গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দল এবং গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে যে সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী সংলাপ হলো তা নিয়ে এখন সব মহলে আলোচনা চলছে।
বাংলাদেশের রাজনীতির যে চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য, তা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে সংলাপ নিয়ে খুব একটা আশাবাদী হওয়ার কথা নয়। পাকিস্তান আমল থেকে কোনো সংলাপই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে পারেনি। মীমাংসা হয়েছে রাজপথে। তবে রাজপথে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান পেতে হলে রাষ্ট্রের যে মহা ক্ষতি হয়, সেটি পূরণ করা সম্ভব হয় না। তার চেয়েও বেদনাদায়ক হলো এসব রাজপথের ফয়সালা বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে রেখে যায় প্রচণ্ড অবিশ্বাস, সন্দেহ ও বিদ্বেষ। এই লড়াইয়ে কোনো পক্ষ সাময়িক জয়ী হলেও চূড়ান্ত বিচারে গণতন্ত্র পরাজিত হয়। গণতন্ত্র হলো সংলাপ, সমঝোতা, সহিষ্ণুতা এবং সবার মতামতের আলোকে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তমতে দেশ পরিচালনা।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যে সাত দফা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার সবই সরকার মেনে নেবে, তা বিএনপির নেতারাও মনে করেন না। বিশেষ করে, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের বিষয় বলে সরকার এড়িয়ে যাবে, তা-ও তাঁরা জানেন। ডিসেম্বরে নির্বাচন, এই মুহূর্তে তাঁদের দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠন কিংবা নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনও সম্ভব নয়। তবে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা কামাল হোসেন সংলাপের আগে ও পরে যেসব কথা বলেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট যে সরকার যদি একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনে আন্তরিক হয়, সংবিধানের মধ্যে থেকেও সম্ভব।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতাদের উত্থাপিত সাত দফার মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আদালতের বিষয় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন। আর যে মামলায় তিনি দণ্ডিত হয়েছেন, সে মামলা করেছে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রধানমন্ত্রীর এই যুক্তি মেনে নিয়েও যে কথাটি বলা প্রয়োজন সেটি হলো আইন সব সময় একই গতিতে চলে না, চলেনি। বিচারিক আদালতে দেওয়া শাস্তির মেয়াদ আপিলে বাড়ার উদাহরণও খুব বেশি নেই। অতি সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা উচ্চ আদালত খারিজ করার আগ পর্যন্ত মামলা বিচারাধীন থাকা অবস্থায়ই তিনি নির্বাচন করে সাংসদ হয়েছেন, মন্ত্রিত্ব করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত ও জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধেও জেনারেল মঞ্জুর হত্যাসহ বেশ কিছু মামলা বিচারাধীন। তাঁরও নির্বাচন করতে এবং সাংসদ পদে থাকতে কোনো সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়নি মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার আসামি আমানুর রহমানকে সাংসদ পদে টিকিয়ে রাখতেও, যদিও তিনি এখনো কারাগারে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, সবাই মিলে যে দেশ গড়ার কথা বলেছেন, উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন, সেটি যদি তাঁর মনের কথা হয়, তাহলে সংলাপ পুরোপুরি নিষ্ফল না-ও হতে পারে। সংঘাতের চেয়ে সংলাপ উত্তম। সংলাপের প্রয়োজন তখনই হয়, যখন রাজনীতিতে কোনো সমস্যা বা সংকট দেখা দেয়। ক্ষমতাসীনেরা স্বীকার করুন আর না–ই করুন, আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে একটা অনিশ্চয়তা চলছে। সেটি কাটানোর উপায় হলো সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কোনো কোনো দাবি তাঁর সরকারের এখতিয়ারের বাইরে বললেও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। বিরোধী দল অবাধে সভা-সমাবেশ করতে পারবে, কাউকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গ্রেপ্তার-হয়রানি করা হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে গায়েবি মামলা দিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার-হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আনা হলে তিনি তালিকা তাঁর দপ্তরে পাঠিয়ে দিতে বলেছেন।
আমরা ধারণা করতে পারি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মূল উদ্বেগ একটি সংসদ রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন এবং খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারা না পারা। প্রথমটির বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট, বাম গণতান্ত্রিক জোটও। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিষয়টি সংবিধানসম্মত বলা হলেও ড. কামাল হোসেন সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের খ উপদফা দেখিয়ে বলেছেন, সংবিধান পরিবর্তন না করেও সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচন করা যায়। ২০১৪ সালের নির্বাচন বাদ দিলে আগের নয়টি নির্বাচনই হয়েছে সংসদ ভেঙে দিয়ে। নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ২০১৩ সালের প্রস্তাবের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যাতে বিরোধী দলকে স্বরাষ্ট্র ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। সে সময়ে বিএনপি এই প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২০১৪ সালে একটি একতরফা নির্বাচন হয়। এবার দলটি নির্বাচন করতে আগ্রহী বলেই দলীয় প্রধান জেলে থাকা সত্ত্বেও সরকারের সঙ্গে সংলাপে বসেছে। বল এখন সরকারের কোর্টে।
তফসিল ঘোষণার পর জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুরোপুরি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাতে ন্যস্ত হবে বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন যে সরকার তাদের কাজে কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তবে আইনে যা–ই থাকুক না কেন ইসি কতটা স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। কমিশনের সর্বশেষ বৈঠকে কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচনকালে জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কীভাবে পরিচালিত হবে, তা নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দিলে সিইসিসহ অন্যান্য কমিশনার রাজি হননি। আমাদের নির্বাচন কমিশন মোটেই দুর্বল নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন করার মতো উপযুক্ত আইনও আছে। সমস্যা হলো যঁারা আইনের প্রয়োগ করবেন, তঁাদের সৎসাহস ও সততার অভাব আছে। একই আইনের অধীনে হুদা (এ টি এম শামসুল হুদা) ও রকিব কমিশন কাজ করলেও ফল উল্টো হয়েছে।
বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি আপনাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছি নির্বাচন হবে অবাধ ও সুষ্ঠু। কোনো কারচুপি হবে না। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এবং আপনারা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’ সে ক্ষেত্রে জনগণ দেখতে চাইবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গায়েবি মামলা দিয়ে আর পাকড়াও করছে না। বিরোধী দলের কর্মীরা কোথাও একত্র হলে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করছে না। স্থানীয় প্রশাসন কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী না হয়ে সব প্রার্থী ও দলের সঙ্গে সমান আচরণ করছে। তারা আরও দেখতে চাইবে, সব দলের নেতারা নির্বিঘ্নে নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। কাউকে ভয়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে না। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এটি শুধু মুখে বললে হবে না, কাজেও প্রমাণ দিতে হবে। অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
আর নির্বাচনের পরিবেশ যে সার্বিক গণতান্ত্রিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত, সে কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালো আইন বাতিল করার কথা বলা হয়েছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা মানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা বিভাগীয় শহরে নানা শর্ত মেনে নিয়ে একটি জনসভা করে বক্তৃতা দেওয়া নয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হলো কাউকে আহত না করে স্বাধীনভাবে নিজের মতপ্রকাশ করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হলো ভলতেয়ারের ভাষায়, ‘আমি তোমার সঙ্গে দ্বিমত করতে পারি। কিন্তু তোমাকে তোমার কথা বলতে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে আমি জীবন দিতে প্রস্তুত আছি’ এমন মানসিকতা তৈরি করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হলো এমন আইন না করা, যাতে সাংবাদিকেরা নির্ভয়ে জনগণের কাছে তথ্য জানাতে পারেন। তথ্য পেতে তাঁদের পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হবে না কিংবা মাথার ওপর ১৯২৩ সালের ঔপনিবেশিক আমলের সরকারি গোপনীয়তা আইনের খড়্গটি ঝুলবে না।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]