২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

এই শীতকালটা না জানি কত ভয়ংকর হয়

করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বাংলাদেশে যেমন, পৃথিবীর অন্যত্রও তেমনি ভয়ংকরভাবেই আঘাত হেনেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভিড–১৯ মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, সবখানেই আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যাও। বাংলাদেশের লেখচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বরে করোনার প্রকোপ কিছুটা কমে এসেছিল, নভেম্বরের শেষের দিক থেকেই আক্রান্ত আর মৃত্যুর গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। বাংলাদেশে হাসপাতালগুলো ভরে গেছে কোভিড রোগীতে।

একই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রেও। হাসপাতালে আবার বাড়ছে রোগীর সংখ্যা।

কাতার এয়ারলাইনসের বিমানে ২১ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পথে সস্ত্রীক উড়াল দিয়েছিলাম ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে। নিয়ম হলো ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোভিড পরীক্ষা করে ফল নেগেটিভ হলে বিমানে চড়া যাবে। কিন্তু এক ভদ্রলোক যাবেন ইউরোপের একটা দেশে। সেই গন্তব্য-দেশের নিয়ম হলো করোনা টেস্টের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সে দেশে ঢুকতে হবে। বিমানকর্মীরা বললেন, আপনাকে বিমানে নেওয়া যাবে না। তিনি বলছেন, এটা কীভাবে সম্ভব যে আমি টেস্ট করে রিপোর্ট নিয়ে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সে দেশে পৌঁছাব? রিপোর্ট পেতেও তো সময় লাগে। বিমানকর্মীরা বললেন, এটা আমাদের নিয়ম নয়। ওই দেশের আইন। যাত্রী বলছেন, আপনাদের ওয়েবসাইটে তো আছে ৭২ ঘণ্টা। বিমানকর্মীরা বলছেন, এটা আমাদের নিয়ম, আর ওটা গন্তব্য-দেশের আইন।

আমরা ঢাকার একটা অনুমোদিত ল্যাবরেটরিতে কোভিড টেস্ট করিয়েছি। করোনা পাওয়া যায়নি, এই রিপোর্ট ছয় ঘণ্টার মধ্যে খুদে বার্তায় চলে এসেছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও পাঠিয়েছে এসএমএস। অনলাইনে গিয়ে নিজের রিপোর্ট বের করে প্রিন্ট
আনতে হয়। বানানো কাগজ হলে হবে না। কারণ, বিমানবন্দরে খুব কড়াকড়ি। অনলাইনে ঢুকে তাঁরা চেক করেন রিপোর্ট সত্য কি না। করোনার রিপোর্টের তিন কপি হাতে থাকা ভালো। তিন জায়গায় করোনার রিপোর্ট চেক করা হয়।

মাস্ক তো পরতেই হয়, একটা ফেসশিল্ডও দেওয়া হয়। মাস্ক পরে ফেসশিল্ডে মুখ ঢেকে উঠতে হয় বিমানে। তবে বিমান আকাশে উড়ে গেলে খাবার চলে আসে, তখন তো মাস্ক পরে থাকা যায় না। সব যাত্রী মাস্ক ও ফেসশিল্ড খুলে ফেলেন। তারপরও বলা হয়, বিমানযাত্রা করোনার জন্য নিরাপদ। কারণ, দুই মিনিট অন্তর অন্তর বিমানের ভেতরের বাতাস বিশুদ্ধ করা হয়। একজন করোনা পজিটিভ যাত্রী বিমানভ্রমণ করেছেন মাস্ক পরে, তিনি কাউকেই আক্রান্ত করেননি। এমআইটির অনলাইন প্রকাশনায় ওটা বলা আছে। বিমানযাত্রাকে মোটামুটি নিরাপদই বলা হচ্ছে। তবে ঘরে থাকাই যে বেশি নিরাপদ, তাতে সন্দেহ নেই।

উল্টো ঘটনাও হয়তো আছে। বিমানে উঠে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন, খুঁজলে সেই উদাহরণ পাওয়া যাবে না—বড় মুখ করে বলি কী করে! আমাদের যাত্রায় দোহা থেকে নিউইয়র্ক ফ্লাইটে যাত্রীসংখ্যা কম ছিল। ফাঁকা ফাঁকা করে বসা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে এসে দেখা গেল, এখানে করোনাবিষয়ক সতর্কতা সর্বোচ্চ। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে, না হলে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। না পরলে ৫০ ডলার জরিমানা। লস অ্যাঞ্জেলেসে সৈকতে দৌড়াতে গেলেও মাস্ক পরা আবশ্যক। সামনে বড়দিন। বড়দিনে বেরিয়ে পড়াকে নিরুৎসাহিত করে প্রচার চালানো হচ্ছে। লোকেরা সাধারণত ঘর থেকে বের হয় না। একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখাও করে না। একসঙ্গে সমবেত না হতে বারবার করে বলা হচ্ছে।

নিউইয়র্কের পরিস্থিতি ২০২০-এর প্রথম ভাগে খুব খারাপ ছিল। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশে চাকরি করেন, এমন একজন বাংলাদেশি আমেরিকান জানালেন, ঘরে ঘরে লাশ পড়ে ছিল। নেওয়ার লোকও ছিল না। ৯১১ নম্বরে কল করে অ্যাম্বুলেন্স জোটেনি

বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে একটু বোকা বনে গেছি। আমাদের দেশে তো রাস্তাঘাটে হাজার হাজার মানুষ দেখে এসেছি। কারওয়ান বাজারে ভিড়। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিজে বের হইনি, তারপর আস্তে আস্তে বের হতে শুরু করি ঘরের বাইরে। যত দিন ঘরে ছিলাম, ধারণা ছিল সবাই বোধ হয় ঘরে থাকে। বাইরে গিয়ে ধারণা হলো, সবাই বোধ হয় বাইরেই থাকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে মানুষ পারতপক্ষে ঘর থেকে বের হয় না। সবাই মাস্ক পরে।

আবার মাস্ক পরার বিষয়ে যেসব গাফিলতি দেশে দেখে এসেছি, সেসবও দেখি। লোকেরা মাস্ক চিবুকের নিচে ঝুলিয়ে রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ–বা মুখ ঢেকে রেখেছে, নাক দিব্যি খোলা। রেস্টুরেন্ট বেশির ভাগ বন্ধ, আবার অনেকগুলো খোলাও। বাস-ট্রেন-বিমান-গাড়ি সবই চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউসি বিবিসিকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র এখন সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে সংক্রমণের হার এত দ্রুত বাড়ছে যে প্রায় প্রতিদিনই তা নতুন রেকর্ড গড়ছে।’

নিউইয়র্কের পরিস্থিতি ২০২০-এর প্রথম ভাগে খুব খারাপ ছিল। নিউইয়র্ক সিটি পুলিশে চাকরি করেন, এমন একজন বাংলাদেশি আমেরিকান জানালেন, ঘরে ঘরে লাশ পড়ে ছিল। নেওয়ার লোকও ছিল না। ৯১১ নম্বরে কল করে অ্যাম্বুলেন্স জোটেনি। অ্যাম্বুলেন্স জুটলেও হাসপাতালে জায়গা হয়নি। এক বাংলাদেশি পরিবার তাদের বাবার লাশ দেখতে চেয়েছিল। বহু অনুনয়-বিনয়ের পর সমাধিস্থলে প্যাকেট সরানো হলে তাঁরা যা দেখেন, তা না দেখাই ভালো ছিল। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, টিউব, বিছানাসহ মৃতকে মোড়কে মোড়া হয়েছে। ওভাবেই কবর হবে।

দ্বিতীয়বার কোভিড হয় কি না, একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান পেলাম। মার্চ-এপ্রিলের দিকে তঁাদের পরিবারে সবার কোভিড হয়। তাঁর ভাই নভেম্বরে আবার কোভিড পজিটিভ। যিনি জানালেন, তিনি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিয়মিত লেখক-সাংবাদিক।

আবার আশাও আছে। ডিসেম্বরের ১০ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে টিকা দেওয়া শুরু হবে। হয়তো তারপর আস্তে আস্তে করোনার ভয় কমতে থাকবে। তারপর শীত কেটে যাবে। বসন্ত আসবে। গরমেও করোনার ক্ষতি করার ক্ষমতা কমে আসবে। বসন্তে বইবে সুবাতাস। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাস অনেকবার নিজেকে বদলে কম ক্ষতিকর করে তুলেছে। তা সত্ত্বেও মৃত্যুর সংখ্যা তো কমছে না। আমাদের দেশে কোভিডে মন্ত্রী মারা গেছেন, প্রতিরক্ষাসচিব মারা গেছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল মারা গেছেন। তা থেকেই বোঝা যায়, করোনা আমাদের কত বিশাল ক্ষতি করেছে।

একজন বাংলাদেশি আমেরিকান ট্যাক্সিচালক জানালেন, নিউইয়র্কে তাঁরা ভাতা পান। প্রতি সপ্তাহে স্বামী-স্ত্রী আর সাবালক সন্তানদের নিয়ে যে বেকার ভাতা পান, তাতে মাসে প্রায় তিন হাজার ডলার আসে। সে কারণে তিনি করোনার সময় ট্যাক্সি চালাননি। ঘর থেকে বেরই হননি।

দেশে ফিরব বলে নিউইয়র্কে আবার কোভিড টেস্ট করতে হলো। ভালো লাগল হাসপাতালের ডাক্তার-কর্মচারীদের সহযোগিতার মনোভাব। নিজেরা ডেকে নিয়ে গিয়ে ফরম পূরণ করতে সাহায্য করে নমুনা নিয়ে হাসিমুখে বিদায় জানালেন। টাকা লাগল না। ১২ ঘণ্টা পরে অনলাইনে রিপোর্ট আসবে। যথাসময়ে খুব ভয়ে ভয়ে অনলাইনে রিপোর্ট দেখা হলো। নেগেটিভ। বুকের ওপর থেকে পাষাণভার নেমে গেল।

বাংলাদেশে আমাদের শীতকালটা চরম সাবধানতার সঙ্গেই পার করতে হবে। শীত যত বাড়বে, তাপমাত্রা কমবে, বাতাসে ধূলিকণা ভাসবে, বিপদ ততই বাড়বে। আমাদেরও বসন্ত আসবে। টিকা আসুক। গরমে করোনাভাইরাস দুর্বল হোক। আমরাও সানন্দে-নির্ভয়ে বসন্তবরণ করে নিতে পারব।

আলবেয়ার কামুর প্লেগ উপন্যাসে প্লেগ চলে যাওয়ার পর শহরে আতশবাজি করা হয়। একজন খারাপ মানুষ অবশ্য উন্মাদ হয়ে যায়, কেন মহামারি চলে যাচ্ছে, তার ব্যবসা নষ্ট হবে...।

আমার মনে হয়, হেমন্ত ও শীতকালে বাংলাদেশে চরম সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। তারপর আমরা ফুলে ফুলে বসন্তবরণ করে নেব। আমাদেরও কোকিল ডাকবে, দখিনা সমীরণ এসে প্রফুল্ল করে তুলবে দেহ-মন। তারপর আসবে বৈশাখ। তাপস নিশ্বাস বায়ে বছরের আবর্জনা দূর করে গ্লানি জরা মারি দূর করে দেবে বাংলাদেশ থেকে।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক