দেখা যাক গত রোববার দিনটি কেমন গেছে। সন্ধ্যার মধ্যে সব খবর টিভিতে পাওয়া গেছে। তারপরও দেখি, পরদিন গত সোমবারের পত্রিকায় নতুন কী খবর এসেছে। সেগুলো রোববারেরই খবর। অনেক খবরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো ছাপা হয়। তার সঙ্গে থাকে খবরের পেছনের কথা। সোমবারের কয়েকটি প্রধান পত্রিকার প্রথম ও শেষ পাতার খবরগুলোর মধ্যে মূল কয়েকটি খবরের শিরোনাম ছিল এ রকম: নেতা-কর্মীদের চাপে পুলিশ, স্থানীয় একশ্রেণির নেতার কারণে সরকারের বদনাম হচ্ছে...। প্রকল্পের টাকায় পাকা হয়েছে বাড়ির উঠান। পাওনা টাকা চাওয়ায় ডাকাত অপবাদ দিয়ে মারা হয় মনিরকে, কুমিল্লায় আলোচিত এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রীর স্বীকারোক্তি। আপিল বিভাগের আদেশ: ব্রাজিলের গম বিতরণে দুই সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা। বিচার মাটিচাপা দিল পুলিশ: কোম্পানীগঞ্জে মিলনকে ডাকাত সাজিয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই পিটিয়ে হত্যার চার বছর। ‘খান ভাই’দের খোঁজে টাঙ্গাইলে সতর্ক পাহারা। রাঙামাটিতে গুলিতে দুজন নিহত। পানিবন্দী লাখো মানুষ ইত্যাদি।
এটা এক দিনের খবর। কিন্তু আজকাল প্রতিদিন এ রকমই। দুঃসংবাদে ভরা। যেমন গতকাল মঙ্গলবারের কাগজগুলো দেখুন। কক্সবাজারে পাহাড়ধসে মা-মেয়েসহ পাঁচজনের মৃত্যু। চাঁদার টাকায় (সাতক্ষীরায়) উঠতি নেতারা কোটিপতি। ছাদ থেকে ফেলে নবজাতককে হত্যা। সড়ক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে। আবদুল হাই বাচ্চুকে বাদ দিয়ে প্রতিবেদন, বেসিক ব্যাংক জালিয়াতি নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শেষ ইত্যাদি।
এর ফাঁকে হয়তো দু-একটা সুসংবাদ থাকে। যেমন রোববারের খবরে ছিল প্রেসিডেন্ট ওবামা কেনিয়া সফরের সময় বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিংকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিলেন যে সমস্যা থাকলেও বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে চলেছে। কেনিয়ায় এম-পেসো নামে মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হয় বাংলাদেশেরও আগে। সেখানে পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্যরা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের আত্মীয়স্বজনের হাতে এক নিমেষে টাকা পৌঁছে দেওয়ার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে যায়। পরে বাংলাদেশ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রামের মানুষকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে। এ খবর যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কাছেও পৌঁছে গেছে, সেই সুসংবাদ আমরা জানলাম রোববারের পত্রিকায়।
কিন্তু তারপরও আজকাল কেবল দুঃসংবাদই আসছে প্রতিদিন। প্রায় প্রতিদিনই নারী নির্যাতনের খবর আসে। শিশুদের ওপর নির্যাতনের খবর আসে। সমাজে নৃশংসতা বেড়ে গেছে। যেকোনো মূল্যে এই নৃশংসতা বন্ধ করতে হবে।
এর আগে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় গভীর জঙ্গলে প্রবাসী বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের বন্দিশিবিরে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য নির্যাতনের খবর এসেছে। অত্যাচার, নির্যাতন ও অনাহারে শতাধিক মানুষ মারা গেছে। ট্রলারডুবিতে প্রায় দেড় হাজার
মানুষ নিখোঁজ। এসব ঘটনার কোনো খোঁজখবরই কি আমরা রাখতাম না? টেকনাফে ক্ষমতাসীন দলের একজন সাংসদের বিরুদ্ধে মানব পাচার, ইয়াবা চোরাচালানের অভিযোগ বারবার উঠেছে। তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? একবার গ্রেপ্তার করা হলো, কিন্তু কয়েক দিন পরেই তিনি বীরের বেশে বেরিয়ে এলেন।
অথচ মানব পাচারে জড়িত থাকার দায়ে থাইল্যান্ডে গত শুক্রবার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন থাই সেনাবাহিনীর লে. জেনারেল মানাস কংপায়েংসহ অন্যান্য সামরিক ও জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় কর্মকর্তা ও রাজনীতিকেরা। থাইল্যান্ডের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মুখপাত্র ওয়ানচাই রাউজানাভং পত্রিকার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা প্রভাবশালী কাউকে ন্যায়বিচারের ঊর্ধ্বে উঠতে দেব না।’
দুঃখের কথা যে বাংলাদেশের এত মানুষ দালালদের খপ্পরে পড়ে জীবন দিল, কিন্তু আমরা এ রকম ত্বরিত ব্যবস্থা নিলাম না। এলাকার লোকজনের মুখে মুখে ফিরছে প্রভাবশালী দুর্বৃত্তদের নাম। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে অভিযুক্ত পাচারকারীদের বিষয়ে তদন্তের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি তাদের রিপোর্টে ২১৯ জনের একটি তালিকা তৈরি করে। কিন্তু ওরা সবাই চুনোপুঁটি। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মূল অপরাধীদের প্রায় সবাই এখনো কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরে।
শুক্রবার দ্য নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘আ বাংলাদেশি টাউন ইন হিউম্যান ট্রাফিকিংস গ্রিপ’ (মানব পাচারের কবজায় একটি বাংলাদেশি শহর) নিবন্ধে শাহপরীর দ্বীপের কথা ছাপা হয়েছে। ওই এলাকা থেকে কয়েক বছর ধরে কীভাবে মানব পাচার হয়ে আসছে, তার একটি বিবরণ সেখানে পাওয়া যাবে। সেখানকার একজন দোকানদার দেখেছেন, দিনে দিনে কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে মানব পাচারের ব্যবসা। স্থানীয় পুলিশ বা প্রশাসনের কেউ কি দেখেননি? আর এত তোলপাড় হওয়ার পরও কি সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা প্রশাসনের কেউ সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেননি? যদি করতেন, তাহলে তো আমরা জানতে পারতাম মূল অপরাধীদের কথা।
আমরা শুধু খবর পাচ্ছি পাঁচ-ছয়জনকে মানব পাচারের অভিযোগে ধরা হয়েছে। তারপর ‘ক্রসফায়ারে’ তারা একে একে নিহত হয়েছে। তার মানে, ওই পাঁচ-ছয়জনের বাইরে নেপথ্য নায়কদের পরিচয় উদ্ঘাটনের আর সুযোগ থাকল না। এভাবেই হয়তো বিষয়টা ফাইলচাপা পড়ে যাবে। একদিন সবাই ভুলে যাব যে আমাদের দেশে মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলায় একদল অপরাধী মেতে উঠেছিল। অপরাধী চক্র লেবাস বদলে আরেক অপরাধী তৎপরতা শুরু করবে।
প্রতিবছর ঈদের সময় পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা বেতন-বোনাসের দাবিতে মিছিল-বিক্ষোভ করেন। কারখানার গেট অবরোধ করে দাবি আদায়ের আন্দোলন করেন। অনেক সময় তাঁদের লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেওয়া হয়। এবার এ সমস্যা খুব বেশি ছিল না। কিছু ছোট কারখানার শ্রমিকেরা বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁদের দুর্বল গলা বাস্তব কারণেই শোনা যায়নি বেশি। আমরা দেখেছি, ঈদের দিনে সোয়ান গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা প্রেসক্লাবের সামনে তিন মাসের বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। কারখানা বন্ধ। সরকার তো এগিয়ে এসে একটা মিটমাট করতে পারত। কিন্তু না, কারও মাথাব্যথা ছিল না। আজও তাঁদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা হলো না।
অথচ কম্বোডিয়ার মতো একটা দেশ, যে দেশের অসহায় মানুষ সত্তরের দশকে বছরের পর বছর পলপট সরকারের নৃশংস শাসন-নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে বসেছিল, তারাও আজ তৈরি পোশাকশিল্পে এগিয়ে গেছে। ২০ বছর আগেও যেখানে কোনো কারখানার অস্তিত্ব ছিল না, আজ সেখানে অন্তত ১ হাজার ২০০ কারখানায় কাজ করছেন প্রায় সাত লাখ শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশ নারী। তাঁদের বেতন মাসে অন্তত ১২৮ ডলার, যেটা তাঁদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি। তাঁদেরও কিছু সমস্যা আছে। তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করার নানা কারসাজি চলছে। এসবের বিরুদ্ধে আন্দোলনও করছেন তাঁরা। কিন্তু বেতন-বোনাসের জন্য রাস্তায় নেমে তাঁদের লাঠিপেটা খেতে হয় না। অথচ আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়েও শ্রমিকদের একটু ভালো বেতন ও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছি না।
প্রতিবছর ঈদের সময় হয় লঞ্চডুবি, না হয় বাস দুর্ঘটনায় মানুষকে প্রাণ দিতে হয়। এবার অবশ্য কোনো লঞ্চ দুর্ঘটনা হয়নি। কিন্তু বাস দুর্ঘটনায় ঈদের আগে-পরে ১১ দিনে প্রাণ দিয়েছেন প্রায় আড়াই শ মানুষ। বাসচালকেরা বেপরোয়া। তাঁদের অনেকের লাইসেন্স ভুয়া। রাজনৈতিক প্রভাবে চাপের মুখে অদক্ষ চালকেরা লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়েছেন। তা ছাড়া সড়কের বাঁকে বাঁকে মরণফাঁদ। হাইওয়ে পুলিশ অনেক সময় নিরুপায়।
অর্থাৎ দুঃসংবাদগুলো আমরাই ডেকে আনার ব্যবস্থা করছি। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যদি রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকে, তাহলে এসব অপশক্তিকে দমন করা কঠিন নয়। আসল গলদ তো সেখানেই।
সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ ও দপ্তর-অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা তো প্রতিদিনই খবরের কাগজ পড়েন। সেখানে একটা বিশেষ উদ্যোগ থাকা দরকার যেন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অপরাধমূলক কোনো ঘটনা নজর এড়িয়ে না যায়। ওসব ঘটনা যেন কোনোভাবেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে না পারে, সে জন্য বিশেষ তদারকি সেল দরকার। সেটা কেন্দ্রীয়ভাবেও হতে পারে। নারী নির্যাতন, মাদক, মানব পাচার, অপহরণ, খুনসহ প্রতিটি ঘটনার ওপর নজর রাখা হবে তাদের প্রধান দায়িত্ব। মামলার অগ্রগতি নিয়মিত পর্যালোচনা, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত, বিচার ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকাই হবে তাদের কাজ।
এ কাজ যদি নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়, তাহলে হয়তো পত্রিকার প্রথম বা শেষ পাতায় দুঃসংবাদের খবরগুলো কমে আসবে। সেখানে জায়গা করে নেবে সুসংবাদ ও সাফল্যের কথা।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
[email protected]