুলারিজমের বাণী দিয়ে থেমে থাকেন না। সাম্প্রদায়িক ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ফৌজদারি অপরাধ থাকে, তাঁরা সেগুলোর বিচার করেন। বিচার
নিয়ে রাজনীতি হয় না, দাবি তুলতে হয় না, সরকার বিচারপ্রক্রিয়াকে অনুগত রাখতে পারে না। সেক্যুলারিজমের বাণীর চেয়ে আইনের শাসন, মানবাধিকার আর গণতন্ত্র সেখানে সাম্প্রদায়িকতা রুখতে কম ভূমিকা রাখেনি।

আমাদের এখানে সাম্প্রদায়িকতার ঘটনা ঘটলে আমরা তা দেখি সংকীর্ণ চোখে, সংকীর্ণ স্বার্থেও। আমরা কেউ ধর্মের দোষ খুঁজি, রাষ্ট্রের দোষ খুঁজি না, আমরা সংবিধানের কথা বলি, আইনের শাসনের কথা বলি না। আবার কেউ কেউ বৈষম্যের ভিকটিম হিসেবে শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেখি, কেউ শুধু মুসল্লিদের। আমরা কয়েক পর্বে (উসকানি, প্রতিক্রিয়া, পুলিশি হামলা আরও তীব্র প্রতিক্রিয়া) অপরাধ ঘটলে, পুরোটার বিচার না চেয়ে পছন্দমতো পর্বের বিচারের দাবি করি।

একটা দেশে সরকার থাকলে, সাম্প্রদায়িক ঘটনা রোখার মূল দায়িত্ব তার। এসব ঘটলে তা বিচার করার দায়িত্বও তার। আমরা বলি না এসব দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতাই বড় ধরনের সাম্প্রদায়িকতা।

আমরা কেউ কেউ শুধু আমার সেই বিচিত্রার কলিগদের মতো মানুষের যন্ত্রণা অনুভব করি। কেউ কেউ শুধু কুমিল্লায় গুলি খাওয়া বা মামলার ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মানুষের প্রতি অবিচারের কথা ভাবি। আমরা বুঝি না দুই পক্ষই একই চিত্রনাট্যের ভিকটিম।

সব পক্ষপাতিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা এই চিত্রনাট্যের রচয়িতাদের উদ্‌ঘাটনে সোচ্চার আর ঐক্যবদ্ধ হই না। আমরা অনেকে চাই না অপরাধীর পরিচয়, আমরা চাই অপরাধী হিসেবে আমাদের পছন্দনীয় কারও দিকে আঙুল তোলার সুবিধা বা আনন্দ।

যেদিন আমরা এসবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারব, বিপদটা থামবে তখন।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক