এক এবং অদ্বিতীয়

আড়ংয়ের এক কর্মীর সঙ্গে ব্লক প্রিন্ট নিয়ে মতামত দিচ্ছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাক
আড়ংয়ের এক কর্মীর সঙ্গে ব্লক প্রিন্ট নিয়ে মতামত দিচ্ছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। ছবি: ব্র্যাক
>

বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯–এ গত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরীর এই লেখা তাঁর আত্মজীবনী জীবনের বালুকাবেলায় বইটির নির্বাচিত অংশ। এটি ‘ব্র্যাকপর্ব’ অধ্যায়ের চুম্বক অংশ।

১৯৯২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির একটি ঘটনা। সেদিন সন্ধ্যায় ব্র্যাকের তদানীন্তন নির্বাহী পরিচালক ফজলে হাসান আবেদের বাসায় ঢাকা সফররত রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্টের জন্য একটি অভ্যর্থনাসভা ছিল। সেই সভায় নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানের শেষভাগে। অনুষ্ঠানের অনেক অতিথিই তখন বিদায় নিয়েছেন। সেখানেই ফজলে হাসান আবেদ একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি ব্র্যাকে যোগ দাও না কেন?’ আমি ভেবেছিলাম, আবেদ বোধ হয় কথার কথা বলছেন। অথচ নিজের স্বভাবধর্ম অনুসারেই আবেদ তাঁর প্রস্তাবের ব্যাপারে ছিলেন সিরিয়াস। অদূরেই আমার স্ত্রী দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞেস না করেই আমি সম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই, এটা তো আমার জন্য রোমাঞ্চকরই হবে, হবে নতুন অভিজ্ঞতা।’ এরপর ফেব্রুয়ারির ৮ তারিখ গুলশানে আবেদের বাসায় তিনি আবার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন। ব্র্যাকে আমার দায়িত্ব কী হবে, তা নিয়েও তিনি কথা বললেন। মনে আছে, আবেদ সেদিন আমাকে বলেছিলেন, ব্র্যাক ধীরে ধীরে নতুন প্রজন্মের কাছে চলে যাবে, ব্র্যাককে সেই রূপান্তরের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি বললেন, ‘ব্র্যাকের কার্যক্রমে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছে।’ আবেদের কথা থেকে আমার মনে হলো, দেশ–বিদেশে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড প্রচারে, আমি হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু কাজ করতে পারব। আমার সেদিন আরও মনে হয়েছিল, আবেদ হয়তো এনজিওজগতের বাইরে থেকে তাঁর সংস্থা সম্পর্কে একটি দৃষ্টিপাতের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন।

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালে আবেদ যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছিলেন, সেই সময়ে আমি আমার সরকারি দায়িত্বে সদ্য স্বাধীন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমার ভগ্নিপতি কর্নেল হাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। বোন নাসিম তখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, শোকে দিশেহারা। কথাচ্ছলে আমি একদিন আবেদকে বললাম, ‘তুমি তো ত্রাণ পুনর্বাসনের কাজ করছ, আমার বোন নাসিমকে ব্র্যাকে যদি নিতে পারো, তাহলে ভালো হয়। ও তো এরই মধ্যে টাইপিংয়ের কাজ শিখে নিয়েছে।’ আবেদ বললেন, ‘ঠিক আছে, নাসিমকে ব্র্যাকে যোগ দিতে বলো। তবে বেতন তো তিন শ টাকার বেশি দিতে পারব না।’ তারপর যথারীতি নাসিম ব্র্যাকে যোগদান করল। নাসিম ব্র্যাকের প্রথম পাঁচজন কর্মীর মধ্যে একজন। সেদিক থেকে আমাদের পরিবারে আমি হলাম দ্বিতীয় ব্র্যাককর্মী। যা-ই হোক, ১৯৯২ সালে আমি ব্র্যাকের উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিলাম। তারপর দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। শুরুর বছরগুলোতে দেশের অভ্যন্তরে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে সফর করেছি। অর্থাৎ ব্র্যাকে আমার মোটামুটি দীর্ঘ একটি প্রস্তুতিপর্ব গেছে। অফিসে থাকাকালে আমি আর আবেদ প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজনে মিলিত হতাম। ভোজনের সঙ্গে সঙ্গে চলত অনানুষ্ঠানিক নানা আলোচনা। সেসব আলোচনায় নতুন কোনো ধারণার উদ্ভাবন ঘটিয়ে আমি যে ব্র্যাকের জন্য বড় কোনো অবদান রাখতে পেরেছি, সেই দাবি আমি করব না। আসলে নব উদ্ভাবনে ও প্রবর্তনায় আবেদের মেধা ও প্রতিভা প্রায় কিংবদন্তিতুল্য। তাঁর চিন্তার অগ্রসরতা এবং বস্তুনিষ্ঠতার কোনো তুলনা হয় না। তিনি সর্বদাই ব্র্যাক নিয়ে ভেবেছেন। সেই যে বলা হয়, কানু ছাড়া গীত নেই, ঠিক একইভাবে বলা যায় আবেদের কাছে ব্র্যাক ছাড়া কোনো চিন্তা নেই। আমি বলব, যদি ব্র্যাক ব্যতীত অন্য কোনো চিন্তা আবেদ করে থাকেন, তবে তিনি তা আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছেন। যা-ই হোক, মধ্যাহ্নভোজনের সেই আলাপচারিতায় আবেদ যেন তাঁর চিন্তাগুলোকে আমার মাধ্যমে পরখ করে নিতে চাইতেন। যেন বুঝতে চাইতেন, তাঁর চিন্তা ও পরিকল্পনার যথার্থতা কতটা, কোথাও কোনো ফাঁক বা অসংগতি আছে কি না। সেই সব আলাপচারিতায় আমি আমার উপলব্ধির কথা বলেছি, হয়তো কখনো কখনো দ্বিমতও পোষণ করেছি। তবে একটা কথা বলতেই হবে, ব্র্যাকের বিপুল বিস্তার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ব্যাংক, ব্র্যাক বহির্বিশ্ব কার্যক্রম—এর প্রতিটি বিষয়ই আবেদের চিন্তাধারা থেকে জন্ম নিয়েছে, আলোচনা প্রতি-আলোচনার মধ্য দিয়ে আবেদই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। বস্তুতপক্ষে আবেদের নেতৃত্বই ব্র্যাকের সামগ্রিক সাফল্যগাথার মর্মকথা। এর অঙ্কুর থেকে মহিরুহ হয়ে ওঠার যে চমকপ্রদ উপাখ্যান, সেখানে তাঁর ভূমিকা এক এবং অদ্বিতীয়।...

ব্র্যাক তার শিক্ষা কর্মসূচির কার্যকারিতা ও অনন্যতা দিয়ে বহির্বিশ্বের বিমুদ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। জাতীয় ক্ষেত্রে ওটেপ এবং টিকাদান কর্মসূচির ঈর্ষণীয় সাফল্য এই সংস্থাকে অন্য একটি উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল। একুশ শতকের শুরুতে ব্র্যাক বহির্বিশ্ব কার্যক্রম নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি ঘোষণা করে। ২০০২ সালে ব্র্যাক আফগানিস্তান কর্মসূচি দিয়েই বহির্বিশ্ব কার্যক্রমের সূচনা ঘটে। তখন আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শেষ হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তখন পুনর্গঠনের পালা। এ রকম এক পরিস্থিতিতেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ব্র্যাকের অভ্যুদয় ঘটেছিল। আফগানিস্তানে যুদ্ধাবসানের মুহূর্তে ব্র্যাক তার জন্মকালীন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশটিতে উন্নয়ন কার্যক্রমে অবতীর্ণ হয়।

পৃথিবীর যেকোনো উন্নয়নগামী অথবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দারিদ্র্য এবং অনুন্নয়নের মৌলিক রূপ যখন একই, তখন আফ্রিকার কিছু দেশেও ব্র্যাক তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারবে (ফজলে হাসান আবেদের এই প্রত্যয় থেকেই পূর্ব আফ্রিকার উগান্ডা, তানজানিয়া আর যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ সুদানে ব্র্যাক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরু করে)। তানজানিয়ায় ১৫০ জন, উগান্ডায় ৪০০ জন এবং দক্ষিণ সুদানে ১০০ জন স্থানীয় ব্র্যাককর্মী নিয়ে ব্র্যাক পূর্ব আফ্রিকায় যাত্রা শুরু করে। ওই তিনটি দেশেই সরেজমিনে ব্র্যাকের কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সে এক ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা, জীবনমান উন্নয়নের সেই লড়াই যেমন চমকপ্রদ, তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক। ক্ষুদ্রঋণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কৃষি তথা জীবনের মৌলিক বিষয়গুলোতে পরিবর্তন আনার সেই সংগ্রামকে অভিবাদন জানাতেই হয়।