সরকারের বিভিন্ন কাজে আমলানির্ভরতার উদাহরণ টেনে সংসদে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ। গত ২৮ জুন বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন আমাদের জেলায় জেলায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে। মানুষ মনে করে আমরা করোনার সময় মানুষকে যেসব সাহায্য-সহযোগিতা করেছি, সেগুলো ওই প্রশাসনিক কর্মকর্তারাই দিয়েছেন। অথচ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা কিন্তু এলাকায় যাননি।…একটি রাজনৈতিক সরকার এবং রাজনীতিবিদদের যে কর্তৃত্ব, কাজ, সেটি আজ ম্লান হয়ে যায়।’ তোফায়েল আহমেদের সুরে জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, ‘রাজনীতির মঞ্চগুলো আস্তে আস্তে ব্যবসায়ীরা দখল করছেন। দেশ চালাচ্ছে কারা? দেশ চালাচ্ছেন জগৎ শেঠরা। দেশ চালাচ্ছেন আমলারা।’
গণতন্ত্রের জন্যই দরকার দক্ষ আমলাতন্ত্র। আমলাতন্ত্র জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত রাজনৈতিক সরকারের কর্তৃত্বাধীন নির্বাহী বিভাগের অংশ। রাষ্ট্রের তিন প্রধানতম অংশ—সংসদ, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের অন্যতম একটি অঙ্গের স্থায়ী, বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমষ্টি। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি কেন এবং কীভাবে তৈরি হলো?
উপনিবেশের অনুগত শ্রেণি
উপনিবেশকালের দুটো ভিন্ন লক্ষ্য সামনে রেখে দুটো পৃথক সময়ে আমলাতন্ত্রের বিবর্তন ঘটে। প্রথম পর্যায়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক কালে বা এজ অব ট্রেডে রাজস্ব সংগ্রহই ছিল মূল লক্ষ্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসনকাল বা এজ অব এম্পায়ার গুণগতভাবেই সম্পূর্ণ ভিন্ন। ১৬০০ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৫৮ সালে বাংলায় আসে। পলাশী ও বক্সারের যুদ্ধে জয়ের পর বছরে ২৬ লাখ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে ১৭৬৫ সালে দিল্লির সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা ও বিহারের দেওয়ানি পেয়ে রাজস্ব সংগ্রহ এবং ১৭৭৩ সালে বাংলার নিজামতের অধিকারী হয়। প্রশাসনের উপরিভাগে ব্রিটিশরা থাকলেও খাজনা তোলার জন্য কোম্পানি স্থানীয় এজেন্ট বা আমলা নিয়োগ করে। ‘বাবু’রা নিচু স্তরের আমলা হলেও অধিক হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য দাপুটে কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন। খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার করেন।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ভারত শাসন আইন জারি করে ব্রিটিশ সরকার ভারতের শাসনভার নিজে নেয়। ১৮৩৫ সালে টমাস বেবিংটন মেকওলের নেতৃত্বে ইংরেজি শিক্ষা চালুর মাধ্যমে ব্রিটিশরা বিদ্যমান বর্ণপ্রথাকে কাজে লাগিয়ে একটি অনুগত শ্রেণি বা কনফর্মিস্ট ক্লাস তৈরিতে নিবিষ্ট হয়। জনগণ থেকে বিযুক্ত এ শ্রেণি থেকে তৈরি আমলারাই নিজেদের পোষণ এবং শাসকদের তোষণে নিয়োজিত হয়।
ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ
পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক বিকাশেও দুই ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, অভিজাত শ্রেণির স্বার্থ সংরক্ষণ; দ্বিতীয়ত, জনগণকেন্দ্রিক সংবিধানহীনতায় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীকরণ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের একটি ডমিনিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠার ৯ বছর পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে প্রথম সংবিধান অনুমোদিত হলেও ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর তা বাতিল করা হয়। ১৯৬২ সালের দ্বিতীয় সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বাতিল করে রাষ্ট্রপতিকে কার্যনির্বাহী করে। রাষ্ট্রপতিও মোটাদাগে নাম না বলে নির্ধারণ করা হয়। ২০ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে এমন একজন ব্যক্তি হতে হবে, যিনি অন্তত সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেলের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সেনাবাহিনীর রাষ্ট্রপরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের চুক্তি-সংবিধান না তৈরি হলেও ১৯৪৭ সাল থেকেই এলিট ‘সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস (সিএসপি) ’ নামে আমলাদের অভিজাত শ্রেণি চলমান থাকে।
সামরিক শাসনের বৈধতার সংকটে আমলানির্ভরশীলতা বাড়ে। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ চালু ও ব্রিটিশ আমলের জেলা পরিষদ, স্থানীয় শিক্ষা কর্তৃপক্ষের মতো ব্যবস্থার বিলোপ করে শাসনকে আমলাদের হাতে আরও কেন্দ্রীভূত করা হয়।
১৯৯০-এ গণতান্ত্রিক আন্দোলন আশা-জাগানিয়া। প্রত্যাশা ছিল নির্বাচিত সরকারগুলো একটি সত্যিকার নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে যাবে। কিন্তু নব্বই-পরবর্তীকালে গোষ্ঠীতন্ত্র জেঁকে বসে। আমলাতন্ত্রেরই একটি অংশের প্ররোচনায় দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বিভাজন শুরু হয়।
সত্তরের নির্বাচনের ধাক্কা
১৯৭০-এর নির্বাচন অচলায়তনে বড় ধাক্কা দেয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ভোটের অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। নাগরিক রাষ্ট্র আকাঙ্ক্ষার বীজ রোপিত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তী যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অনেক ধরনের বিভাজন ও উৎকণ্ঠা জারি ছিল। বিদ্রোহী দল-উপদল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমলাতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা বিভেদ শক্তিশালী রূপ নেয়। প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন ও প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি ছাড়াই রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়। জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে পদোন্নতির চল তখন থেকেই শুরু। অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি না হওয়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা ক্রমেই এককেন্দ্রিক হয়ে পড়ছিল।
ক্যু-পাল্টা ক্যুর মাধ্যমে দেশ সামরিক শাসনের বেড়াজালে আটকে যায়। সামরিক সরকার আরও বেশি আমলানির্ভর হয়ে পড়ে। সামরিক সরকারগুলো বৈধতার সংকট কাটাতে আমলাদের সঙ্গে অর্থ, ক্ষমতা ও পৃষ্ঠপোষকতা ভাগাভাগি করে। ব্যবসায়ী, সামরিক-বেসামরিক আমলারা রাজনীতিতে যোগ দিতে থাকেন। গোষ্ঠীতন্ত্রের বীজও রোপিত হয়।
নব্বইয়ের সুযোগ
১৯৯০-এ গণতান্ত্রিক আন্দোলন আশা-জাগানিয়া। প্রত্যাশা ছিল নির্বাচিত সরকারগুলো একটি সত্যিকার নাগরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে যাবে। কিন্তু নব্বই-পরবর্তীকালে গোষ্ঠীতন্ত্র জেঁকে বসে। আমলাতন্ত্রেরই একটি অংশের প্ররোচনায় দ্বিদলীয় রাজনৈতিক বিভাজন শুরু হয়।
সমমনা বা সমর্থক হলে পুরস্কার, আর বিরোধী মতের হলে সাজার প্রচলন শুরু হয়। সাজা হিসেবে ওএসডি করার মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০০৪ থেকে ২০১৩—এই ৯ বছরে জনপ্রশাসনে ওএসডি করা কর্মকর্তার সংখ্যা ৩ হাজার ৬০৫ জন। দলনিরপেক্ষ অনেক কৃতবিদ্য আমলার মনোবল ভেঙে পড়ে। যোগ্যতাসত্ত্বেও অনেকেই পিরামিডের ওপরের দিকে যাত্রা থেকে নিজেদের দ্বারাই বঞ্চিত হতে শুরু করেন। সব ক্ষেত্রে কর্মক্ষমতা-ভিত্তিক পদোন্নতি না হওয়ায় গণতন্ত্রের জন্য শক্তিশালী কার্যকর আমলাতন্ত্র থেকে দেশ বঞ্চিত হয়।
জনপ্রতিনিধিত্বের সংকট
২০১৪ সাল থেকে নিরঙ্কুশ যাত্রা শুরু হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দুর্বলতার সুযোগেই আমলাতন্ত্র-নির্ভরতা। কর্মদক্ষতার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা বিতরণনির্ভর ক্লায়েন্টেলিস্টিক নেটওয়ার্ক বা গোষ্ঠীতন্ত্র গড়ে উঠছে।
স্বজন তোষণকারী গোষ্ঠীতান্ত্রিক ব্যবস্থা উলম্ব ও আনুভূমিকভাবে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত অনানুষ্ঠানিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সংঘবদ্ধ। প্রতিটি স্তরেই প্রধানত আছেন রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী। আদালত, রাজস্ব অফিসসহ ক্ষমতাকাঠামোর আনুকূল্যের মাধ্যমে আয় রোহিতকরণের জন্য ১৮৯৭ সালে টাউট আইন করা হয়েছিল। এ পরজীবীরা এখন গোষ্ঠীতন্ত্রেরই পোক্ত সম্পদ সঞ্চয়নে ব্যতিব্যস্ত। পাকিস্তানের বাইশ পরিবার থেকে এখন যেন বাইশ শ পরিবারের একচেটিয়া ব্যবস্থা চলছে!
সংসদ জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার প্রধানতম মাধ্যম। কার্যকর জনপ্রতিনিধিত্বের মাধ্যমেই ক্ষমতার ভারসাম্য, জবাবদিহি এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়। বর্তমান সংবিধান জনগণের সার্বভৌমত্ব পুরো নিশ্চিত করে না। নির্বাহী বিভাগের কাছে একচেটিয়া ক্ষমতা। যেমন সংসদের কার্যবিধি অনুযায়ী সংসদীয় কমিটি কৃতক অর্থবিল যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। সংসদ বাজেট পুরো গ্রহণ বা বর্জন করতে পারে, পরিবর্তন করতে পারে না। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সাংসদেরা দলের বাইরে ভোটও দিতে পারেন না। বিরোধিতার, কার্যকর তর্ক-বিতর্ক ও পরিবর্তনের সুযোগ সীমিত বিধায় বাজেটে প্রতিবারই স্বজনতোষণ, সম্পদের পুঞ্জীভবনই প্রাধান্য পায়।
নাগরিক রাষ্ট্র বিনির্মাণেই উত্তরণ
গণতান্ত্রিকতা দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্নতা বাড়লে একচেটিয়া ব্যবস্থা কায়েম হয়। একচেটিয়াত্বে আমলাতন্ত্র নিরপেক্ষ থাকতে পারে না; একে অপরের নির্ভরতায় কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠে।
জনগণ প্রজা নয়, নাগরিক। ‘প্রজাতন্ত্রে’র মধ্যেই আমলাতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক শোষণ ও নিপীড়নের চিহ্ন বিদ্যমান। সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে সামনের যাত্রাপথের প্রধানতম অভীষ্ট হোক সমতাভিত্তিক নাগরিক রাষ্ট্র। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারভিত্তিক নতুন সামাজিক চুক্তির দিকে যেতে হবে।
ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ ও ‘উন্নয়ন অন্বেষণ’-এর চেয়ারপারসন
rt@du. ac. bd