একুশে আগস্ট থেকে যে শিক্ষা নিতে হবে
বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত কলঙ্কজনক দিন হিসেবে একুশে আগস্ট এবার সারা দেশে ব্যাপকভাবে পালিত হয়েছে। এর মাধ্যমে দেড় দশক আগের ওই দিনের নৃশংসতার কথা জাতি স্মরণ করে থাকে। ওই দিন ঝরে পড়া প্রাণগুলোর আত্মার প্রতি সবাই শ্রদ্ধাবনত। কিন্তু ওই দিনের সব কর্মকাণ্ড থেকে সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত ছিল ওই ঘটনা থেকে কী শিক্ষণীয়, তা নিয়ে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা। লেখক ও দার্শনিক জর্জ সান্টানা বলেছিলেন, যে জাতি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তাদের জন্য ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে বাধ্য।
একুশে আগস্টে শুধু একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড ও হত্যার চেষ্টাই ছিল না, এর কতগুলো বিশেষ দিকও ছিল, যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে আমাদের জাতীয় জীবনে। প্রথমত, এর মাধ্যমে দেশের প্রধান বিরোধী দলকে নেতৃত্বশূন্য করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল, যা ছিল আমাদের নষ্ট রাজনীতির এক ভয়াবহ রূপ। ফলে এ ঘটনা থেকে সৃষ্ট চরম অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতি–প্রকৃতিই বহুলাংশে বদলে দিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, একুশে আগস্টের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের জবানবন্দি থেকে এখন জানা যায়, এর পরিকল্পনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতা। শুধু তা–ই নয়, এসব ব্যক্তি নিজেদের অপরাধ আড়াল করার লক্ষ্যে ঘটনার ভুক্তভোগীদেরকেই দায়ী করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এ ছাড়া ধ্বংস করেছিলেন ঘটনার অনেক আলামত।
তৃতীয়ত, এই হত্যাচেষ্টার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো কোনো অংশ জড়িত হয়ে পড়েছিল। এতে সরাসরি জড়িত ছিলেন রাজনীতিবিদ, সাংসদ, সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সিভিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং মাঠপর্যায়ের বিচারক-প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। এ ঘটনায় দণ্ডপ্রাপ্ত ও পলাতক আসামিদের মধ্যে রয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তিনজন মেজর জেনারেল/ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, তিনজন আইজিপি, বিএনপির নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ, মুফতি আবদুল হান্নান প্রমুখ। এ যেন আমাদের সমাজের ‘হুজ হুদের’ (Who’s who) সমাহার!
চতুর্থত, একুশে আগস্টের ঘটনা শুধু মানবিকতা–বিবর্জিত ও নৃশংসই ছিল না, এর মাধ্যমে আমাদের রাজনীতির কুৎসিত রূপও প্রকাশ পেয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের প্রতিহিংসার রাজনীতি এখন নিশ্চিহ্ন করার রাজনীতিতে রূপ নিয়েছে।
পঞ্চমত, ‘জজ মিয়া নাটক’ সাজানোর মাধ্যমে এ ঘটনা আমাদের রাজনীতির আরেকটি কুৎসিত রূপ উন্মোচন করেছে। প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের না করার এবং তাঁদের আড়ালে রাখার এ ঘৃণিত অপচেষ্টা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের জালিয়াতি। এর মাধ্যমে বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই শুধু অব্যাহত রাখা হয়নি, আইনের অপপ্রয়োগও করা হয়েছিল নগ্নভাবে। এটি ছিল অবিচারের এক জঘন্যতম দৃষ্টান্ত।
ষষ্ঠত, এ ঘটনায় সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি জয়নুল আবেদিন পেশাগত অসদাচরণের এক নিকৃষ্টতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এ কাপুরুষোচিত ঘটনায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমিকার যে গল্প ফেঁদেছেন, তা রূপকথাকেও হার মানায়।
একুশে আগস্ট আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অতি কালিমালিপ্ত অধ্যায় হলেও এ থেকে জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষা গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছি। এমনকি এ নিয়ে কোনো বিশ্লেষণ করা থেকেও যেন আমরা বিরত রয়েছি।
আমরা মনে করি, একুশে আগস্টের অন্যতম শিক্ষা হলো একটি জাতির ইতিহাসের ও মানবকল্যাণের অন্যতম নিয়ামক এর রাজনৈতিক নেতৃত্ব। উদাহরণস্বরূপ, মানব ইতিহাসের প্রাতঃস্মরণীয় নেতাদের অন্যতম হলেন মহাত্মা গান্ধী ও নেলসন ম্যান্ডেলা। কারও কারও মতে, অ্যাডলফ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনির মতো ব্যক্তিদেরও ইতিহাসে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ভূমিকা আছে। গান্ধী-ম্যান্ডেলার মতো হিটলার–মুসোলিনিরও নেতৃত্বের অনেক গুণ ছিল, কিন্তু একটি ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য ছিল। গান্ধী-ম্যান্ডেলা ছিলেন নীতিনৈতিকতাবোধ দ্বারা পরিচালিত নেতা আর হিটলার-মুসোলিনি ছিলেন নীতিনৈতিকতা–বিবর্জিত তথাকথিত নেতা বা ‘অভিনেতা’। ফলে গান্ধী-ম্যান্ডেলার নেতৃত্ব মানুষের জন্য পরম কল্যাণ বয়ে এনেছে। তাঁরা হয়েছেন মানবজাতির জন্য অনুসরণীয়। পক্ষান্তরে হিটলার–মুসোলিনির নেতৃত্ব ছিল মানবজাতির জন্য চরম অকল্যাণকর। তাঁরা হয়েছেন মানব ইতিহাসের খলনায়ক এবং চরমভাবে ধিক্কৃত। অর্থাৎ, নেতৃত্বের অনৈতিকতা ও অর্বাচীনতা ও প্রজ্ঞাহীনতা চরমভাবে অশুভ পরিণতির কারণ হতে পারে।
আমাদের তৎকালীন নেতৃত্বের নীতিনৈতিকতাহীনতা ও সীমাবদ্ধতারই অতি কুৎসিত ফসল একুশে আগস্টের বিয়োগান্ত ঘটনা। তখনকার নেতৃত্বের ভালো-মন্দের বিভাজনের অক্ষমতাই এর মূল কারণ। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের রাজনীতিতে নীতিনৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে আদর্শবাদ, যার অভাব আজ প্রকটভাবে দৃশ্যমান।
একুশে আগস্টের ঘটনার আরেকটি বড় কারণ হলো দলবাজি, বিশেষত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দলদাস হওয়ার প্রবণতা। দুর্ভাগ্যবশত ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে আমাদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রমাগতভাবে দলীয়করণের শিকার হয়েছে। কিন্তু এ দলীয়করণ এখন চরম আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে তারা আর দলীয়করণের অনাগ্রহী ভিকটিম নয়, বরং এর অতি উত্সাহী উদ্যোক্তা। ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করতেই তাদের অনেকে ক্ষমতাসীনদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রদর্শন করে। আর সীমাহীন দলীয়করণের ফলে বর্তমানে আমাদের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ক্ষমতাসীনদের অনুগত হয়ে পড়েছে, আমরা জাতি হিসেবে যার মাশুল দিয়েছি গত জাতীয় নির্বাচনের সময়। তাই একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে জরুরি ভিত্তিতে দলবাজির এ সংস্কৃতি আমাদের ভাঙতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নিরপেক্ষ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দলবাজমুক্ত ও কার্যকর করতে হবে সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
একুশে আগস্ট–পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে আরেকটি শিক্ষা হলো, অন্যায় ও অনাচার করে শেষ পর্যন্ত পার পাওয়া যায় না। আজকের যাঁরা অন্যায় ও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদেরও হয়তো একদিন এর মাশুল গুনতে হবে। তাঁদেরও হয়তো এর শাস্তি ভোগ করতে হবে, যেভাবে একুশে আগস্টের অঘটনঘটনপটীয়সীদের আজ বিচার ও শাস্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, একুশে আগস্ট থেকে আমরা সঠিক শিক্ষা তো নিইনি, বরং এ থেকে যেন একটি ভুল শিক্ষা নিয়েছি। এ কথা সত্য যে বিএনপি একুশে আগস্টের নির্মম ঘটনার দায় এড়াতে পারে না। দল হিসেবে তাদের এ জন্য অনুশোচনা করা প্রয়োজন ছিল, তা না করে তারা চরম অর্বাচীনতার পরিচয় দিয়েছে। এই অর্বাচীনতার প্রতিশোধে আজকের ক্ষমতাসীনদের কেউ কেউ বিএনপির সঙ্গে সব আলাপ-আলোচনার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছে বলে দাবি করেন, যদিও নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে–আগে তারা বিএনপিকে ক্ষমতার ভাগীদারও করতে আগ্রহী ছিলেন। রাজনীতি হলো আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া।
আলোচনা ও সমঝোতার পথ রুদ্ধ হলে রাজনীতি অন্ধ গলিতে প্রবেশ করে, যার পরিণতি হতে পারে আত্মঘাতী ও ভয়াবহ। আলাপ-আলোচনা করতে হয় চরম শত্রুর সঙ্গেই, মিত্রের সঙ্গে সংলাপের কোনো প্রয়োজন হয় না। বিচারিক প্রক্রিয়ায় একুশে আগস্টের অপরাধীদের শাস্তি প্রদান করে বিএনপির অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। তাই আমরা আশা করব, জাতির স্বার্থে ক্ষমতাসীনেরা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছাবে এবং জাতিকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা থেকে রক্ষা করবে। নির্মূল করার অপচেষ্টা থেকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা করাই শ্রেয়—একুশে আগস্টের এটি আরেকটি শিক্ষা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)–এর সম্পাদক