খবরটা সুখকর নয়। বন্দরনগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে এসে বাধাগ্রস্ত হলো। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। শুরুতে এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ছয় হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি। পত্রপত্রিকার খবরে জানা যায়, ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতায় চট্টগ্রামের ১৮টি খালের সংস্কারকাজ এগোচ্ছে না। অথচ এ প্রকল্পের প্রধান কাজই হলো খাল সংস্কার। খালের সম্প্রসারণ কিংবা পুনঃখনন ছাড়া পানিনিষ্কাশনের পথ সুগম হবে না। জলাবদ্ধতার নিরসনও হবে না। আর তাই আসন্ন বর্ষার দুঃখ–দুর্দশার আশঙ্কা আতঙ্কে ফেলে দিল চট্টগ্রামবাসীকে।
যে কটি খালের সংস্কার বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে চাক্তাই খালও রয়েছে। পানিনিষ্কাশনের জন্য চট্টগ্রামের প্রধান খাল এটিই। চাক্তাই খাল সংকীর্ণ থাকায় চট্টগ্রামের দুঃখও যাচ্ছে না।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সংস্কারের জন্য তালিকাভুক্ত হয়েছে ৩৬টি খাল। সে অনুযায়ী এগুলোর সংস্কারের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী। এর মধ্যে সাতটির কাজ শেষ। ১১টির কাজ শেষ হওয়ার পথে। বাকি ১৮টি খালের সংস্কারে বাগড়া দিয়েছে ভূমি অধিগ্রহণের জটিলতা। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৭২৭ কোটি ৮৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা, পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণের জন্য বাড়তি আরও ১৭ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অধিগ্রহণের জন্য জমির ক্ষতিপূরণের মূল্য বাড়িয়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাব এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। আর এ অপেক্ষার ভেতর দিয়ে চট্টগ্রামবাসী পার করছে ১৪২৮ বাংলা সনের শেষ মাস চৈত্র। এরপর নতুন বছরের বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে আসবে আষাঢ়। আর শুরু হবে নগর ডোবানোর খেলা। এটা আমাদের প্রতিবছরের নিয়তি।
নিয়তি; কারণ বৃষ্টি হলেই চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজখালী, বাকলিয়া, চকবাজার, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, ষোলশহর, নাসিরাবাদ, সাগরিকা, কাট্টলী, পতেঙ্গাসহ নগরের ৩০ শতাংশ এলাকা জলমগ্ন থাকবে। এর মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী হয় জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে জোয়ারের সময় যদি বৃষ্টি হয়, তাহলে মহেশ খাল দিয়ে পানি নামতে পারে না। তাতে আগ্রাবাদে জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মহেশখালের ওপর বাঁধ বেঁধে দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেশি কাজে আসেনি ড্রেজিংয়ের অভাবে। তা ছাড়া এ খালের দুপাশের দখলও উচ্ছেদ করা যায়নি।
মহেশখাল আগ্রাবাদের দুঃখের কারণ, তবে চট্টগ্রাম নগরের বেশির ভাগ এলাকার জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী চাক্তাই খাল। দূষণে–দখলে সংকীর্ণ হয়েছে এর পরিসর। বিভিন্ন স্থাপনার জন্য এখন খালের পাশে নিরবচ্ছিন্নভাবে হাঁটার সুযোগ নেই। কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ করে মাস্টারপুল থেকে বউবাজার পর্যন্ত খুব সংকীর্ণ। অনেকাংশে নেই সীমানাদেয়াল। অপরিকল্পিত সংস্কারে ভরাট হয়েছে তলদেশ। নগরের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পানি এ খালেই এসে পড়ে। কিন্তু সেই ভার নেওয়ার ক্ষমতা চাক্তাই খাল হারিয়ে ফেলেছে। অথচ একসময় খাতুনগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, আছদগঞ্জ থেকে মালামাল খরিদ করে ব্যবসায়ীরা এ চাক্তাই খাল দিয়েই প্রতিদিন শত শত নৌকাযোগে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যেতেন। এখন নৌযান চলাচল দূরের কথা, কালো কুচকুচে পানিতে স্রোত দেখা যায় না। নাব্যতা হারিয়ে এটি পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। এ খালের সঙ্গে ডজনখানেক ছোট খাল ও ছড়াও সংযুক্ত ছিল। সেগুলোর অস্তিত্বও বিলীন হয়ে গেছে।
এ বিপুল সংকট তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ খাল ও ছড়ার অবৈধ দখল এবং সেগুলোর পাশে স্থাপনা নির্মাণ। সেগুলো উচ্ছেদ হয়নি, সংকটও দূর হয়নি। নইলে বর্তমানে চলমান প্রকল্পের আগেও চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে অনেক প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। খরচ হয়েছে কোটি কোটি টাকা। কোনো সুফল পাওয়া যায়নি সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর দখল উচ্ছেদে ব্যর্থতার জন্য।
চট্টগ্রামে খাল, উপখাল, শাখা–প্রশাখাগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ১৮২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। আগের পরিকল্পনাগুলো যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হতো, তাহলে বর্তমানে এত বেগ পেতে হতো না। এখনকার মেগা প্রকল্পটি শুরু হয়েছে পাঁচ বছর আগে। তার আগে যুগে যুগে দখল আর ভরাটে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। বিশেষ করে চাক্তাই খাল, হিজড়া খাল, মির্জা খাল, মহেশখাল, জামালখান এলাকার খাল ও ছড়াগুলোর দখল হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে এ প্রকল্পের বাস্তবায়নও কঠিন হয়ে পড়েছে। খাল দখল প্রতিরোধের জন্য বর্তমান সরকার খালের দুই পাড়ে সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে খালের দুই পাড়ে দখল কমে যাবে। চাক্তাই খালের মোহনার দিকে চাক্তাই বাণিজ্যিক এলাকায়, রাজাখালীতে এখন দুই পাড়ে সড়ক হয়েছে। এতে নানা ধরনের লাভ হয়েছে। যোগাযোগের সুবিধা হয়েছে। যানজট কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় কথা—সড়ক ডিঙিয়ে খাল দখলের মত্ততা আর ওখানে নেই।
এখন চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, মহেশখাল, চশমা খাল, রাজাখালী খাল-১, রাজাখালী খাল-৩, হিজড়া খাল, জামালখান খাল, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, নোয়াখাল, ডোমখালী খাল, বামনশাহী খাল, শীতল ঝরনা খাল, নয়ারহাট খাল, গয়নাছড়া খাল, মহেশখালী খাল এবং খন্দকিয়া খালের যে সংস্কারকাজ আটকে আছে ভূমি অধিগ্রহণের জন্য, তা থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি। চট্টগ্রাম শহরের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এসব খালের স্রোত পুনরুজ্জীবিত করতেই হবে।
● ওমর কায়সারপ্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের বার্তা সম্পাদক