দুর্গাপূজাকে ঘিরে কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার কথিত অভিযোগের পর চৌমুহনী, ফেনী, পীরগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য এলাকায় ঘটে যাওয়া প্রতিমা ভাঙচুর ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আমাদের অস্তিত্বে আঘাত হেনেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন নেটিজেনরা। বক্তৃতা-বিবৃতির বাম্পার ফলন সংবাদপত্র, রাস্তায়, শাহবাগ থেকে গ্রামীণ জনপদে গড়িয়েছে। রামু বা কুমিল্লার মতো ঘটনার পর এ ধরনের বক্তৃতা, বিবৃতি, বিক্ষোভ সভা ও সমাবেশ আমরা আগেও অনেক দেখেছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, এ সত্ত্বেও আমরা তিমিরে নিমজ্জিত হয়েছি। এর কারণগুলো হচ্ছে ১. আমাদের অপরাধপ্রবণ ও অঘটনসমৃদ্ধ সমাজে নতুন অপরাধ আগে ঘটে যাওয়া অপরাধটিকে ভুলিয়ে দেয়; ২. এসব অঘটন ও অপরাধের কোনো শাস্তি না হয়ে বরং পারস্পরিক দোষারোপের এবং যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তার বিরোধীদের নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে ওঠে; ৩. এ ধরনের অপরাধ ও অঘটনের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাও বিভক্ত এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আমাদের একাংশ বিধর্মী ও আরেক অংশ আলেম নির্যাতনে উল্লসিত হই; ৪. প্রায়ই দেখা যায়, অপরাধ ও অঘটন সংঘটনকারীরা রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত।
পরিত্রাণের উপায়
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা। কেননা, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে ভুলটা কোথায়, তা সহজে শনাক্ত করা যায় এবং এর সমাধান সহজ হয়। ২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরের রাজারত্নম স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ ও সে দেশের সরকারের সংস্কৃতি, সমাজ ও যুব মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এ ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের কৌশল ও ভালো অনুশীলন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনায় নিচের বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের শর্ত
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের শর্ত তিনটি: ১. পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধ—জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন, যেখানে একে অপরকে ব্যবহার্য পণ্য নয়, বরং মানুষ হিসেবে গণ্য করা; ২. বৈচিত্র্যের মধ্যেই ঐক্যের ধারণাকে সামাজিকভাবে গ্রহণ ও আলিঙ্গন করা; ৩. স্বতন্ত্র অথচ প্রাণবন্ত অস্তিত্ব, যা চাপা উত্তেজনা বা সহিংসতার হুমকি মোকাবিলায় সক্ষমতা প্রদান করে। এ শর্তগুলো সহজ ও বাস্তবানুগ হলেও সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল উপায়ে এগুলোর বিকাশ ঘটাতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে হবে? নিচের বিষয়গুলো প্রণিধানযোগ্য।
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা
অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য প্রথমেই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাক্ষরতার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীকে না জানলে তাদের জীবনাচরণকে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। তাই প্রতিবেশীর ধর্মবিশ্বাস, সংস্কার ও সম্পর্কে কথা বললেই অনেক ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটতে পারে। পারস্পরিক আলোচনা এ ক্ষেত্রে আমাদের অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা দুরূহ। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা, উপমহাদেশের সমাজ বিভক্ততা, পশ্চাৎ-মুখিতা, অর্থ ও পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতি, অতিমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণ সমাজ এর প্রধান অন্তরায়। কিন্তু তাই বলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে গেলে চলবে না।
খাদে পড়া মানুষ
দ্বিতীয়ত, খাদে পড়া মানুষ নিয়ে সচেতনতার কথা বলা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন ঘটনা ঘটে, যা তাদের চরমপন্থা অনুসরণ বা উগ্রবাদী করে তোলে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, মা-বাবা থেকে বিচ্ছিন্নতা এর কারণ হতে পারে। তাই এ ধরনের খাদে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে হবে। বৈষম্য দূর ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা না গেলে সামাজিক ভাঙন রোধ করা দুরূহ হবে।
বয়ান, আবেগ ও যুক্তির উৎকর্ষ
তৃতীয়ত, বয়ান, আবেগ ও যুক্তির উৎকর্ষ আনতে হবে। চরমপন্থীরা এ ধরনের খাদে পড়া তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য একটি ঘৃণার বয়ান দিয়ে তাদের সংঘবদ্ধ বা উদ্বুদ্ধ করে এবং নতুনভাবে বাঁচার অনুপ্রেরণা জোগায়। তাই এর বিপরীতে সম্প্রীতির বয়ানকে আরও সমৃদ্ধ হতে হবে। আমাদের কেবল ঠান্ডা যুক্তিপূর্ণ ভাষায় (যদিও সঠিক) তাদের এটা বললে চলবে না যে তারা ভুল পথে আছে; বরং তাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতার সমস্যা দূর করে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ করে দিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের বয়ান বিচ্ছিন্নতা ও ভঙ্গুর সমাজের বয়ান থেকে আকর্ষণীয় হতে হবে।
আন্তধর্মীয় সম্পর্ক
পৃথিবীর প্রায় ৮৪ শতাংশ মানুষ ধর্মবিশ্বাসী এবং এ সংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাই ধর্মকে উপেক্ষা করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলা যাবে না। ব্যক্তিগত জীবনে যে কজন প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি দেখেছি, তাঁদের সবাইকে পরধর্মসহিষ্ণু হতে ও ভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়তে দেখেছি। প্রকৃত ধার্মিকতার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই সব ধর্মের কল্যাণ ও মঙ্গলের বার্তাটি ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু একটি বহুধর্মীয় সমাজে এর পাশাপাশি আন্তধর্মীয় সংলাপ ও যৌথ সামাজিক কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে।
নারী ও যুবা
জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ নারী। তাই তাদের বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া নারীরা অধিকতর সংবেদনশীল এবং যুবারা সমাজ পরিবর্তন, সংলাপে উৎসাহী ও শুনতে আগ্রহী। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন নারীদের অংশগ্রহণ এ প্রক্রিয়াকে বেগবান ও টেকসই করে। তাই ভবিষ্যতে নেতৃত্বের দাবিদার যুবা ও নারীদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ার মূলধারায় সংযুক্ত করতে হবে।
নেতৃত্ব
কীভাবে সংখ্যালঘুকে অন্তর্ভুক্ত, সম্মানজনক সংলাপ করে, জন-আকাঙ্ক্ষা মাথায় রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন করতে হবে, তার জন্য আদর্শ নেতৃত্ব প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে জনবাদী বাগ্মী, যাঁরা ঘৃণা, অসম্মান ও হিংসার প্রচার-প্রসার করেন, তাঁদের সামাজিকভাবে বর্জন করতে হবে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যন্ত সব স্তরেই এ ধরনের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে এ-জাতীয় নেতৃত্বের উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন। ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। জাতীয় ও সামাজিক নেতৃত্ব একযোগে কাজ করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন সহজ হয়। কেবল ওপর থেকে নিচে (টপডাউন) নেতৃত্ব দিয়ে এ ধরনের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।
যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের নীতিমালা তুলনামূলকভাবে সহজ, এর বাস্তবায়ন দুরূহ ও সমস্যাসংকুল। এ ক্ষেত্রে বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে, খাদে পড়া মানুষকে উঠিয়ে আনতে হবে, নতুন বয়ান তৈরি করতে হবে এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের জন্য তা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
আমাদের দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা আরও দুরূহ। ঔপনিবেশিক অভিজ্ঞতা, উপমহাদেশের সমাজ বিভক্ততা, পশ্চাৎ-মুখিতা, অর্থ ও পেশিশক্তিনির্ভর রাজনীতি, অতিমাত্রায় দুর্নীতিপ্রবণ সমাজ এর প্রধান অন্তরায়। কিন্তু তাই বলে আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে গেলে চলবে না। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের ওপরে উল্লিখিত বিল্ডিং ব্লকগুলোর নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে এবং তা করতে হবে এখনই। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। না হলে কেবল ঘটনা-পরবর্তী মাতমেই আমাদের প্রতিবাদ শেষ হয়ে যাবে এবং এ ধরনের ঘটনার দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি হতে থাকবে।
● মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক