এক আসনে আওয়ামী লীগের এত নেতা

পাকিস্তান ও বাংলাদেশের দুটি উপনির্বাচন রাজনৈতিক ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় রাজনীতিতে মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। এরই মধ্যে প্রাদেশিক পরিষদে টাঙ্গাইলের একটি আসনে উপনির্বাচন হয় এবং তাতে মুসলিম লীগের জাঁদরেল প্রার্থীকে হারিয়ে নির্বাচিত হন তরুণ শামসুল হক। সেই নির্বাচনে মুসলিম লীগের যে ধস নামল, সেটি তারা আর কখনো পুনরুদ্ধার করতে পারেনি।

বাংলাদেশ আমলে ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীকে জবরদস্তি করে জিতিয়ে আনা হয় এবং সেটিই তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে। এই উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সব বিরোধী দল (জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ) এককাট্টা হয় এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে। এরপর বিএনপির ওই সরকারের অধীনে বিরোধী দল কোনো উপনির্বাচনে অংশ নেয়নি। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পরও উপনির্বাচনগুলো হতো দলীয় সরকারের অধীনে। সেসব উপনির্বাচনেও ক্ষমতাসীন দল যাকে মনোনয়ন দিত, তার জয় নিশ্চিত ধরে নেওয়া হতো। এখন তো সরকারি দল কারও নাম ঘোষণা করলেই এলাকার মানুষ মনে করে তিনিই ভবিষ্যৎ সাংসদ। ভোট অনুষ্ঠান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় না।

বর্তমান সংসদের পাঁচটি শূন্য আসনে উপনির্বাচন হতে যাচ্ছে। সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুন, সাবেক মন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, হাবিবুর রহমান মোল্লা ও ইসরাফিল আলমের শূন্য আসনগুলো হলো ঢাকা-৫ ও ঢাকা-১৮, পাবনা-৪, নওগাঁ-৬ এবং সিরাজগঞ্জ-১। পাবনা-৪ আসনে ২৬ সেপ্টেম্বর এবং ঢাকা-৫ ও নওগাঁ-৬ আসনে ১৭ অক্টোবর নির্বাচন হবে। বাকি দুটি আসনের তারিখ এখনো ঘোষণা করা হয়নি।

সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই উপনির্বাচনে বিএনপিসহ সব দলই অংশ নিচ্ছে। তবে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনা কম। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে হলে যে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাজনীতি দরকার, তা অনেক বছর ধরেই অনুপস্থিত। নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে যত আগ্রহ কমছে, নেতাদের মধ্যে উৎসাহ তত বাড়ছে। একটি আসনে আওয়ামী লীগের পক্ষে সর্বোচ্চ ৫৬ জন ও সর্বনিম্ন ১৮ জন মনোনয়ন চেয়েছেন। তাঁদের ধারণা, মনোনয়ন কোনোভাবে বাগাতে পারলেই সাংসদ হওয়া নিশ্চিত।

প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, পাঁচটি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৪১ জন দলীয় ফরম সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি মনোনয়ন ফরম বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকায়। অতীতে জাতীয় নির্বাচনেও প্রার্থী হওয়ার জন্য এত নেতার আগ্রহ দেখা যায়নি। ২০১৮ সালে প্রতিটি আসনের বিপরীতে ১৪ জন ফরম নিয়েছিলেন। চলতি বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত ঢাকা-১০, বগুড়া-১, বাগেরহাট-৪, যশোর-৬ ও গাইবান্ধা-৩ আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ফরম বিক্রি হয়েছিল গড়ে ১৫টি।

এবার উপনির্বাচনে সব আসনেই প্রয়াত সাংসদের স্ত্রী বা সন্তান মনোনয়ন চেয়েছেন। মোহাম্মদ নাসিমের আসনে তাঁর ছেলে, হাবিবুর রহমানের আসনে তাঁর স্ত্রী এবং ইসরাফিলের আসনে তাঁর স্ত্রী মনোনয়নপ্রত্যাশী। কিন্তু পাবনা-৪ আসনে ঘটেছে অভূতপূর্ব ঘটনা। প্রয়াত সাংসদ শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী কামরুন নাহার শরীফ, সাংসদের বড় ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ, বড় মেয়ে মাহজেবিন শিরিন, তাঁর স্বামী আবুল কালাম আজাদ পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁরা প্রত্যেকে নিজেকে যোগ্যতম মনে করেন।

আগের দিনে রাজা মারা গেলে সন্তানেরা রাজত্ব নিয়ে মারামারি করতেন। এখন বাংলাদেশে সাংসদেরা নিজ নিজ আসনে নিজেদের রাজাই মনে করেন। এ কারণে একই পরিবারের পাঁচজন সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছেন। একজন মনোনয়ন পেলেই পারিবারিক রাজত্ব অটুট থাকবে।

ঢাকা–১৮ আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ৫৬ জন। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত সাংসদ সাহারা খাতুনের দুই ভাগনেও আছেন। আছেন দক্ষিণখান, খিলক্ষেত, তুরাগ, উত্তরা, উত্তরখান, বিমানবন্দর থানার আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় কাউন্সিলরও। বাদ যাননি ব্যবসায়ী ও সাবেক আমলারাও।

সাংসদ হওয়া এখন লাভজনক ব্যবসা। বাংলাদেশে একজন সাংসদ আইনানুগভাবে যেসব সুযোগ-সুবিধা পান, অনেক দেশের সাংসদেরা তা পান না। উদাহরণ হিসেবে শুল্কমুক্ত গাড়ি ও থোক বরাদ্দের কথা বলা যায়। অনেক সাংসদ শুল্কমুক্ত গাড়ি এনে বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা মুনাফা করেছেন। ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব সাংসদই শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা নিয়েছেন একাধিকবার।

বাংলাদেশের সাংসদদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বছর দুই আগে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাংসদদের মাসিক বেতন ৫৫ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকার ভাতা প্রতি মাসে ১২ হাজার ৫০০ টাকা, সম্মানী ভাতা প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা, শুল্কমুক্তভাবে গাড়ি আমদানির সুবিধা, মাসিক পরিবহন ভাতা ৭০ হাজার টাকা, নির্বাচনী এলাকায় অফিস খরচের জন্য প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা, মাসিক লন্ড্রি ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, মাসিক ক্রোকারিজ, টয়লেট্রিজ কেনার জন্য ভাতা ৬ হাজার টাকা, দেশের অভ্যন্তরে বার্ষিক ভ্রমণ খরচ ১ লাখ ২০ হাজার টাকা, স্বেচ্ছাধীন তহবিল বার্ষিক পাঁচ লাখ টাকা, বাসায় টেলিফোন ভাতা বাবদ প্রতি মাসে ৭ হাজার ৮০০ টাকা পেয়ে থাকেন। (সূত্র: বিবিসি, ২৯ নভেম্বর ২০১৮)

এর বাইরে একজন সাংসদ এলাকার উন্নয়নকাজের জন্য প্রতিবছর ২০ কোটি টাকা করে থোক বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। এই অর্থ তিনি নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন। সংসদ ভবন এলাকা ও পুরোনো সংসদ ভবনের পাশে সাংসদদের জন্য ন্যাম ফ্ল্যাট আছে। অনেক সাংসদ নিজে না থেকেও ন্যাম ফ্ল্যাটের বরাদ্দ নিয়ে পোষ্যদের রাখেন। এ নিয়ে অতীতে কেলেঙ্কারি কম হয়নি।

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কথা বাদ দিলেও একজন সাংসদ যে আর্থিক ও বৈষয়িক সুবিধা পান, তা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বিবেচনায় যথেষ্ট। সাংসদের পরিবারের সবাই লাল পাসপোর্ট পেয়ে থাকেন। লাল পাসপোর্ট মানে ভিআইপি মর্যাদা। সাধারণের থেকে আলাদা। আমাদের সব জনপ্রতিনিধিই অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।

উপনির্বাচনে একটি আসনে বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী সম্পর্কে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনীতি এখন আর জনগণের স্বার্থে পরিচালিত হচ্ছে না। মৌচাকে যেমন মৌমাছি ভিড় করে, নির্বাচন এলে মনোনয়নের জন্যও নেতারা ভিড় করেন। সাংসদ পদ ব্যবহার করে অনেকেই ব্যক্তিগত সম্পদের স্ফীতি ঘটান। যঁারা মনোনয়ন পান না, তাঁরাও দলের সঙ্গে আছেন, সেটি দেখিয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন।

সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় সবচেয়ে ক্ষমতাশালী হিসেবে পরিচিত। সংবিধান অনুযায়ী সাংসদদের কাজ আইন প্রণয়ন করা। সাম্প্রতিক কালে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রশাসনিক ও নির্বাহী ক্ষমতায় রূপান্তরিত হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীসহ প্রায় ৪০ ধরনের প্রকল্প আছে। এসব প্রকল্পের কাজেও সাংসদেরা খবরদারি করে থাকেন। একসময় সাংসদ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় যত খুশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারতেন। বর্তমানে সর্বোচ্চ চারটির সভাপতি হতে পারেন। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক পর্যবেক্ষণে কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে সাংসদদের না রাখার নির্দেশ দিয়েছে। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজগুলাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এতে সাংসদদের ‘শিক্ষা–বাণিজ্য’ কিছুটা হলেও কমবে।

ভোটার আসুক না আসুক ওই পাঁচ আসনেও নির্ধারিত তারিখে উপনির্বাচনও হয়ে যাবে। ইসি এখন আর ভোটার নিয়ে ভাবে না। বিগত উপনির্বাচনগুলো যেভাবে হয়েছে, সামনের পাঁচটিও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। কেননা নির্বাচন কমিশনে যাঁরা আছেন, তাঁরা জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় উৎসাহী নন, ক্ষমতাসীনদের কৃপা লাভে আগ্রহী।

১৯৯৪ সালে একটি উপনির্বাচনের অঘটনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মহা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। এবারের পাঁচটিতে অঘটন ঘটলেও তেমন কিছু হবে বলে কেউ বিশ্বাস করেন না। কেননা, আওয়ামী লীগ নেতারা অনেক আগেই বলে দিয়েছেন, আন্দোলন করার ‘মুরোদ’ বিএনপির নেই। বিএনপির ‘মুরোদ’ থাক বা না থাক, জনগণের ভোটাধিকারের কী হবে?


সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]