আমার মতো যাঁরা ‘আদি গোপালি’, বছর তিরিশেক আগে ঢাকায় আসতে হলে তাঁদের বাদ ফজর রওনা হতে হতো। লঞ্চ বা ফেরিতে গন্ডগোল না থাকলে ঢাকায় পৌঁছাতে বেলা গড়িয়ে মাগরিবে গিয়ে ঠেকত। আর যেদিন ফেরিতে-লঞ্চে কিংবা গাড়ি-ঘোড়াতে ঝুটঝামেলা হতো, সেদিন গাবতলী আসতে আসতে এশার ওয়াক্ত শেষ।
বছর তিরিশেক আগে ঢাকায় আসার একমাত্র রুট ছিল দৌলতদিয়া-আরিচা। রাস্তা ছিল সরু। ঘোরানো-প্যাঁচানো। রাস্তার ওপর আস্ত পুকুর–পুষ্করিণীর ধারণা নিয়ে অগুনতি খানাখন্দ থাকত। পাহাড়ি পথে জিপ যেভাবে উথালপাতাল কায়দায় ‘বঁায়ে বাঁচিয়ে ডাইনে রুখে’ চলে, সেইভাবে বাস এগোত। ঝাঁকাঝাঁকিতে ভ্রমণের সঙ্গে যাত্রীরা মাগনা বডি ম্যাসাজ পেয়ে যেতেন। বিপরীত দিক থেকে দুটো বাস এলে একটি আরেকটিকে জায়গা দেওয়ার জন্য গতি প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনতে হতো। প্রায়ই যাত্রীবোঝাই ‘মধ্যযুগীয়’ লক্কড়ঝক্কড় বাস রাস্তার পাশের পাগাড়ে নেমে পড়ত।
এরপর মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের কাওড়াকান্দি নৌরুট চালু হলো। খুলনা-বরিশালসহ অনেক জেলার পথ কমল অনেকটা। ত্যাড়াব্যাঁকা রাস্তা সোজা করা হলো। সরু রাস্তা দ্বিগুণ প্রশস্ত হলো। উন্নত রাস্তায় আরও ভালো, আরও গতিসম্পন্ন বাস নামল। আরিচা হয়ে যেতে আগে যে সময় লাগত, তা নেমে এল অর্ধেকে। এখন সব মিলিয়ে গোপালগঞ্জ যেতে লাগে সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা। ঢাকা ও দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে এখন যে মানের বাস চলে, পদ্মা সেতু চালু হলে তার চেয়ে আরও উন্নত বাস নামবে। তখন ঢাকা-গোপালগঞ্জ যাতায়াতে সময় লাগবে সোয়া দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা।
বর্তমানে মাওয়া ঘাটে পৌঁছানোর পর বাস থেকে নেমে নদী পার হয়ে ফের বাসে চড়ার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত যত মসিবতের মুখে পড়তে হয়, তা নিয়ে একজন যাত্রী চাইলে অনায়াসে মসিবতনামা শীর্ষক একটি নাতিদীর্ঘ বই লিখে ফেলতে পারবেন। বিশেষ করে ঈদের সময় পদ্মা পাড়ি দেওয়ার একেকটি অভিজ্ঞতা নিয়ে একেকটি উপাখ্যান হতে পারে।
উত্তরবঙ্গের মতো দক্ষিণের মানুষের অভাব অতটা প্রকট নয়। তবে এখনো তাদের অগ্রগতির অনেক সুযোগ আছে। এই সেতু ঘিরে হাজারো কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে
ধরুন, আপনি স্ত্রী, ছেলেমেয়ে নিয়ে রওনা হলেন। আপনার সঙ্গে ভারী লাগেজ, বস্তা, বাক্স। বাস এসে মাওয়ার টার্মিনালে থামার পর বাস থেকে নামলেন। দেখবেন আপনাকে সহায়তা করতে কুলিরা হাজির হয়েছেন। তাঁরা আপনার, আপনার বাচ্চাকাচ্চা আর বাক্স-পেটরার ওপর নজর বুলিয়েই সেকেন্ডের মধ্যে বুঝে ফেলবেন এই মাল আপনার পক্ষে টেনে লঞ্চে ওঠানো সম্ভব নয়। তাঁরা আপনার ব্যাগ–বস্তা দুই মিনিটের রাস্তা বয়ে নেওয়ার জন্য চাইবেন দুই থেকে তিন শ টাকা। আপনার দরাদরি করার সুযোগ কম। দেরি করলে লঞ্চ ছেড়ে দেবে—এই টেনশনে আপনি বিচলিত থাকবেন। আর কুলিরা আসবেন সংঘবদ্ধ হয়ে। আপনি ন্যায্য মজুরি দিতে চাইলেও তাঁরা নেবেন না। তাঁদের বেঁধে দেওয়া মজুরিতেই মাল তুলবেন তাঁরা। একটু চোখের আড়াল হলেই কুলিরা ‘ভুল করে’ চিরকালের মতো মালসহ চোখের আড়াল হয়ে যেতে পারেন।
এরপর ধরুন, আপনি লঞ্চে উঠলেন। গাদাগাদি বিষয়টিকে যদি আপনি সহজভাবে নিতে না পারেন, তাহলে আপনার কষ্ট বাড়বে চার গুণ। লঞ্চের পরিবেশ ও নিরাপত্তাব্যবস্থার কথা লেখাই বাহুল্য। ভালোয় ভালোয় ওপার পৌঁছানোর পর আবার সেই কুলি-বিড়ম্বনার জন্য আপনাকে তৈরি থাকতে হবে।
বছর দুয়েক আগের ঘটনা। ঈদে একা বাড়ি যাচ্ছি। মাওয়া থেকে ভাবলাম স্পিডবোটে পার হই। কাউন্টারে টিকিটের দাম লেখা ছিল সম্ভবত দেড় শ টাকা। তাঁরা দাম নিলেন দুই শ। প্রচণ্ড গাদাগাদি করে বোটে যাত্রী তোলা হলো। খানিকক্ষণ বোট চালানোর পর আমাদের মাঝপদ্মায় এনে মাঝি ইঞ্জিন বন্ধ করলেন। বললেন, তাঁকে আরও এক শ করে টাকা দিতে হবে। এটা ঈদের সালামি। না দিলে তিনি বোট স্টার্ট করবেন না। কয়েকজন প্রতিবাদ করতেই তিনি আরও কয়েকটি বোটের মাঝিদের সেখানে আসতে ইশারা দিলেন। যে প্রতিবাদ করবেন, তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হবে বলেও শাসালেন। ফলে ‘সালামি’ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পার হতে হলো। পরে জেনেছি, এই বোটচালকেরা প্রবল ক্ষমতাধর স্থানীয় লোকদের কর্মী। তাঁরা খুবই বেপরোয়া। তবে পদ্মা সেতু চালু হলে যাত্রীদের মসিবতনামার প্রধান চরিত্র এই স্পিডবোটচালক ও কুলিদের কী হবে, সেটি একটি জাতীয় জনগুরুত্বসম্পন্ন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি সেতু বিস্তীর্ণ একটি এলাকার জনপদকে কীভাবে আমূল বদলে দেয়, তার জ্বলজ্বলে প্রমাণ যমুনার ওপর তৈরি করা বঙ্গবন্ধু সেতু। রংপুর, দিনাজপুর, কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের সঙ্গে ‘মঙ্গা’ নামক যে ‘বাৎসরিক দুর্ভিক্ষের’ নাম জড়িয়ে ছিল, এই বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হওয়ার এক দশকের মধ্যে তা ‘নাই’ হয়ে গেছে। ঠিক সময় নদী পার হতে না পারায় খেতের ফসল দাম না পেয়ে খেতে নষ্ট হয়েছে দশকের পর দশক ধরে। বর্ষার সময় কাজ না পেয়ে দিনমজুরদের উপোস করতে হয়েছে। সেই দিন বদলে গেছে। বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে গোটা উত্তরবঙ্গের অর্থনীতি আমূল পাল্টে গেছে।
উত্তরবঙ্গের মতো দক্ষিণের মানুষের অভাব অতটা প্রকট নয়। তবে এখনো তাদের অগ্রগতির অনেক সুযোগ আছে। এই সেতু ঘিরে হাজারো কর্মসংস্থানের সুযোগ তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। শাকসবজি বা মাছের মতো পচনশীল পণ্য নিয়ে ট্রাক যখন পারাপারের অপেক্ষায় পদ্মার পাড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে, তখন সেই পণ্য পচার আশঙ্কায় মালিকের বুক ঢিপঢিপ করতে থাকে। অনেকেই কাঁচামালের ব্যবসা এই কারণে করতে চান না। কিন্তু সম্প্রতি তাঁদের চিন্তাভাবনা বদলাতে শুরু করেছে। সেতু চালু হওয়ার পরই কার ফসল ঢাকার কোন বাজারের কোন আড়তে বিক্রি করতে হবে, তা নিয়ে তাঁরা এখনই হিসাব-নিকাশ শুরু করে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের পাশ দিয়ে অনেক ভারী শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমি কিনে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের মানুষ নতুন স্বপ্নের কাছে চলে আসছে। একটি সেতুর জন্মের মধ্য দিয়ে তাদের মসিবতনামার উপসংহার টানা হচ্ছে। এ বড় আনন্দের কথা।
● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক