এখন সত্য আড়াল করার সময় নয়
বিশ্ব মুক্ত সংবাদমাধ্যম দিবসের জন্য চলতি বছরে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেসকোর একটি বার্তা হচ্ছে সত্যকে মুখোশ পরানোর সময় এটি নয় (দিস ইজ নট দ্য টাইম টু মাস্ক ট্রুথ)। কিন্তু, বিশ্বের নানা প্রান্তের কার্টুনিস্টরা দিবসটির স্মারক হিসেবে যেসব কার্টুন এঁকেছেন সেগুলোর একটা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মাস্ক। সাংবাদিকেরা নিজেদের শারীরিক নিরাপত্তার জন্য যতটা না মাস্ক পরছেন, তার চেয়ে বেশি মাস্ক তাঁদের মুখের ওপর চেপে ধরা হচ্ছে। যাঁরা এই মাস্ক চেপে ধরছেন তাঁদের উদ্দেশ্য মুখ বন্ধ করা, সত্য আড়াল করা। সংবাদমাধ্যমের মুখে ছাঁকনি বসাতে চান যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আছেন ক্ষমতাধর রাজনীতিক, রাষ্ট্র ও করপোরেট প্রতিষ্ঠান যাদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে।
জনস্বাস্থ্যের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি যে মহামারি, সেই বিপদ মোকাবিলায় সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে তথ্য। জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে পার্থক্য তৈরি করে দিতে পারে সঠিক তথ্য। আবার, সঠিক তথ্য সময়মতো না পাওয়া গেলে তার আর কোনো মূল্য থাকে না। কোভিড-১৯ ভাইরাসের কোনো কিছুই আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু, এই ভাইরাসই বিশ্বে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিঘ্ন সৃষ্টিকারী আপদ। এই ভাইরাসের উৎস প্রাকৃতিক, নাকি গবেষণাগারে তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক বিশ্বের দুটি বড় শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যবিরোধকে নতুন মাত্রায় ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। আবার, ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি এবং তার সম্ভাব্য প্রতিকার ও চিকিৎসা নিয়ে অসংখ্য গুজব এবং অপপ্রচারের পরিণতিতে এই রোগকে কেন্দ্র করে ছড়িয়েছে ভয়ংকর অপবাদ বা অমানবিক পরিত্যাজ্যকরণ। এগুলোর প্রধান বাহন হচ্ছে ইন্টারনেট প্রযুক্তিভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো। ফেসবুক নিউজরুমের প্রকাশিত হিসেবে শুধু মার্চ মাসেই তারা কোভিড-১৯ ভাইরাস বিষয়ক চার কোটি ভুয়া পোস্ট চিহ্নিত করেছিল।
সংক্রমণ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় দেশে দেশে সরকারগুলো চরম নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে, যাতে মানুষের চলাচলের স্বাধীনতা কিংবা জীবিকা অর্জনের অধিকারগুলোর মতো সর্বজনীন মৌলিক অধিকার স্থগিত করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেক দেশেই সরকারগুলোর প্রস্তুতির অভাব কিংবা দায়িত্বহীনতা অথবা এই দুইয়ের কারণে স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জনের অধিকার এক দিন দুদিনের বদলে সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি মাসাধিককাল স্থগিত থাকায় সহায়সম্বলহীন এবং শ্রমজীবীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। 'রোগে মৃত্যু অথবা না খেয়ে মরা'র মধ্যে কোনো মৃত্যু বেছে নেবেন এমন এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরীক্ষার মুখোমুখি এখন কোটি কোটি মানুষ। ধনী-গরিবের বৈষম্য বৃদ্ধির উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির দর্শনে জনস্বাস্থ্য সাধারণত অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকে না। ফলে, স্বাস্থ্যসেবা এবং মৌলিক চিকিৎসাও রয়ে যায় ব্যক্তির সামর্থ্যনির্ভর। এমনকি, মহামারি মোকাবিলার সামাজিক মূল্য ও গুরুত্ব সত্ত্বেও সব নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র সম দায়িত্বশীল হয় না।
এ রকম বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও বিধিনিষেধ কথিত জরুরি অবস্থার আবরণে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকেও গুরুতরভাবে আঘাত করে। সাংবাদিকের কাজ কখনোই শুধু দর্শক হিসেবে খালি চোখে যা দেখা যায় তা দেখে সাঁটলিপিকার হিসেবে তা লিখে পাঠকের কাছে তুলে ধরা নয়। দৃষ্টির আড়ালে থাকা ছবি আলোয় নিয়ে আসা, সব ঘটনার কারণ অনুসন্ধান এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরাটাই বরং বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে এবং কোনো ধরনের সুবিধার বিনিময় না করে স্বাধীন সম্পাদকীয় নীতির আলোকে এসব দায়িত্বপালনই সংকটের সময়ে সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে জরুরি কাজ। সংকটের কালে সম্পাদকীয় স্বাধীনতার অপরিহার্যতা বিশেষভাবে প্রয়োজন ক্ষমতাধরদের জবাবদিহির জন্য। পাঠকের (জনগণের) হয়ে ক্ষমতাধরদের, তা সে হোক সরকার, প্রশাসন কিংবা সমাজপতি—কথা ও কাজের অসংগতির ব্যাখ্যা খোঁজার চেয়ে বড় জনস্বার্থ আর কিছু নেই। ক্ষমতাধরদের সহযোগিতা করা সংবাদমাধ্যমের কাজ নয়, যদিও সংকটের কালে এই কথাটাই সবচেয়ে বেশি বলা হয়।
বৈশ্বিক মহামারির মতো দুর্যোগে সংবাদমাধ্যমের এই নজরদারি ভূমিকায় ঝুঁকি অনেক। বাংলাদেশেও শারীরিক নিগ্রহ, আইনি ও বেআইনি হয়রানি এবং ভীতি প্রদর্শন চলছেই। সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেও পেশাগত দায়িত্বপালনের কারণে সাংবাদিকদের অনেকেই নিজেদের পরিবারের জন্যও বাড়তি ঝুঁকির কারণ হয়েছেন। দুঃখজনকভাবে দুজন সাংবাদিক সংক্রমণের শিকার হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় প্রাণ হারিয়েছেন। বিপর্যস্ত মানুষের ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের খবর প্রকাশের কারণে শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছেন অনেকেই। কথিত নিবর্তনমূলক আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার এবং মামলাও অব্যাহত রয়েছে। কথিত গুজব ও অপপ্রচার বন্ধের অজুহাত নিয়ন্ত্রণের থাবা সংবাদমাধ্যমের ওপরও বিস্তৃত হয়েছে।
পাশাপাশি আর্থিক সংকট সব দেশেই সংবাদমাধ্যমকে এক নজিরবিহীন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। অনেকেই একে অস্তিত্বের সংকট বলে অভিহিত করছেন। খবরের চাহিদা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। কিন্তু, সংবাদপত্র বিতরণব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটায় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় বিজ্ঞাপনী আয় অবিশ্বাস্যরকম কমে যাওয়ায় অনেক পত্রিকায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। যারা টিকে আছে, তারাও অনেকেই হয়তো শেষপর্যন্ত টিকতে পারবে না। সাংবাদিকেরা বেকার হচ্ছেন এবং পেশাচ্যূত হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমশই প্রবল হচ্ছে। এ রকম সংকটে সাধারণত প্রথম বলি হয় সম্পাদকীয় স্বাধীনতা। সরকার কিংবা বাণিজ্যিক স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলো স্বাধীনচেতা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণে উদ্যোগী হয়।
এসব প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এই লড়াইয়ে পাঠক/গ্রাহকরাই মূল শক্তি। অপপ্রচার, গুজব বা মিথ্যাচারের মধ্যেও মূলধারার সংবাদমাধ্যমে পাঠক-দর্শকের আস্থা প্রমাণ করে স্বাধীন সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। তাই, আমাদের সবার স্বার্থেই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সত্যকে আড়াল করার সব ধরনের চেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ইউনেসকোর বার্তাটাই তুলে ধরতে হবে—এখন সত্য আড়াল করার সময় নয়।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক