৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর দায়রা আদালত নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩-এর অধীনে একটি মামলায় পুলিশের তিন সদস্যকে যাবজ্জীবন এবং দুজন কথিত ‘সোর্স’কে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এ আইনের অধীনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যের আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ বা আইজিপি) ছিলেন এ এস এম শাহজাহান। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুবরণ করেন ২০১৯ সালে। তিনি অবসরে যাওয়ার পর তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
আট-নয় বছর আগে বেশ কিছু সময় আমরা দুজনেই ঢাকার ইউএনডিপি অফিসে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিলাম। সে সময় তাঁর সঙ্গে আমার বেশ কথাবার্তা হতো। কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছিলেন, তাঁর আইজিপির হিসাবে তাঁর প্রায় চার বছরের দায়িত্বকালে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছিল মাত্র একজন নাগরিক—দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন। মেয়েটি ঢাকা থেকে বাসে চড়ে দিনাজপুর শহরের কাছে দশমাইল নামের এক জায়গায় বাস থেকে নামে। কিছু দূরে বাড়ি, বাড়ি পর্যন্ত নিজেই যাবে বলে। তখন একটা পুলিশের গাড়ি আসে, তাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে পুলিশের গাড়িতে তোলে। ধর্ষণ করে তার মৃতদেহ পুলিশ রাস্তায় ফেলে যায়।
আমি বহু বছর বিদেশে থেকে তখন সবে দেশে ফিরেছি। মনে পড়ে, কিছু সহকর্মীর সঙ্গে আমিও তখন দিনাজপুরে গিয়েছিলাম। এ এস এম শাহজাহান সাহেব বলেছিলেন, তাঁর আমলের ওই একটা হত্যাকাণ্ডের জন্য তিন পুলিশ সদস্য ফৌজদারি আইনে দোষী প্রমাণিত হয়েছিলেন; তাঁদের ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় হয়েছিল।
তারপর গত সিকি শতকে নদীর জল অনেক গড়িয়েছে। ইদানীং প্রায় প্রত্যেক আইজিপির দায়িত্ব পালনকালে কয়েক শ নাগরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। এসব হত্যাকে আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম দিয়েছি: ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ, আত্মরক্ষা এবং আরও কত কিছু।
২.
আমাদের বেশির ভাগ আইনের কোনো মুখবন্ধ বা প্রারম্ভিক কথা (‘প্রিয়্যাম্বল’) থাকে না। তবে নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩–এর একটা বেশ সুন্দর প্রারম্ভিক কথা আছে। এই মুখবন্ধে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে আমাদের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তিকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর ও অমানবিক শাস্তি দেওয়া যাবেই না, এমনকি সে রকম কোনো আচরণও করা যাবে না। আইনটির মুখবন্ধে আরও আছে যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৯৮৪ সালে গৃহীত নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার বা নির্যাতনবিরোধী সনদের একজন অংশীজন রাষ্ট্র। এই সনদকে আমরা সংক্ষেপে বলি ‘কনভেনশন অ্যাগেইনস্ট টর্চার’। অর্থাৎ আমাদের সংবিধান এবং জাতিসংঘের এই সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও আইনটির প্রয়োগ হয়েছে, অভিযুক্তরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে এবং আইন অনুযায়ী দণ্ড ঘোষণা করাও হয়েছে।
এই আইনের একটা ভালো দিক হলো এই যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ব্যক্তিকে অভিযোগ করার জন্য থানায় যেতে হবে না। সাধারণত ফৌজদারি মামলা করতে আমাদের থানায় গিয়ে এজাহার করতে হয়। কিন্তু এই আইনে বলা আছে যে নির্যাতিত ব্যক্তি সরাসরি আদালতে গিয়ে মামলা রুজু করতে পারবেন। আইনে আরও বলা আছে যে কেউ আদালতে গিয়ে অভিযোগ করলে বিচারক তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগকারীর অভিযোগ লিপিবদ্ধ করে অবিলম্বে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক দ্বারা অভিযোগকারীর শারীরিক পরীক্ষার আদেশ দেবেন এবং অভিযোগকারীর দেহের জখম ও নির্যাতনের চিহ্ন এবং নির্যাতনের সম্ভাব্য সময় উল্লেখ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি রিপোর্ট তৈরি করবেন।
অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতিত কোনো ব্যক্তি আদালতে গেলে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর প্রয়োজনীয় সব ক্ষমতা আইনটি আদালতকে দিয়েছে।
৩.
মেজর (অব.) সিনহার ৩১ জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ডের পর প্রায় ছয় সপ্তাহ পার হতে চলল, এ সময়ের মধ্যে তথাকথিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আর ঘটেছে বলে সংবাদমাধ্যমে দেখিনি। এই ছয় সপ্তাহে গ্রেপ্তার সন্ত্রাসী, চোর-ডাকাত, ইয়াবা কারবারিসহ কোনো অভিযুক্তের সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর চড়াও হয়নি। হঠাৎ করে অনেক মামলার অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সহযোগীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড রকমের শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের আক্রমণ করা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থেকেছে। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও আত্মরক্ষা করতে হয়নি, ক্রসফায়ার হয়নি, এনকাউন্টারের কোনো ঘটনাও ঘটেনি।
আমরা বহু বছর ধরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করছি, লেখালেখি হচ্ছে প্রচুর, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সরকারকে বিচারবহির্ভূত হত্যা থেকে সরে আসতে আহ্বান জানিয়ে জানিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছে। মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর আজ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ আছে। ফলে এখন এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। ক্রসফায়ারে দেওয়ার হুমকি দিয়ে কত যে পুলিশি চাঁদাবাজি হয়েছে, তার হিসাব কেউ হয়তো মেলাতে পারবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অবিচার, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন ও পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে মামলা শুরু হয়ে গেছে। আজ হোক কাল হোক, এই মামলাগুলো যে হবেই, সেটা বহু বছর ধরেই জানা ছিল। পৃথিবীর বহু দেশেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অংশবিশেষ বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল। দেশে দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়েছিলেন বহু নাগরিক। ১০, ২০ বা ৩০ বছর পরে হলেও অনেক দেশে বিচার শুরু হয়েছে। সেসব দেশে সেনাপ্রধান, পুলিশ প্রধানসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বহু সদস্যের শাস্তি হয়েছে। আমাদের দেশেও ২১ আগস্ট বোমা হামলা আর ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বিভিন্ন বাহিনীর বা অধিদপ্তরের প্রধানসহ বাঘা বাঘা অনেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে এখন কারাগারে আছেন। গত বিএনপি আমলের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও সে তালিকায় আছেন।
মাদকবিরোধী অভিযানের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার এখন সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ফিলিপাইনে। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট দুতার্তে ক্ষমতায় আসার পর বছর চারেক ধরে প্রায় ১০ হাজার ব্যক্তি অবৈধ মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। সে দেশেও একদিন এসব হত্যার বিচার হবে। বিচার না হলে দেশ-রাষ্ট্র-সমাজ ভেঙে পড়বে।
৯ সেপ্টেম্বরের রায় দিয়ে এবং তার আগে মেজর (অব.) সিনহা হত্যার তদন্তের মাধ্যমে আমাদের নতুন পথের যাত্রা শুরু হয়েছে। এটা হলো আশার জায়গা। আর হতাশার জায়গা হলো যখন মন্ত্রীদের সকাল–বিকেল ঘোষণা দিতে হয় ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না’, তখনই আমরা বুঝে ফেলি যে এ দেশে অনেকেই আইনের ঊর্ধ্বে।
মন্ত্রীদের ঘোষণার চেয়ে ৯ সেপ্টেম্বরের রায়ের ঘোষণা অনেক বেশি বজ্রকণ্ঠ। আশা করি, নির্যাতন ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যুর শিকার ব্যক্তি বা তাঁদের নিকটাত্মীয়রা রায়ের এই বজ্রকণ্ঠে সাহসী হবেন আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যেসব সদস্য এত দিন ধরে এসব অপরাধ করেছেন, তাঁরা বিচারের ঊর্ধ্বে থাকবেন না। একদিন না একদিন তাঁদের বিচার ও দণ্ড হবে।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক