সোমবার ৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ সময় ভোর পাঁচটা পাঁচ মিনিটে ঢাকা থেকে ৩৫১ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ভারতের মণিপুরের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমে ও ৫৫ কিলোমিটার মাটির গভীরে রিখটার স্কেলে ৬ দশমিক ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঘটে। এই ভূমিকম্পের ঘটনায় ঢাকা, রাজশাহী, লালমনিরহাট ও জামালপুরে একজন করে মোট ছয়জন লোক আতঙ্কিত হয়ে মারা যান এবং সিলেট ও ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে বেশ কিছু লোক আহত হওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। যদিও ভূমিকম্পের ফলে উৎসস্থল থেকে কয়েক শ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা শহরগুলোর কোন শহরে কতটা তীব্রতা ছিল তা সঠিকভাবে জানতে কিছুটা সময় লাগে, তবে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে, সিলেটে তীব্রতা ছিল ৫ এবং ঢাকা, রাজশাহী বা লালমনিরহাটে ছিল ৪। তীব্রতার মোট ১২টি স্কেলের মধ্যে ৪-৫ মৃদু-তীব্রতার পর্যায়ে পড়ে। গত বছর ২৫ এপ্রিল নেপালে ঘটা ভূমিকম্পের ফলেও আতঙ্কিত হয়ে বাংলাদেশে তিনজন লোক মারা গিয়েছিল এবং আহত বা অসুস্থ হয়ে অনেক লোক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল।
বাংলাদেশের জনগণ ভূমিকম্পের কাঁপুনি সম্পর্কে অভ্যস্ত নয়। কারণ, বাংলাদেশে ভূমিকম্প প্রবণতা জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপাইন বা ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের তুলনায় অনেক কম। তাই এ দেশে নিকট বছরগুলোতে যে কম্পনগুলো হয়েছে, তা-ও হয়েছে মাঝেমধ্যে। তা ছাড়া কম্পনগুলো বড় বা মধ্য তীব্রতার নয় বরং ছিল ছোট তীব্রতার। অধিক ভূমিকম্প প্রবণতার কারণেই জাপান, তাইওয়ান, ফিলিপাইনের জনগণ প্রায় প্রতিদিনই ভূমিকম্প অনুভব করে এবং তারা ভূমিকম্পের সময় মোটেই আতঙ্কিত হয় না। বাংলাদেশে কম্পন অনুভূত হলেই অনেক লোক যে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে, তার অন্যতম কারণটি হচ্ছে অনভ্যস্ততা। যেমন সোমবার ৪ জানুয়ারির ভূমিকম্পে অতটা আতঙ্কিত হওয়ার কারণ ছিল না। অথচ ছয়টি জীবন শেষ হয়ে গেল। সম্ভবত তারা আতঙ্কের ফলে হার্ট অ্যাটাকের শিকার হয়েছেন। এমন নয় যে কারও শরীরের ওপর কিছু পড়েছে। আরও একটি বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা ছাত্রদের আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে আহত হওয়ার ঘটনা। কম্পনটি আরও একটু বেশি তীব্রতার হলে এই আতঙ্কের হার জ্যামিতিক হারে বেশি হতো মনে হয়।
আমাদের দেশ ভূমিকম্পপ্রবণ। তাই ভূমিকম্প সহনশীল ভবনে বাস করাও অপরিহার্য। সঙ্গে সঙ্গে এটিও বলা যায় যে ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার অর্থ নেই, কারণ খুব বড় ঝাঁকুনিতে এ দেশ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে মৃদু ভূমিকম্পে অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন, কারণ এমন ছোট ঝাঁকুনি ভবিষ্যতেও হতে পারে। তা ছাড়া, ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই। বরং যেসব জায়গায় অনেক লোকের বাস যেমন বহুতল ভবন, ছাত্রাবাস, কয়েদখানা এবং যেসব জায়গায় বহু লোক জড়ো হয় যেমন বহুতল ভবনে মার্কেট, সেসব জায়গায় আতঙ্কিত হয়ে পদপিষ্টের কারণে বহু লোক মারা যেতে পারে। অর্থাৎ ভবনটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণে নয় বরং মানবসৃষ্ট আতঙ্ক বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তবে বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ভবনটির ওপর বাসিন্দাদের ভূমিকম্প সহনশীলতার আস্থা থাকা। এ বিষয়ে ২৯ অক্টোবর ২০১৫ প্রথম আলোতে ‘প্রথম প্রস্তুতি ভূমিকম্প সহনশীল ভবন নির্মাণ’ শিরোনামে লিখেছিলাম। ভূমিকম্প সহনশীল ভবন হলে ঝাঁকুনির সময় বরং বারান্দায় গিয়ে পাশের ভবনটির দোল খাওয়া দেখা যেতে পারে।
>ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার অর্থ নেই, কারণ খুব বড় ঝাঁকুনিতে এ দেশ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। তবে মৃদু ভূমিকম্পে অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন, কারণ এমন ছোট ঝাঁকুনি ভবিষ্যতেও হতে পারে
হঠাৎ একটি কম্পন অনুভূত হওয়ার সময় ‘এটা কিছু না’ এমনই মনে করা শ্রেয়। দৌড়ঝাঁপ করে তো লাভ নেই, এমনই ভাবতে ভাবতে প্রথমেই বাড়ির মূল দরজাটা খুলে দিতে হবে। কারণ, ভূমিকম্পে যদি ভবন বিধ্বস্ত হয় তাহলে মূল দরজা আটকে গিয়ে পরে বাইরে বের হওয়ার সুযোগ না-ও থাকতে পারে। তারপর গ্যাসের চুলা ও বিদ্যুতের সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর শক্ত টেবিলের নিচে আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে। নরম জিনিস ব্যবহার করে মাথাটা রক্ষা করা গুরুত্বের। প্রথম কম্পনটি থেমে গেলে বাইরে বের হওয়া ভালো, কারণ প্রথম কম্পনটির পরে আরও কিছু কম্পন অনুভূত হতে পারে, যাকে বলে আফটার শক। তবে বাইরে বের হতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করা বা প্যানিক সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। বরং পরিবারের সব সদস্যদের নিয়ে (সম্ভব হলে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসসহ) ধীরে ধীরে বের হওয়াই ভালো।
ভূমিকম্পের সময় লিফট ব্যবহার করা নিষেধ। কিন্তু সিঁড়ি ব্যবহার করতে গিয়ে যদি প্যানিকই সৃষ্টি হয়, তবে সিঁড়িতেই পদপিষ্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। এ জন্য একটি ভবনের প্রত্যেকের সহযোগিতা ও সহনশীলতার মধ্য দিয়ে প্যানিক সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। একসময় ছিল যখন ঢাকার বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ছিল দ্বিতল বাড়ি, যার সামনে ছিল খোলা জায়গা। ওই অবস্থায় ভূমিকম্প হলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাড়ির বাইরে খোলা জায়গায় বের হয়ে আসা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখন আকাশের দিকে বেড়ে চলা বহুতল ভবনে বাস করার প্রয়োজন হওয়াতে তেমনটি আর সম্ভব নয়। এক জায়গায় অনেক লোক থাকার জন্য সবার প্রতি সবার সহনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জন্য বহুতল ভবনের পরিচালনা কমিটির মাধ্যমে বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
সহজ কথায় বলা যায়, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসে ভূমিকম্পের কারণে আতঙ্কিত হওয়ার তেমন অর্থ নেই। তবে ভূমিকম্প–বিষয়ক বিভিন্ন টিপস পড়ে এ বিষয়ে ধারণা থাকা ভালো। সাঁতার কাটা জানা থাকলে প্রয়োজনে যেমন কাজে লাগানো যায়, তেমনি ভূমিকম্প সম্পর্কে জানা থাকলে কাজে লাগলেও লাগতে পারে। কারণ, বলে-কয়ে আসে না বলে ভূমিকম্পে প্রস্তুতি ও সচেতনতা থাকা অপরিহার্য।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী, ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ আর্থকোয়েক সোসাইটির সাবেক মহাসচিব।