ঘড়িতে রাত দুইটা। সারা দিন ক্লাস, পরীক্ষা, পড়াশোনা শেষে আপনি ঘুমিয়েছেন। হুট করেই আপনার দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দিতেই ঢুকে পড়ল কয়েকজন। আধো ঘুম-আধো জাগরণে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। কিন্তু আপনার দিকে ছুটে এল গালির তুবড়ি, ‘এই, তুই হল থেকে বের হ। বের হবি না? এই বেড বের করে দে। তোর অ্যালোট কোন রুমে। কে তোকে অ্যালোট দিছে?’ আপনি হলের বৈধ শিক্ষার্থী, হল অফিস থেকে দেওয়া সিট বরাদ্দের কার্ডটি আপনি দেখালেন। এবার শুরু হলো মারপিট। আপনার বিছানা-বালিশ, বই, জামা আর যা কিছু সম্বল সবকিছু বাইরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হলো। তারপর গলাধাক্কা দিয়ে আপনাকে হল থেকে বের করে দেওয়া হলো।
এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় নিজেকে ভাবতে পারছেন না, তাই তো? কিন্তু এই নির্মম ঘটনাটি সত্যি সত্যি ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আবদুল লতিফ হলের ২৪৮ নম্বর কক্ষে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর নাম মো. মুন্না ইসলাম। তিনি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। যাঁরা এই অপরাধ করেছেন, তাঁরা শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম হোসেনের অনুসারী।
মুন্নার বাবা প্রতিবন্ধী, মা বেঁচে নেই। হলের সব প্রক্রিয়া মেনেই প্রশাসনের মাধ্যমে পাঁচ মাস আগে তিনি হলে উঠেছিলেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মুন্না নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়াটাই স্বাভাবিক। মা হারা-বাবা প্রতিবন্ধী—মুন্নার এই যে নাজুক মানসিক বাস্তবতা, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের গণতান্ত্রিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তার ক্ষত নিরাময়ের একটা বড় উপায় হতে পারত। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। তাঁর ওপর মধ্যরাতে যে নিপীড়ন চলেছে, যে অপমানের বোঝা তাঁকে সইতে হয়েছে, সেই মানসিক ট্রমাটা কি বাকি জীবনে ভুলতে পারবেন?
সবাইকে ছাত্র হিসেবে সমানভাবে দেখতে চাওয়াটা নিঃসন্দেহে হিতকারী ভাবনা। কিন্তু রাজনৈতিক দলীয় লেজুড়বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকনেতা কিংবা রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া প্রশাসনিক ক্ষমতায় বসা শিক্ষক—সব শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখতে কতটা পান? এ হিতকারী বক্তব্য মূল সমস্যাটাকেই আড়াল করে দেয়। ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাত্র রাজনীতিতে যে সমস্যা, সেটাকে সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে।
মুন্নাকে বরং সাহসীই বলা চলে। নিজের ওপর এই নিপীড়নের ঘটনা ফেসবুক গ্রুপে পোস্ট দিয়েছেন। হল প্রাধ্যক্ষের কাছে নালিশ জানিয়েছেন। তাতে সিটটি তিনি ফিরে পেয়েছেন। ছাত্রলীগের তিন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে ‘মৃদু’ শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। একজনকে হল থেকে সাময়িক বহিষ্কার, অন্য দুজনকে (আরেকটি হলের আবাসিক ছাত্র) হল ছাড়ার নির্দেশ (অথচ এটা সুস্পষ্টভাবে ফৌজদারি অপরাধ)। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও রসায়ন বিভাগের শিক্ষক মো. কুদরত-ই-জাহান হল প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করেছেন। উষ্মা প্রকাশ করে বলেছেন, ‘তাঁর ছাত্র নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের আমরা ছাত্রলীগ হিসেবে দেখছি না। যারা এটা করেছে তারা ক্রিমিনাল। মাঝরাতে একজন আবাসিক শিক্ষার্থীকে বের করে দেবে, মারধর করবে, এটা মগের মুল্লুক নাকি?’
মুন্নার সঙ্গেই যে প্রথম এ রকম মগের মুল্লুকের আচরণ করা হয়েছে, তো নয়। করোনা সংক্রমণে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার রেকর্ড গড়ার পর গত বছরের ১৭ অক্টোবর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল খুলে দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রলীগ হলে হলে তালা মারতে শুরু করে। বৈধভাবে হলে ওঠা শিক্ষার্থীদের নানা কায়দায় (শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন) হল ছাড়া করতে থাকে। প্রথম আলোতে এ ধরনের ১২টি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে হল ছাড়তে বাধ্য হওয়া শিক্ষার্থীর প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে ছাত্রলীগ যে বেপরোয়া ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তাতে কেউই মুখ খোলেননি, মুখ বুজে হল ছেড়েছেন। সম্ভবত ছাত্রলীগ দুটি উদ্দেশ্য থেকে এটা করছে। প্রথমত, দখলদারির মাধ্যমে নিজ নিজ অনুসারী কর্মীদের দিয়ে হল দখলে রাখা। দ্বিতীয়ত, সিট-বাণিজ্য অর্থাৎ টাকার বিনিময়ে সিটগুলো ভাড়া দেওয়া।
ছাত্রলীগের বেপরোয়া ও অনৈতিক ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের এই চিত্র শুধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কম-বেশি একই চিত্র। গত সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে চোর অপবাদে পিটিয়ে বের করে দেওয়া হয় একজন আবাসিক শিক্ষার্থীকে। ছাত্রলীগের রাজনীতি করলেও রেহাই মেলেনি। প্রশ্ন হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাস, হল ও শ্রেণিকক্ষে মগের মুল্লুক বানানোর সুযোগ ছাত্রলীগকে কে করে দিয়েছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের রাজনীতিকে যত দিন ক্ষমতাসীনেরা তাদের টিকে থাকার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা বন্ধ না করবে, তত দিন পর্যন্ত কি এই মগের মুল্লুকের নির্যাতন বন্ধ হবে?
শিক্ষক সমিতির সভাপতির মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হকও বলেছেন, ‘যাঁরা সমস্যা সৃষ্টি করছেন, তাঁরা ছাত্র। আবার যাঁরা ভুক্তভোগী, তাঁরাও ছাত্র। এখানে কোনো ছাত্রসংগঠন হিসেবে দেখছি না। আমরা দেখছি সবাই আমাদের ছাত্র।’ সবাইকে ছাত্র হিসেবে সমানভাবে দেখতে চাওয়াটা নিঃসন্দেহে হিতকারী ভাবনা। কিন্তু রাজনৈতিক দলীয় লেজুড়বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকনেতা কিংবা রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে পাওয়া প্রশাসনিক ক্ষমতায় বসা শিক্ষক—সব শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখতে কতটা পান? এ হিতকারী বক্তব্য মূল সমস্যাটাকেই আড়াল করে দেয়। ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাত্র রাজনীতিতে যে সমস্যা, সেটাকে সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের একক ও নিরঙ্কুশ অবস্থান যে এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের উৎস, সেটাকে স্বীকার করে না নিলে হিতকারী বক্তব্য দেওয়া যাবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আবার সেই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার রাজনীতির একই দুষ্টচক্রে যখন শিক্ষকেরা বন্দী, তখন তাঁরা ঠিক পদক্ষেপটি নেওয়ার নৈতিক অধিকারটা কি রাখেন?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিপীড়ন নিয়ে সরব এই শিক্ষক আবাসিক হলে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দখলদারি, আসন-বাণিজ্য, শিক্ষার্থীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতীকী অনশন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগে থেকে ঘোষণা দিয়েই অনশনে বসেন তিনি। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক—পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব, আরবি বিভাগের অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক মাহমুদ জামাল কাদেরী সমর্থন জানিয়ে অংশ নেন। কয়েকজন শিক্ষার্থীও প্রতীকী অনশনে অংশ নেন।
মধ্যরাতে গিয়ে একজন ছাত্রকে ঘুম থেকে টেনে তুলে তাঁকে গলাধাক্কা দিয়ে হল থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ছোট উপস্থিতিই প্রমাণ করে, ক্যাম্পাসগুলোতে ভয়ের সংস্কৃতি কতটা গেড়ে বসেছে। বিরোধী কোনো মত চর্চার কোনো সুযোগই রাখা হয়নি। নিরঙ্কুশ এই আধিপত্য চর্চার পরিণতি কি আজকের মগের মুল্লুক নয়?
মনোজ দে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
monoj. dey@prothomalo. com